Published : 20 Dec 2024, 08:47 AM
মৌসুমের শুরুতে রাজবাড়ীতে অতিবৃষ্টির কারণে পেঁয়াজ রোপণ পিছিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এবার ফলনও কিছুটা কম হয়েছে। এতে লোকসানের আশঙ্কা করছেন কৃষক।
এ ছাড়া বাজারে কাঙ্ক্ষিত দাম না পেলে বিঘাপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লোকসানের শঙ্কার কথা বলেছেন চাষিরা। এমন পরিস্থিতিতে বাইরে থেকে পেঁয়াজ আমদানি না করারও দাবি তুলেছেন তারা।
তবে কৃষি বিভাগ বলছে, বাজারে এখন যে দামটা আছে এর থেকে একটু বেশি হলে কৃষক লাভবান হবেন।
কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের পেঁয়াজ চাষি আব্দুল মালেক। তিনি এবার তিন বিঘা জমিতে পেঁয়াজ রোপণ করেছেন। এ পর্যন্ত তার খরচ হয়েছে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। তবে ক্ষেত দেখে তার মন খারাপ। কারণ গত বছরের চেয়ে এবার উৎপাদন কম হয়েছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গেলবার বিগেয় ৬০ থেকে ৭০ মণ পিজ (পেঁয়াজ) হইছে, কিন্তু ইবার হইছে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ মণ। যা ফলন হইছে তাতে তিন বিগেয় দেড় লাখ টাকা লস যাবি। এই ক্ষতি কী দিয়ে পূরণ হবি? সেই চিন্তাই করতেছি।
“ইবার দেড় লাখ টাকা উঠবে কি-না সন্দেহ। যদি পুড়ানো যেতো তাহলে পিজ পুড়ায়ে দিতাম। এ ছাড়া আর কী করব?”
আব্দুল মালেকের মত একই অবস্থা জেলার অন্য চাষিদেরও। তারা বলছেন, অতিরিক্ত বৃষ্টিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ রোপণ পিছিয়ে যাওয়ায় এ বছর পেঁয়াজের ফলন অর্ধেক হয়েছে। এবার বিঘাপ্রতি মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদনে খরচ হয়েছে এক থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা।
গত বছর বিঘাপ্রতি ৬০ থেকে ৭০ মণ পেঁয়াজ পাওয়া গেলেও এবার ফলন কম হওয়ায় বিঘাপ্রতি পেঁয়াজ হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ মণ। একদিকে ফলন কম, আরেকদিকে বাজারে কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় বিঘাপ্রতি লোকসান গুণতে হবে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।
জেলার বিভিন্ন মাঠে গিয়ে দেখা যায়, যতদূর চোখ যায় ততদূর শুধু পেঁয়াজ ক্ষেত। পেঁয়াজ গাছগুলো সবুজ হয়ে রয়েছে। মুড়িকাটা পেঁয়াজ পরিচর্যায় চাষিরা শেষ সময়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ ক্ষেত নিড়ানি দিচ্ছেন, কেউ আগাছা পরিষ্কার করছেন, কেউ জমি থেকে পেঁয়াজ উত্তোলন করছেন।
রতনদিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের পেঁয়াজ চাষি মো. ফারুক বলেন, “গতবারের মত এবার ফলন হয় নাই। আমাগের মনে করেন যে, বিগে প্রতি খরচ হয়েছে এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। গতবার যে দাম ছিল, আর যে ফলন হয়ছিল, আমরা লাভবান ছিলাম।
“ইবার ফলন কম আর বাজারে যে বিক্রি হতেছে, তাতে আমাগে বিগেপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লস যাবে। এখন এই ক্ষতি আমরা কীভাবে পূরণ করব? যদি এই রকম বাজার থাকে তাইলে আমরা পিয়েজ উটোব না। উটোনের ইচ্চে ছিল, এক সপ্তাহ থেকে দশ দিন পরে।”
চাষি ফারুক বলেন, “এইরকম বাজার হলি আমাগে পিয়েজ উটোব না। ক্ষ্যাতে পিয়েজ পচায়ে দিব। উটোয়ে লাভবান হইতে পারব না তো। বিগে প্রতি আমাগে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লস যাবি, এ রকম পিয়েজ আমরা উটোয়ে বিক্রি করব না।”
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আরেক পেঁয়াজ চাষি শাহজাহান মোল্লা। তিনি বলেন, “বলার কিচুই নাই। পিয়েজের যে অবস্থা, বর্তমান যে বাজার। পিয়েজের ওষোধ, সার আর পরেতের টাকা দিতে দিতে আমরা শ্যাষ। এহন মাঠে আসলে পরে আমাগো অস্থির লাগে। ৩০০ টাকা কেজি পিয়েজ কিনে লাগাইছি।
“বর্তমান পিয়েজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি। এহন সরকার যদি পিয়েজ আমদানি করে তাইলে আমাগো মাটে মরে যাওয়াই ভালো। এই পিয়েজ আমাগো দরকার নাই, এই পিয়েজ আমাগো বেচার মত পরিবেশ নাই। বাইরের পিয়েজ যদি আর না আসে তালি আমরা ইটু বাঁচে থাকপ।”
ওই এলাকার আরেক চাষি জিলাল মোল্লা বলেন, “বীজ, সার, পরেত খরচ দিয়ে বিগেয় এক লাখ থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা খরচ গেছে। গতবারের চেয়ে ইবার হলো অর্ধেক ফলন। গতবার বিগেয় ৬০ মণ করে হলি ইবার ৩০ মণ ৩৫ মণ করে হচ্চে। আবার দামের বেলায় য্যায়া যা তাই পাচ্চি। ৪০ টাকা, ৪২ টাকা, ৪৫ টাকা কেজি হচ্চে।
“ইর ভিতর আবার ধরেন খরচ আচে, ধরেন উঠোনের খরচ, পরেত খরচ, গাড়ি ভাড়া আচে। তাতে খরচ বাদে আমরা পাচ্চি ৩৫ টাকা কেজি। তালি বিগেপ্রতি হাতে পাচ্চি ৪০-৪৫ হাজার টাকা। তালি ৫০-৬০ হাজার টাকা আমাদের বিগেপ্রতি ইবার লসের দিকে। এত যদি লস যায় তালি তো আমাদের বাঁচার মত পরিবেশ নাই।”
রাজবাড়ীর বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি মুড়িকাটা পেঁয়াজ ৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। যেখানে কৃষকেরা বলছেন, তারা প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি অর্থাৎ দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা মণ বিক্রি করছেন। হাত বদলে একই পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৩০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতা আফজাল হোসেন বলেন, “আমরা আড়ত আর হাট থেকে পেঁয়াজ কিনে এনে বিক্রি করি। যে দামে কিনি তা থেকে সামান্য কিছু লাভে বিক্রি করে থাকি।”
‘সামান্য কত টাকা’ এমন প্রশ্নের উত্তরে আফজাল হোসেন বলেন, “ধরেন বালিয়াকান্দির বহরপুর হাট থেকে এক মণ পেঁয়াজ কিনলাম। এরপর রাজবাড়ী পর্যন্ত আনতে খরচ পড়বে ২০০ টাকা। যাতায়াত ভাড়ার টাকা তো আমাকে ওই পেঁয়াজের ওপর থেকে উঠাতে হবে।
“এরপর কিছু টাকা লাভও করতে হবে। এজন্য চাষিরা যে দামে বিক্রি করে সেই দাম থেকে বাজারে বেশি দামে বিক্রি হয়। মঙ্গলবার হাটে কৃষকের কাছ থেকে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৭০ টাকা করে অর্থাৎ ২৮০০ টাকা মণ দরে কিনে এনেছি। এখন বিক্রি করছি ৮০ টাকা কেজি।”
রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা গোলাম রাসূল বলেন, এ বছর জেলায় পাঁচ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। তবে রোপণের সময় অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে আবাদ পিছিয়ে যাওয়ায় এবার ফলন কিছুটা কম হবে।
দামের বিষয়ে তিনি বলেন, পেঁয়াজের দাম সবসময় ওঠানামা করে। এখন যে দাম আছে এর থেকে একটু বেশি হলে কৃষক লাভবান হবেন।
শেষ পর্যন্ত কৃষকরা যে পেঁয়াজ পাচ্ছেন, তাতে হয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না তবে লাভের পরিমাণ কমবে বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।