Published : 16 May 2024, 12:43 PM
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার লিচু বাগানগুলোতে তুলনামূলক দ্রুত ফল আসে। তবে এ বছর টানা তাপদাহ ও শিলাবৃষ্টিতে লিচুর উৎপাদন কম হয়েছে। ফলে এবার আশানুরূপ মুনাফার দেখা মিলবে না বলে শঙ্কা বাগান মালিকদের।
সোনারগাঁ উপজেলার চিলারবাগ গ্রামের বাসিন্দা মাফিয়া আক্তারের বাড়ির সামনে সারিবদ্ধ কয়েকটি লিচু গাছ দেখা গেল। এক সময় কেবল বাড়ির লোকজনের খাওয়ার জন্য লিচুর গাছ লাগালেও এখন বাজারে বিক্রিও করেন মাফিয়া।
তবে এ বছর সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় ও তীব্র তাপদাহ আর শিলাবৃষ্টির কারণে লিচুর ফলন কম হয়েছে বলে জানান তিনি।
মাফিয়া বলেন, “সোনারগাঁয়ের লিচু সবার আগে বাজারে আসে। এই কারণে লোকজনের কাছে এই লিচুর কদর বেশি। কিন্তু এবার তীব্র গরম আর শিলাবৃষ্টির কারণে অনেক লিছু ঝরে পড়েছে। আর যেগুলো গাছে তাও ঠিকমতো বড় হয়নি।”
একই ভাষ্য এ উপজেলার অন্যান্য লিচু বাগানমালিকদের। বাগান মালিক ও কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ জেলার মাটি ও আবহাওয়া লিচু উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। যদিও কেবল সোনারগাঁ উপজেলাতেই লিচুর বাণিজ্যিক চাষ হয়। সাধারণত কদমি, পাতি ও চায়না-৩; এই তিন প্রজাতির লিচুর উৎপাদন হয় এসব বাগানে।
গত বছর ১০০ হেক্টরের মতো জমিতে লিচুর উৎপাদন করা হয়। এ বছর জমির পরিমাণ ৭ হেক্টরের মতো বেড়েছে বলে জানান সোনারগাঁ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আফরোজা সুলতানা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এ বছর উপজেলার ১২টি গ্রামের অন্তত ১০৭ হেক্টর জমিতে ৭৮০টি বাগানে লিচুর বাণিজ্যিক চাষ করা হয়েছে। তবে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে গতবছরের তুলনায় এবার ফলন কম হয়েছে।
“গতবছর বাগানগুলোতে ৭০০ মেট্রিক টন লিচু উৎপাদন হয়েছিল। এ বছর বাগানের সংখ্যা বাড়ায়, উৎপাদন বেশি হবে বলে আশা ছিল। কিন্তু সময়মতো বৃষ্টি না হওয়া, অত্যধিক তাপমাত্রা ও শিলাবৃষ্টির কারণে এ বছরও উৎপাদন সেই ৭০০ মেট্রিকটনে ঠেকবে বলে ধারণা করছি।”
মঙ্গলবার সরেজমিনে উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পানাম নগর, চিলারবাগ, উত্তর ষোলপাড়া, গোয়ালদী, গাবতলী গ্রামে সারি সারি লিচু বাগানের দেখা মেলে। অনেকে নিজের বাড়ির সামনে অল্প খালি জায়গায়ও লিচু গাছ লাগিয়েছেন। বেশিরভাগ বাগানে লিচু পাড়ার কাজ প্রায় শেষ। বাকি বাগানগুলোতে লিচু পাড়ার কার্যক্রম চলছিল।
এসব বাগানের অধিকাংশ মালিক তাদের বাগান মৌসুমভিত্তিক ভাড়া দেন। গাছে ফুল আসা থেকে ফল ধরার পর পরিচর্যা ও লিচু বাজারজাত করা পর্যন্ত সবকিছুই করেন ভাড়াটে চাষিরা।
প্রায় ৪০ শতাংশ জমির একটি লিচু বাগান ২ লাখ ২০ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছেন শাহ আলম নামে একজন ব্যক্তি। বাগানটির দেখাশোনা করেন আওলাদ হোসেন। বাগানের পরিচর্যায় আরও ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে জানালেন আওলাদ।
আওলাদ বলেন, “সোনারগাঁয়ের লিচু গাছে সবার আগে ফল আসে। এই কারণে বাজারে এর চাহিদা বেশি। কিন্তু এবার ফলন ভালো হয় নাই। বৃষ্টিটা সময়মতো হইলে এমনটা হইতো না। যখন বৃষ্টি হইছে তখন শিলা; এতে আরও বেশি ক্ষতি করছে।”
বাগানের লিচু পাড়া শুরু হয়েছে জানিয়ে আওলাদ আরও বলেন, “লিচুগুলো বাজারে বিক্রি করলে অন্তত ছয় লাখ টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু ফলন ভালো হলে মুনাফা আট লাখ টাকার মতো হত।”
উত্তর শোলপাড়া এলাকায় লিচুর বাগান ভাড়া নিয়েছেন মো. হানিফ নামের একজন। তিনি বলেন, “এইবার গাছে ভালো ফুল আসছিল। এইটা দেইখা অন্যবছর একটি বাগান লিজ নিলেও এবার তিনটা নিছি। যেই আশায় তিনটা বাগান লিজ নিছিলাম সেই আশা পূরণ হইবো না। কারণ ফলন কম।”
উপজেলার বাগানগুলোতে আশানুরূপ ফলন না আসলেও লিচু বাজারজাত করতে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না বলে জানান বাগান মালিক ও ভাড়াটে চাষিরা। বেশিরভাগ লিচু উপজেলার মোগরাপাড়া বাজারে ফলের আড়তে বিক্রি হয়, যা পরে ঢাকা ও আশেপাশের ফলের বাজারে পৌঁছায়।
প্রতি হাজার লিচু ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে এ বছর। তবে চায়না-৩ জাতের লিচুর দাম তুলনামূলক বেশি।
এছাড়া ঐতিহ্যবাহী সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর এবং পানাম নগরে বেড়াতে আসা পর্যটক ও দর্শনার্থীরাও লিচু কিনে নিয়ে যান বলে জানান বাগান মালিকরা।
এ অঞ্চলে প্রথম লিচুর চারা বারো ভূঁইয়াদের শাসনামলে নিয়ে এসেছিলেন পর্তুগিজ পর্যটকরা। তখন থেকেই এ অঞ্চলে লিচুর চাষ হলেও কয়েক বছরে এর বাণিজ্যিক চাষ বেড়েছে বলে জানান কৃষি কর্মকর্তা আফরোজা।
তিনি বলেন, “সোনারগাঁয়ের লিচু দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অন্তত একমাস আগে বাজারে আসে। এমনকি দিনাজপুরের লিচুও আরও কয়েকদিন পরে বাজারে আসবে। কিন্তু সোনারগাঁয়ের লিচু এখনই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
“বর্তমানে রাজধানীর কাওরানবাজারসহ বিভিন্ন বাজারে পাওয়া ৯০ শতাংশ লিচুই সোনারগাঁয়ে উৎপাদিত।”
এদিকে তীব্র তাপ ও শিলাবৃষ্টির বাইরে এ বছর ফলন কম হওয়ার পেছনে আরও একটি কারণের কথা জানালেন এ কৃষি কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “এই উপজেলায় অনেক বাগানমালিক আছেন যারা বাগান ভাড়া দিয়ে দেন। ভাড়াটে চাষিরা অনেক সময় গাছের সঠিক পরিচর্যা করেন না। এমনকি কৃষি কর্মকর্তাদেরও পরামর্শ নিতে আসেন না।
“তীব্র তাপদাহে নিয়মিত পানি ব্যবহার ও সেচের প্রয়োজন আছে। তাছাড়া লিচু পাড়ার পরও বাগানের পরিচর্যা করতে হয়, নাহলে পরের বছর ভালো ফলন পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে অনেকেই উদাসীন।”
তবে নিজেদের সীমবদ্ধতার কথা জানিয়ে আফরোজা বলেন, “বাগান মালিক বা চাষিদের আমরা সবসময় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে থাকি। চাহিদাভিত্তিক কীটনাশক ছেটানোর মেশিনও দিয়ে থাকি। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী আমাদের কাছে পর্যাপ্ত মেশিন নেই। এজন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে চাহিদাপত্রও দেওয়া আছে।”