Published : 16 Jun 2023, 07:14 PM
চার আসামিকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার ঘটনায় পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ও পরিদর্শক (তদন্ত) সুরুজ উদ্দিন আহম্মেদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার পুলিশ সদরদপ্তর থেকে ওই আদেশ দেওয়া হয় বলে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার সাইফুল হক জানিয়েছেন।
এর আগে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলাধীন পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসিকে দায়িত্ব থেকে প্রতাহার করে জেলা পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছিল এবং ওসির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সুরুজ উদ্দিন আহম্মেদকে।
সাময়িক বরখাস্ত করার পর মোস্তাফিজুর রহমানকে চট্টগ্রাম এবং সুরুজ উদ্দিন আহম্মেদকে বরিশাল রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়েছে।
শরীয়তপুরের নাওডোবা বাজারের ব্যবসায়ী আবু জাফর ওরফে ঠাণ্ডু চোকদারকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে ৭২ লাখ টাকার চেক নেওয়া এবং একটি ছিনতাই মামলার চার আসামিকে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠেছে মোস্তাফিজুর রহমান এবং নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনিরের বিরুদ্ধে।
তবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনিরের বিষয়ে এখনও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে শরীয়তপুর পুলিশ সুপার সাইফুল হক সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশের দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের শরীয়তপুর থেকে অন্যত্র সংযুক্ত করা হয়েছে।
“নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। শিগগিরই গণমাধ্যমকর্মীদের এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।”
পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে জানা যায়, জাজিরার নাওডোবা বাজারের ব্যবসায়ী আবু জাফর ওরফে ঠাণ্ডু চোকদার ১ জুন পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন, ৩১ মে গভীর রাতে তাকে বাড়ি থেকে থানায় তুলে নেন জাজিরার পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুরুজ উদ্দিন আহম্মেদ। থানায় নিয়ে নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও ওই থানার ওসি শেখ মোস্তাফিজুর রহমান তাকে ওই ছিনতাই মামলার আসামি তার চার আত্মীয়ের পক্ষে ৭২ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দেন। তাকে বলা হয়, এর বিনিময়ে ওই চার আত্মীয়ের মালিকানাধীন নাওডোবা বাজারের দুটি দোকান তার নামে লিখে দেওয়া হবে। তবে এতে রাজি হননি আবু জাফর ওরফে ঠাণ্ডু।
অভিযোগে আরও বলা হয়, তখন ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা [রাসেল মনির ও শেখ মোস্তাফিজুর রহমান] তাকে [আবু জাফর] মারধর করেন। এক পর্যায়ে ৭২ লাখ টাকার চেক লিখে দিতে রাজি হলে তার চাচা ও মামলার আসামি রশিদ চোকদারের জিম্মায় ভোররাতে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
পরদিন সকালে ন্যাশনাল ব্যাংক নাওডোবা শাখায় নিজের হিসাব নম্বরের ৫টি চেকে ৭২ লাখ টাকা লিখে দেন আবু জাফর; এবং ওই চেকগুলো ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে দেওয়া হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করেন ঠাণ্ডু।
আবু জাফর ঠাণ্ডুর ওই অভিযোগ তদন্ত করছিলেন শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোহাম্মদ বদিউজ্জামান। বৃহস্পতিবার তিনি পুলিশ সুপারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।
এরপরই পুলিশ সদরদপ্তর থেকে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ও ওসির দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক (তদন্ত) সুরুজ উদ্দিন আহমেদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
সাময়িক বরখাস্তের বিষয়ে জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে সুরুজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, “সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে – এমন খবর লোকমুখে শুনেছি। কোনো আদেশ পাইনি। ওই রাতে আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ পালন করেছি মাত্র।”
এ ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোহাম্মদ বদিউজ্জামান বলেন, “১ জুন এক ব্যবসায়ী তাকে (আবু জাফর) নির্যাতন করে ৭২ লাখ টাকার চেক লিখে নেওয়ার একটি অভিযোগ করেছিলেন দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ২ জুন থেকে ঘটনাটি তদন্ত করছি। গতকাল [বৃহস্পতিবার] তদন্ত প্রতিবেদন পুলিশ সুপারের কাছে জমা দিয়েছি।”
যখন থেকে ঘটনার শুরু
গত ২১ মে শরীয়তপুরের জাজিরার আহাদী বয়াতিকান্দি গ্রামের শাহীন আলম শেখ ও তার সহযোগী ছোট কৃষ্ণনগর গ্রামের সেকান্দার মাদবরের কাছ থেকে ১৭ হাজার ডলার, টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনতাই হয়। এ ঘটনায় গত ২৩ মে নয় জনকে আসামি করে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় একটি মামলা করেন শাহীন আলম।
মামলায় নাওডোবা বাজারের ব্যবসায়ী আবু জাফর ঠাণ্ডুর চার আত্মীয়কে আসামি করা হয়। আসামিরা হলেন জাফরের চাচা রশিদ চোকদার, তার ছেলে বকুল চোকদার, জাফরের আরেক চাচা বাদশা চোকদার ও তার ছেলে সাদ্দাম চোকদার।
ওই চার আসামির ভাষ্য, গত ২৯ মে তারা উচ্চ আদালত থেকে ৬ সপ্তাহের জামিন পান। এরপর রাতে তারা ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি বাসায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে স্থানীয় দুই যুবক তাদের ওপর চড়াও হন; এদের একজন মামলার বাদীর আত্মীয় এবং আরেকজন একটি প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের স্থানীয় নেতা। পরে ওই যুবকদের একজন [ছাত্র সংগঠনের স্থানীয় নেতা] অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির এবং ওসি শেখ মোস্তাফিজুর রহমানকে মোবাইল ফোনে কেরাণীগঞ্জের ওই বাসায় ডেকে নেন। সেখানেই একটি কক্ষে আটকে তাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।
পরে ১ জুন আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
পরদিন ২ জুন পুলিশ সুপারের কাছে দেওয়া অভিযোগে ব্যবসায়ী জাফর বলেন, ৩১ মে রাতে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার পুলিশ তাকে বাড়ি থেকে তুলে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে ওসির কক্ষে আটকে চোখ বেঁধে দুই ঘণ্টা ধরে পেটানো হয়। এক পর্যায়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও ওসি মোস্তাফিজুর তাকে চার আত্মীয়ের পক্ষে ৭২ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দেন। এর বিনিময়ে ওই আত্মীয়দের মালিকানাধীন নাওডোবা বাজারের দুটি দোকান তার নামে লিখে দেওয়ার কথা বলা হয়।
ব্যবসায়ী জাফর ঠাণ্ডুর ভাষ্য, নির্যাতনের এক পর্যায়ে ৭২ লাখ টাকার চেক লিখে দিতে রাজি হলে তার চাচা রশিদ চোকদারের জিম্মায় ভোরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরদিন সকালে ন্যাশনাল ব্যাংক নাওডোবা শাখায় নিজের হিসাব নম্বরের ৫টি চেকে ৭২ লাখ টাকা লিখে দেন আবু জাফর। পরে চেকগুলো ওসি মোস্তাফিজুরের কাছে দেওয়া হয়।
জাফর ঠাণ্ডুর অভিযোগ পেয়ে ঘটনাটি তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোহাম্মদ বদিউজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। আর পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসিকে প্রত্যাহার করে সংযুক্ত করা হয় জেলা পুলিশ লাইনসে।
বিষয়টি নজরে আসার পর হাই কোর্টের আদেশ
গত ১১ জুন বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে এনেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মজিবুর রহমান। তখন আদালত লিখিত আবেদন করতে বলে।
পরদিন [১২ জুন] দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাই কোর্টে আবেদন করেন আইনজীবী মজিবুর রহমান। এ সময় তিনি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের কপি আদালতে জমা দেন।
শুনানি শেষে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের হাই কোর্ট বেঞ্চ শরীয়তপুরের নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানকে [সাময়িক বরখাস্ত] আদালতে তলব করে।
একইসঙ্গে উচ্চ আদালতে জামিন পাওয়ার পরও আসামিদের কারাগারে পাঠানোয় শরীয়তপুরের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তলব করা হয়েছে। আগামী ১৬ জুলাই তাদের সশরীরে হাজির হতে বলা হয়েছে।
আর ৭২ লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক ও শরীয়তপুরের পুলিশ সুপারকে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতেও বলা হয় হাই কোর্টের আদেশে।
হাই কোর্টে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আনিসুর রহমান।
আইনজীবী সারওয়ার হোসেন বাপ্পী ওইদিন আদেশের পর বলেন, গত ২৯ মে ছিনতাই মামলার তিন আসামিকে ৬ সপ্তাহের জামিন দেয় উচ্চ আদালত। এরপরও তাদের গ্রেপ্তার করে নির্যাতন চালায় পুলিশ। পরে ১ জুন আসামিদের হাকিম আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
“উচ্চ আদালতের আদেশ থাকায় চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের উচিত ছিল সঙ্গে সঙ্গে জামিন দেওয়া। এটা না করে তিনি কারাগারে পাঠিয়েছেন। এ ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনসহ বিষয়টি আজকে নজরে আনার পর দুই পুলিশ অফিসার এবং চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তলব করেন হাই কোর্ট। পাশাপাশি পুলিশের মহাপরিদর্শক ও শরীয়তপুরের পুলিশ সুপারকে এ বিষয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে।”
আরও পড়ুন:
শরীয়তপুরের দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও বিচারককে হাই কোর্টে তলব
শরীয়তপুরের সেই এএসপি, ওসির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ
৭২ লাখ টাকার চেক লিখে নেওয়ার অভিযোগে ওসি প্রত্যাহার
দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৭২ লাখ টাকার চেক লিখে নেওয়ার অভিযোগ