Published : 07 Oct 2022, 05:36 PM
ছাত্রলীগের কমিটি ‘বিলুপ্তি’ নিয়ে দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের উত্তেজনার মুখে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল ও পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এখন দুর্গাপূজায় ছুটির পর পরই হলে ফিরে পরীক্ষায় বসতে পারবেন কি-না তা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা।
৩০ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে মেয়াদোত্তীর্ণ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আধা ঘণ্টার মধ্যেই ছাত্রলীগের ফেইসবুক পেইজ থেকে তা আবার সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।
আর এতেই ‘বিভ্রান্তির’ সূচনা ঘটে। দুর্গাপূজার ছুটির মধ্যে ১ অক্টোবর ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ ক্যাম্পাসে মোটরসাইকেল ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র প্রবেশ করলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরদিন ২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরবর্তী নির্দে শ না দেওয়া পর্যন্ত হল ও পরিবহন বন্ধ ঘোষণা করে; পাশাপাশি ১০ থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত সব পরীক্ষা স্থগিত করে।
চার দিন পর ৩ অক্টোবর এসে ছাত্রলীগের সভাপতি জানান, কমিটি বহাল আছে। তারপর দুপক্ষের উত্তেজনা কিছুটা কমে। নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে আসা পুলিশ সদস্যরাও ক্যাম্পাস ছেড়ে যান।
এ অবস্থায় পূজার ছুটির পর ‘বন্ধ হলে’ কীভাবে ফিরবেন তা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। আর পরীক্ষায় বসতে না পারলে সেশন জটের কবলে পড়ার আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন তারা।
বেশ কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এটা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ কাজ। যারা ফলে ‘বলির পাঁঠা’ হয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যদি ছাত্রলীগ শুরুতেই এটা নিয়ে কথা বলত তাহলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। ‘ছাত্রলীগের উত্তেজনার কারণে’ হল ও পরিবহন বন্ধ এবং পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
হল বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীরা এসে উঠবেন কোথায়; পরিবহন বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আসবেন কীভাবে- এই প্রশ্ন রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান বলেন, “আমরা করোনাভাইরাসের মহামারারীর কারণে এমনিতেই এক বছর পিছিয়ে আছি। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা এভাবে বন্ধ থাকে, তাহলে আমাদের লেখাপড়া আরও পিছিয়ে পড়তে হবে।”
“এ ছাড়া এটার (ছাত্রলীগের দুপক্ষের দ্বন্দ্ব) স্থায়ী সমাধান না হলে নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত আমরা। হামলা হলে দায় কি কোনো পক্ষ বা প্রশাসন নেবে? যারা অপরাধ করে তাদের বিচার হয় না। শেষ পর্যন্ত কষ্ট আর দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের।”
যদিও ‘এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো উত্তেজনা নেই‘ উল্লেখ করে ছাত্রলীগের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ইলিয়াস হোসেন বলেছেন, “পূজার ছুটি শেষে ১০ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় খুললে আমরা উপাচার্য স্যারকে স্মারকলিপি দিয়ে অনুরোধ জানাব হলগুলো খুলে দিয়ে পরীক্ষা ও ক্লাস নিয়মিত নেওয়ার জন্য। আমরা চাই না, কোনো শিক্ষার্থী দুর্ভোগে পড়ুক। প্রয়োজনে আমরা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেব। তবে কোনো বহিরাগত বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পরিস্থিতি অশান্ত করতে চাইলে তার দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিতে হবে।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু বন্ধ তাই জরুরি বৈঠকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য হল ও পরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে। পূজার ছুটি শেষে ১০ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে। আমরা পরীক্ষা স্থগিত করার মূলত কারণ হচ্ছে- অনেক শিক্ষার্থীর বাড়ি দূরে, তারা যেন ভালোভাবে ফিরে এসে পরীক্ষায় বসতে পারে- সেজন্য।”
চার দিন পর সভাপতি বললেন, কমিটি বহাল
সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের ২৮ মে মো. ইলিয়াস মিয়াকে সভাপতি ও রেজাউল ইসলাম মাজেদকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর একই বছরের ২৫ নভেম্বর ১৬১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়।
এক বছরের জন্য গঠিত কমিটি প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে চলেছে। ওই কমিটির নেতাদের অনেকের এখন আর ছাত্রত্ব নেই; অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেছেন। কেউ আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছেন। সভাপতি ইলিয়াস মিয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী, তারও ছাত্রত্ব নেই। তিনি ১৫ বছর ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলে একা একটি কক্ষে থাকছেন বলেও অভিযোগ আছে।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার রাত ১১টা ৪৯ মিনিটে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ফেইসবুক পেইজে সংগঠনের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে মেয়াদোত্তীর্ণ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আধা ঘণ্টার মধ্যেই ছাত্রলীগের ফেইসবুক পেইজ থেকে তা আবার সরিয়ে নেওয়া হয়।
আর এতেই ‘বিভ্রান্তির’ সূচনা ঘটে। ‘বিলুপ্ত’ কমিটির বিরোধীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, প্রেস বিজ্ঞপ্তি সঠিক, কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। আবার ‘বিলুপ্ত’ কমিটি বলছে, এটি ভুলে চলে এসেছে। সামনে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি দেওয়া হবে।
এর অংশ হিসেবে পরদিন ১ অক্টোবর দুপুর আড়াইটার দিকে ছাত্রলীগের একটি পক্ষের নেতা এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহীর অনুসারীরা অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসে সমাবেশ ও হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
এর পর পরই ছাত্রলীগের ‘বিলুপ্ত কমিটি’র সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজের অনুসারীরা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে রামদা, ছেনিসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হাজির হয়। এতে ক্যাম্পাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে ক্যাম্পাসে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
তখন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটির বিষয়ে জানার জন্য চেষ্টা করেও সংবাদমাধ্যমগুলো ছাত্রলীগের সভাপতির বক্তব্য জানতে পারেনি। বিভ্রান্তি দূর করতে ছাত্রলীগ কোনো বিবৃতিও দেয়নি। এ বিষয়ে তারা ছিলেন চুপ।
চার দিন পর ৩ অক্টোবর ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় সাংবাদমাধ্যমকে বলেন, “কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি বলবৎ আছে এখনও। কমিটি এখনও বিলুপ্ত হয়নি। চলতি মাসের শেষের দিকে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বের হাতে কমিটি তুলে দেওয়া হবে। সেই পর্যন্ত বর্তমানরাই দায়িত্ব পালন করবেন।”
এ সময় তিনি আরও বলেন, “আমরা একই দিনে (৩০ সেপ্টেম্বর) তিনটি ইউনিটের সম্মেলনের তারিখ দিয়েছি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি নিয়ে যে প্রেস রিলিজ দেওয়া হয়েছে, সেটাতেও সম্মেলনের তারিখ দেওয়ার চিন্তা ছিল আমাদের।”
“কিন্তু ভুলবশত সম্মেলনের তারিখ ছাড়া বিভিন্ন মাধ্যমে প্রেস রিলিজটি শেয়ার হয়ে গেছে। এতেই বিভ্রান্তি হয়েছিলো এবং সেখানে কিছু ঘটনা ঘটেছিলো। আমরা এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য শিক্ষার্থীসহ সকলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি।”
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন বলেন, “কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের আশপাশে কিছু সুবিধাভোগী লোক আছে। মূলত তাদের কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ওই চক্রটি ছাত্রলীগকে বিতর্কিত করতে চায়।”
“আমাদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলমান সমস্যার বিষয়টি জানতে পেরে এরই মধ্যে গণমাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত হয়নি, এখনো বহাল আছে।”
ছাত্রলীগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে তাতে প্রশাসনেরও ব্যর্থতা দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মামুন।
তিনি এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ঘটনায় পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরেছে, হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালালেও তাদেরকে কিছুই করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শেষ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের তারা দুর্ভোগে ফেলেছেন।”
তবে এ ধরনের অভিযোগ মানতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, “শিক্ষার্থীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে অনেক কথাই বলতে পারে। তবে আমি মনে করি, আমরা ব্যর্থ নই। কারণ আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিলো ঘটনার সময় দুই পক্ষের সংঘাত এড়ানো, যেটাতে আমরা সফল হয়েছি।”
“সেদিনের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর তদন্ত কমিটি তাদের কাজ শুরু করে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রক্টর আরও বলেন, “কোনো বহিরাগত যেন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে পরিস্থিতি অশান্ত করতে না পারে, সেদিকে আমাদের নজর রয়েছে। কেউ এমন ঘটনা করতে চাইলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।”
প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা সৃষ্টির কারণে অনেক শিক্ষার্থী এখনও শঙ্কার মধ্যে আছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী।
তিনি বলেন, “ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরেন নেতাকর্মীরা। এরপর সেই ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়। কিন্তু এখনও কোনো অস্ত্র উদ্ধারের খবর শুনিনি। পুলিশ যদি এ বিষয়ে অনড় থাকে এবং অস্ত্র উদ্ধার করে তাহলে ক্যাম্পাসে কেউ হট্টগোল করতে বের হতো না ভয়ে।”
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার মো. আব্দুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য সম্ভব সব রকম কাজ করছি এবং করবো। তবে এই ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের সমন্বয় করতে হবে। বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের কিছু পরিকল্পনা আছে।”
শিক্ষার্থীরা জানান, শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে আট দিনের ছুটি ঘোষণা করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২ থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হলেও তার আগেই দুদিন শুক্র ও শনিবার হওয়ায় ৩০ সেপ্টেম্বর থেকেই ছুটি পায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
আরও পড়ুন:
ছাত্রলীগের উত্তেজনার পর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ, পরীক্ষা স্থগিত
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি ‘বিলুপ্তির’ খবরে ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মহড়া