Published : 28 Jun 2025, 02:02 PM
প্রায় ছয় কোটি ২০ লাখ টন ইলেকট্রনিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে ২০২২ সালেই। এই পরিমান বর্জ্য প্রায় ১৫ লাখেরও বেশি ট্রাকের ধারণক্ষমতার সমান। এ পরিমাণ ২০১০ সালের তুলনায় ৮২ শতাংশ বেশি ও ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এ বর্জ্যের পরিমাণ আট কোটি ২০ লাখ টনে পৌঁছাবে, যা পরিবেশের জন্য বড় এক হুমকি।
এসব ই-বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে পুরানো ল্যাপটপ ও ফোন, যেগুলোর ভেতরে সোনার মতো মূল্যবান উপাদান থাকে। তবে এদের মধ্যে ২৫ শতাংশেরও কম সোনা সঠিকভাবে সংগ্রহ ও পুনরায় ফিরিয়ে আনা যায়।
নতুন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা, যা নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে ই-বর্জ্য থেকে সোনা বের করে আনবে বলে দাবি তাদের। এ পদ্ধতিটি ডিভাইস থেকে প্রচলিত সোনা বের করে আনার চ্যালেঞ্জকে বদলে দিতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্ট।
বিজ্ঞানীদের নতুন সোনা নিষ্কাশন পদ্ধতিটি কেবল ই-বর্জ্য থেকে সোনা সংগ্রহের ক্ষেত্রেই নয়, বরং ছোট পরিসরে খনি থেকে সোনা তোলার বেলাতেও মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারে বলে দাবি তাদের।
গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘নেচার সাসটেইনএবিলিটি’তে।
সোনার বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি
বহু শতাব্দী ধরে মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে সোনা। দীর্ঘকাল ধরে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সোনা, আবার নারীদের সাজসজ্জার মাধ্যম হিসেবেও বিস্তৃত পরিসরে সোনার ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানেও ইলেকট্রনিকস শিল্পে, যেমন– মোবাইল, কম্পিউটারের সার্কিট বোর্ডে, রাসায়নিক শিল্পে এবং উড়োজাহাজ ও মহাকাশ প্রযুক্তিতে সোনার ব্যবহার রয়েছে।
তবে গোটা বিশ্বে সোনার প্রতি বৈশ্বিক চাহিদা দ্রুত বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি খনি থেকে সোনা উত্তোলনের বিষয়টি পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে।
সোনা উত্তোলনের ক্ষেত্রে বন উজাড় ও বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার– এ দুটিই হচ্ছে সমস্যা। বড় পরিসরের খনি থেকে সোনা উত্তোলনের জন্য প্রচুর পরিমানে অত্যন্ত বিষাক্ত সায়ানাইড ব্যবহৃত হয়। সায়ানাইড সময়ের সঙ্গে ক্ষয় হয়ে গেলেও এর ব্যবহার বন্যপ্রাণীর ক্ষতি করতে পারে এবং ‘টেইলিংস ড্যাম’ বা যেখানে খনির বিষাক্ত বর্জ্য সংরক্ষিত থাকে তা পরিবেশের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করে।
ছোট পরিসর ও কারিগরি খনিতে প্রচলিত উপায়ে সোনা উত্তোলনের জন্য পারদেরও ব্যবহার হয় অনেক। এ পদ্ধতিতে সোনা পারদের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ঘন এক অ্যামালগাম তৈরি করে, যেটি সহজেই আলাদা করা যায়। এরপর অমলগামকে গরম করে পারদ বাষ্পীভূত করলে সোনা বেরিয়ে আসে।
সোনা উত্তোলনের নিরাপদ উপায়
‘ফ্লিন্ডার্স ইউনভিার্সিটি’র রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক জাস্টিন এম. চ্যালকার বলেছেন, “আমাদের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে গঠিত আন্তঃবিভাগীয় দল নতুন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে, যা খনিজ ও ই-বর্জ্য থেকে সোনা বের করতে পারে। এ পদ্ধতির লক্ষ্য হচ্ছে, সোনা উত্তোলনের ক্ষেত্রে পারদ ও সায়ানাইডের নিরাপদ এক বিকল্প উপায় দেওয়া এবং মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ক্ষতি কমিয়ে আনা।”
এর আগে, খনিজ বা ই-বর্জ্য থেকে সোনা নিষ্কাশনের জন্য পারদ ও সায়ানাইড ছাড়া অনেক পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। তবে ওইসব পদ্ধতির অনেকগুলোরই রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। যেমন– ধীর গতি, ছোট পরিসরে প্রয়োগ ও বেশি খরচ। অনেক সময় এসব পদ্ধতিতে সোনা পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কেবল একটি ধাপের দিকেই মনোযোগ দিয়েছে। এক্ষেত্রে পুনঃব্যবহার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি প্রায়ই উপেক্ষিত থেকেছে।
এর বদলে, নতুন এ পদ্ধতিতে সোনা নিষ্কাশন, পুনরুদ্ধার ও পরিশোধনের পুরো প্রক্রিয়াজুড়েই স্থায়িত্বের বিষয়টিও বিবেচনায় রেখেছেন গবেষকরা। তাদের উদ্ভাবিত নতুন সোনা উত্তোলন পদ্ধতিতে ‘ট্রাইক্লোরোইসোসায়ানুরিক অ্যাসিড’ নামের এক রাসায়নিক উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে, যেটি সাধারণত পানি বিশুদ্ধকরণ, যেমন– খাবার পানিতে বা সুইমিং পুলে জীবাণু মারতে ব্যবহৃত হয়।
গবেষকরা বলছেন, সহজে মেলে ও কম খরচের এ রাসায়নিক উপাদানটি লবণ পানির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে তা সোনাকে এমনভাবে ভেঙে ফেলে যে, পানির সঙ্গে সোনা মিশে যায়। এরপর সেখান থেকে সোনা সহজে ও নিরাপদে আলাদা করা সম্ভব।
অধ্যাপক চ্যালকার বলেছেন, দ্রবণের ভেতর থেকে সোনা পুনরুদ্ধার করতে আমরা সালফারসমৃদ্ধ ‘পলিমার সোরবেন্ট’ উদ্ভাবন করেছি। পলিমার সোরবেন্ট এমন এক ধরনের পদার্থ, যা তরল বা গ্যাস থেকে নির্দিষ্ট কোনও উপাদানকে আলাদা করে তুলে নিতে পারে। আমরা এক ধরনের মৌলিক রাসায়নিক অংশ দিয়ে সোরবেন্টটি বানিয়েছি, যেটি চেইন বিক্রিয়ার মাধ্যমে একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত হয়ে শক্তিশালী এক পলিমারে পরিণত হয় এবং সেই চেইনই সোনাকে ধরে ফেলে।
এ পলিমার সোরবেন্টটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক সালফার থেকে, যা সাশ্রয়ী ও সহজে পাওয়া যায় এমন এক কাঁচামাল। তেল শিল্পে এত বেশি পরিমাণে সালফার তৈরি হয় যে, এর বেশিরভাগ ব্যবহার বা বিক্রি করাই যায় না। ফলে গবেষকদের তৈরি এ পলিমার সালফারের এ অপচয়কেই কাজে লাগিয়ে নতুন উপায়ে ব্যবহার করছেন।
অধ্যাপক চ্যালকার বলেছেন, আমাদের তৈরি পলিমারকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, কোনো উপাদানের মিশ্রণ থেকে এটি সোনাকে নির্দিষ্টভাবে চিনে নিতে ও ধরতে পারে। এমনকি দ্রবণে আরও অনেক ধরনের ধাতু মিশ্রিত থাকলেও।
নতুন এ সহজ ও পুনরুদ্ধার পদ্ধতিটি খনিজ পদার্থ, পুরানো কম্পিউটার থেকে নেওয়া সার্কিট বোর্ড ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার বর্জ্যে প্রয়োগ করেছেন গবেষকরা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে গবেষকরা এমন পদ্ধতিও তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে সোনাকে দ্রবণে পরিণত করে পুনঃব্যবহার করা যায়, পলিমার সোরবেন্টও পুনরায় ব্যবহার করা যাবে এবং এ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত পানিও পরিশোধন ও পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব।
অধ্যাপক চ্যালকার বলেছেন, পুনঃব্যবহারযোগ্য পলিমার সোরবেন্ট তৈরি করতে গিয়ে আমরা কিছু নতুন ও রোমাঞ্চকর রাসায়নিক প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছি, যেখানে আলো ব্যবহার করে পলিমার তৈরি করা যায় ও সোনা ধরে ফেলার পর পলিমারটিকে আবার ভেঙে আগের অবস্থায়, অর্থাৎ এর মূল গঠনেও ফেরানো যায়। এ পদ্ধতিতে সোনা ও পলিমার আলাদা করা সম্ভব এবং পলিমারকে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগীও করে তোলা যাবে।
এভাবে সোনা আলাদা করার পর পলিমারটিকে ভেঙে ফেলা হয় ও আবার নতুন পলিমার বানাতেও ব্যবহার করা যায় এটিকে। এভাবে উপাদান বারবার ব্যবহারের ফলে কোনো কিছু অপচয় হয় না। এ পুরো প্রক্রিয়াটি ‘সার্কুলার ইকোনমি’ বা বৃত্তাকার অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক উদাহরণ।
ই-বর্জ্য থেকে সোনা সফলভাবে ফিরিয়ে আনা গেলে খনি থেকে সোনা উত্তোলনের প্রয়োজন কমে আসবে। ফলে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবও কমবে।