Published : 20 May 2024, 01:25 PM
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার দেশটির পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে বিধ্বস্ত হওয়ার পর তার মৃত্যু হয়েছে। তার সঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দোল্লাহিয়ান ও আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তারও মৃত্যু হয়েছে।
রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী ৬৩ বছর বয়সী রাইসিকে দীর্ঘদিন ধরে ইরানের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির স্বাভাবিক উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল।
কট্টরপন্থি ও ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল রাজনীতিক রাইসির সঙ্গে বিচার বিভাগ ও ধর্মীয় অভিজাতদের গভীর সংযোগ ছিল। ২০১৭ সালে তিনি প্রথম ইরানের প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হয়েছিলেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। পরে ২০২১ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
প্রাথমিক দিনগুলো
ইরানের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজাভি খোরসান প্রদেশের প্রধান শহর মাশহাদে ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইব্রাহিম রাইসি নামে পরিচিত সৈয়দ ইব্রাহিম রাইসুলসাদাতি।
তিনি ১৫ বছর বয়সে বিখ্যাত কওম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তারপর থেকে ওই সময়ের বেশ কয়েকজন মুসলিম পণ্ডিতের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন।
বয়স ২০ ছাড়ানোর পর তিনি পরপর কয়েকটি শহরে অভিশংসক হিসেবে নিযুক্ত হন। পরে উপ-অভিশংসক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে রাজধানী তেহরানে যান।
১৯৮৩ সালে তিনি মাশহাদের জুম্মার ইমাম আহমেদ আলমলহোদার কন্যা জামিলেহ আলমলহোদাকে বিয়ে করেন। তাদের দুইজন কন্যা সন্তান আছে।
১৯৮৮ সালে পাঁচ মাসের জন্য তিনি বিচার বিভাগীয় একটি কমিটির অংশ ছিলেন। এই কমিটি রাজনৈতিক বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ধারাবাহিক এক প্রক্রিয়ার তদারকি করেছিল। এই ভূমিকার কারণে তিনি ইরানের বিরোধীদলগুলোর মধ্যে অজনপ্রিয় হয়ে উঠেন আর যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর ১৯৮৯ সালে তিনি তেহরানের অভিশংসক নিযুক্ত হন।
পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুলাহ খামেনির অধীনে রাইসির ক্রমপদোন্নতি হতে থাকে। ২০১৬ সালের ৭ মার্চ তিনি ইরানের দ্বিতীয় জনবহুল শহর মাশহাদের বৃহত্তম ধর্মীয় অনুদান সংস্থা আস্তান কুদস রাজাভির চেয়ারম্যান হন। এই পদ ইরানের ক্ষমতার বলয়ে তাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
২০১৭ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রার্থী হয়েছিলেন রাইসি। ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। রুহানি পুনর্নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন। ২০১৫ সালে বিশ্ব শক্তিগুলোর সঙ্গে ইরানের যে পারমাণবিক চুক্তি হয়েছিল তা তত্ত্বাবধান করেছিলেন রুহানি। ওই চুক্তি অনুযায়ী ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার বিনিময়ে নিজেদের পারমাণবিক কর্মসূচী সীমিত করেছিল তেহরান।
ইরানের রাজনৈতিক পদ্ধতিতে রুহানি মধ্যপন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ২০১৫ সালের চুক্তির সমালোচক রাইসি এসেছিলেন আরও কট্টরপন্থি অংশ থেকে।
নির্বাচনে পরাজিত রাইসি তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার পরিকল্পনা তখনই শুরু করে দিয়েছিলেন। ২০২১ সালের জুনে ৬২ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
ইতোমধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্র ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে বের হয়ে গিয়েছে আর তাতে চুক্তিটি নড়বড়ে হয়ে যায়। ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে জারি করা নিষেধাজ্ঞাগুলো পুনর্বহাল করলে ইরানের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তার মধ্যে কোভিড-১৯ মহামারীর হানা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তোলে, ২০২১ সালের অগাস্টের মধ্যে ইরানে মৃতের সংখ্যা ৯৭ হাজার পার হয়ে যায়।
সংযোগ
ইরানের ধর্মীয় ক্ষমতাবলয়ের দৃঢ় আস্থার পাত্র ছিলেন রাইসি। ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ নেতা রুহুল্লাহ খোমেনির সঙ্গে তার সম্পর্ক যেমন দৃঢ় ছিল পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা খামেনির সঙ্গেও তাই ছিল।। খামেনি তাকে বেশ কয়েকটি জ্যেষ্ঠ পদে নিয়োগ করেছিলেন।
রাইসি সরকারের সবগুলো শাখা, সামরিক বাহিনী ও আইনসভার পাশাপাশি প্রভাবশালী ধর্মতান্ত্রিক শাসক শ্রেণির সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এসব সত্ত্বেও রাইসিকে ব্যাপক জনরোষের মোকাবেলা করতে হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে জীবনযাত্রার নিম্নমুখি মানের কারণে জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো থেকে প্রতিরক্ষা খাতে বেশি জোর দেওয়ায় এমনটি ঘটেছিল বলে দাবি সমালোচকদের।
২০২২ সালের শেষ দিকে ইরানের নীতি পুলিশের হেফাজতে তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যু হলে গণঅসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটে। কয়েক মাস ধরে ইরানজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলতে থাকে। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি এসে বিক্ষোভ স্তমিত হয়ে আসে, কিন্তু এরমধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর দমনপীড়নে কয়েকশ মানুষের মৃত্যু হয়। এই অস্থিরতায় ভূমিকা থাকার অভিযোগে সাতজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
চলতি বছরের মার্চে জাতিসংঘের একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন তাদের সিদ্ধান্তে জানায়, ওই দমনপীড়নের সময় খুন, নির্যাতন ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনা ঘটেছে।
অচলাবস্থা
রাইসি আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতেও জড়িয়ে ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর তাতে স্বাক্ষর করা অন্য পক্ষগুলো সেটি রক্ষা করতে অসমর্থ হওয়ায় রাইসি ক্ষুব্ধ হন। প্রতিবাদে তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচী বিস্তৃত করার ঘোষণা দেন, কিন্তু তারা পারমাণবিক বোমার বিষয়ে আগ্রহী নন বলে জানান।
সম্প্রতি ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা নিয়ে দেশটির সঙ্গে ইরানের উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এ সময় ইসরায়েলের সঙ্গে চলা অচলাবস্থার মধ্যে দেশকে নেতৃত্ব দেন রাইসি। ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের ওপর ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার নিন্দা করতে থাকে ইরান, পাশাপাশি 'প্রতিরোধ অক্ষ’ হিসেবে পরিচিত ইরানের আঞ্চলিক মিত্ররা ইসরায়েল ও এর পশ্চিমা মিত্রদের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠে।
এপ্রিলের প্রথমদিকে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনসুলার ভবনে চালানো এক হামলায় দেশটির শীর্ষ কমান্ডার ও তার সহকারীসহ সাতজন নিহত হয়। এ হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে ইরান।
ইরান ইসরায়েলে পাল্ট হামলা চালাবে, এমন সম্ভাবনাকে সামনে রেখে পুরো বিশ্ব প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে রাইসির উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যকে নিরীক্ষণ করতে থাকে। এরপর ১৫ এপ্রিল ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ইসরায়েলের মুখ্য সামরিক মুখপাত্র দানিয়েলে হ্যাগারি জানান, ১২০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ১৭০টি ড্রোন ও ৭০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আক্রমণ চালিয়েছে ইরান।
তবে অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের সীমান্তে বাইরে ধ্বংস করে দেওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি সীমিত থাকে।
রাইসির সময়ে ইরানের আরেক আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবের সঙ্গে তেহানের কূটনৈতি সম্পর্ক পুনর্স্থাপিত হয়। এ সময় ইউক্রেইন যুদ্ধে রাশিয়ার দৃঢ় সমর্থক ও অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবেও ইরান আলোচিত হয়।
দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে ও ধারাবাহিক বৈদেশিক নীতি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাইসি নিজেকে একজন বিতর্কিত কিন্তু বহুমুখি প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রমাণ করেন।
ইরানের ক্ষমতার বলয়ের সব স্তরের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণে তিনি নিজেকে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্যও একজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। এ অগ্রযাত্রা বজায় থাকলে হয়তো একসময় তিনি দেশটির সর্বোচ্চ নেতার পদেরও দাবিদার হয়ে উঠতেন।
আরও পড়ুন:
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানি প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মৃত্যু