Published : 19 Jan 2016, 03:12 PM
সম্প্রতি ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসের কূটনীতিক ফারিনা আরশাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে বসে জঙ্গি সম্পৃক্ততার কারণে বাংলাদেশের অনুরোধে তাকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং কিছুদিনের মধ্যে ফিরতি প্রতিশোধের নমুনাস্বরূপ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে প্রত্যাহার করতে বাংলাদেশকে অনুরোধ ও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দুদিনের মধ্যে তা পালন করে ফেলার একটা নাটক প্রত্যক্ষ করলাম আমরা। বাংলাদেশি কূটনীতিক মৌসুমী রহমানের বিরুদ্ধে অবশ্য পাকিন্তান সরকার কোনো অভিযোগ বা কারণ আনেনি। শুধুমাত্র মৌখিক অনুরোধ ছিল। সেটি মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
পাকিস্তান যাই করুক, সব নাটকই মনে হয়। বিশেষত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নানা ইস্যুতে যে রকম দুঃসাহসী নাক গলায়, যে রকম বড় গলায় এত বড় ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত অপকর্ম অস্বীকার করে, এগুলো 'নাটক' আখ্যা না দিয়ে উপায় কী!
একাত্তরে বাংলাদেশিদের উপর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নৃশংস অত্যাচার চালানোর বিষয়টি এখন বিশ্বজনীনভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। তার ভুরি ভুরি তথ্যপ্রমাণ, দালিলিক উপস্থাপনা, বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের তখনকার সংরক্ষিত তথ্যাদি রয়ে গেছে। এখনও সে সময়কার সাংবাদিকরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে থেকে সব প্রতক্ষ করেছেন বা নিজ দেশে বসে বাংলাদেশের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি করেছেন, সে সব 'জীবন্ত দলিল' তাদের জীবনের বিভিন্ন সময়ে দেওয়া সাক্ষাতকারে পাকিস্তানের কুকমের্র স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরছেন।
বাংলাদেশর বুকে লক্ষ লক্ষ শহীদের সহস্রাধিক গণকবর, জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের শিউরে ওঠা জবানবন্দি এবং নারীদের উপর ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত নির্মম-নির্যাতনের চিত্র আজ বিশ্বব্যাপী সে কুৎসিত বীভৎস কর্মকাণ্ডের সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এত এত দালিলিক প্রমাণের পরও পাকিস্তান নামের দেশটি কীভাবে অস্বীকার করে যে, একাত্তরে তাদের দ্বারা বাংলাদেশে কোনো হত্যাযজ্ঞ হয়নি? হয়নি কোনো নারীর সম্ভ্রমহানি? বরং যা হয়েছে তা ছিল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নিজেদের 'বোঝাপড়া', ইন্দো-পাক জং! তার চেয়েও বেশি ঔদ্ধত্যের সঙ্গে পাকিস্তান বলে, "ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না!''
মুক্তিযুদ্ধের মানবতাবিরোধীদের বিচারকাজ যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে হচ্ছে, শুরু থেকেই পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে তার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালিয়েছে। সঙ্গতদাতারা ছিল সেই দেশগুলোরই কিছু লোক যারা একাত্তরে বাংলাদেশের জন্ম চায়নি, বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি দিতে পার করে দিয়েছিল বছরের পর বছর।
একের পর এক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন হচ্ছে। তবু সে দেশটির দিক থেকে আমরা ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে একের পর এক লম্বা লম্বা বিবৃতি, শোক প্রস্তাব, নিন্দা প্রস্তাব, ক্ষুব্ধ প্রস্তাব দেখতে পাচ্ছি। তাদের কাছে এ বিচার 'প্রহসন', 'হত্যাকাণ্ড'! এ বিচার তাদের প্রিয় দেশপ্রেমিকদের অন্যায়ভাবে মেরে ফেলার জন্য করা হচ্ছে!
আসলে 'ঢালাওভাবে' শুধুই পাকিস্তানিদের দোষারোপ করতে একটু 'খারাপ' লাগছে বৈকি! বিশেষত যখন দেখি আমাদের দেশের কিছু কিছু মানুষের মধ্যে রয়েছে অকৃত্রিম পাকিস্তান-প্রেম। প্রতি বছর জানুয়ারিতে ঢাকায় মাসব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা হয়। এ মেলায় এমন অনেকে যায় কেবল পাকিস্তানি পণ্য ক্রয় করবে বলে। এরা সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকে শুধুমাত্র এ মেলার জন্য।
ক্রিকেট খেলায় তো পাকিস্তান-প্রেমের উদাহরণ ভুরি ভুরি। সেই অতীতের ইমরান খান-প্রেম থেকে শুরু করে ওয়াসিম আকরাম, আমির সোহেল, আফ্রিদী, শোয়েব আখতার, মালিক, আকিব জাভেদ, হালের আরও অনেকের প্রতি বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীদের অকৃত্রিম প্রেম-ভালোবাসা আর গ্যালারিজুড়ে সাদা-সবুজ চাঁদ-তারার ঢেউ তাদের 'আপ্লুত' করে। তাদের বলাতে বাধ্য করে– তাদের হৃদয় থেকে উঠে আসে আবেগ– "বাংলাদেশে এলে মনেই হয় না অন্য দেশে আসি। মনে হয় নিজের দেশে আছি।" ওয়াসিম আকরাম তো বার বার অকুণ্ঠ চিত্তে বলে গেছেন, "বাংলাদেশ আমার সেকেন্ড হোম। বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা আমার ছোট ভাই।"
অন্যদিকে আমাদের পেসার শাহাদাত হোসেন, বর্তমানে শিশু নির্যাতন মামলায় যিনি কারাগার থেকে জামিনে আছেন, তিনি তো আরেক কাঠি সরেস। একবার বলেই ফেলেছিলেন, তাঁর স্বপ্ন শহীদ আফ্রিদির মতো হওয়া, খেলার মাঠের বাইরেও তার মতো অন্য রকম (!) জনপ্রিয়তা পাওয়া।
উঁহু! খেলায় রাজনীতি টেনে এনে ভুল করছি কিন্তু। খেলায় কাউকে সাপোর্ট করা দোষের কিছু নয়। কিন্তু নিজ দেশের সঙ্গেও যখন খেলায় পাকিস্তানের জয়টাই পরম কামনা করেন, তখন একে কোন প্রেম বলব? বিপিএলএ মুশফিকুরকে ভালো ক্যাপ্টেনসি না করার জন্য সরিয়ে দিয়ে ওই আফ্রিদিকেই ঝাণ্ডা ধরিয়ে দিতে হবে? আর কোনো বাংলাদেশি যোগ্য খেলোয়াড় কি ছিল না? অবশ্য আফ্রিদির ভূমিকাও দলের মালিকের মুখে হাসি ফোটাতে পারেনি।
প্রতি বছর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমায় অবধারিতভাবে পাকিস্তানি হুজুরের উর্দুতে দেওয়া বয়ান প্রধান থাকে। পাশাপাশি থাকে সামান্য বাংলায়, যেখানে মোট উপস্থিতির সিংহভাগ থাকেন বাংলাদেশিরা। এসব পাকিস্তান-প্রেম তাদের প্রতি মোহ দূর করে তাদের বিচার করার প্রক্রিয়া আরও পিছিয়ে দিচ্ছে বৈকি।
একাত্তরে যুদ্ধরত এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের হাতে বন্দি ১৯৫ পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে নিজ দেশে নিজেরা বিচার করবে বলে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া এবং পরে আর সেটি না করার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে।
সম্প্রতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত কোরীয় নারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয়েছে জাপান। জেনে অবাক হয়েছি, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে জাপানের মূল দ্বন্দ্বের দুটি প্রধান কারণের মধ্যে একটি ছিল এটি। অপরটি, নানজিংএর গণহত্যা।
এর আগে জাপান ১৯৯৩ সালে প্রথম স্বীকার করে যে, এশীয় নারীদের ওপর তাদের সেনারা ঘৃণ্য নিপীড়ন চালিয়েছিল। আর প্রায় সাত দশক পর এবার তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে। সেই যুদ্ধে নির্যাতিত 'কমফোর্ট উইমেন' উপাধিপ্রাপ্ত নারীদের ১০০ কোটি ইয়েন (৮৩ লক্ষ ডলার) ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয় জাপান।
['কমফোর্ট উইমেন'দের প্রসঙ্গে জাপানের দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ক্ষমা চাওয়ার খবরের লিংক দেখুন:
এখন ভাবুন তো, পাকিস্তানের বেলায় কোথায় রয়েছি আমরা, বাংলাদেশিরা? একাত্তর প্রশ্নে? মুক্তিযুদ্ধে নির্মম নির্যাতনের শিকার আমাদের দুলাখ মায়ের ওপর যে অন্যায় হয়েছে, তার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে পাকিস্তানকে।
মায়ের কাছে শোনা– গল্প নয়, সত্য– দুবছর বয়সী নাতির পেট বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে চিরে নাড়িভূড়ি বের করে দাদিকে দেখিয়ে ছেলের মুক্তিযুদ্ধে যাবার প্রতিশোধ নিয়েছিল পাকিস্তানি আর্মি অফিসার। মাকে ধর্ষণ করার পর কোলের তিন মাস বয়সী শিশুকে আছড়ে মেরে, বুট দিয়ে পিষে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনা। এ রকম হাজার হাজার শিশুহত্যার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে।
এক কোটির মতো মানুষকে শরণার্থী করে– না খেতে পেয়ে, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুসম জীবনের অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্যও পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে।
হিন্দু নারীদের জোর করে সিঁদুর মুছিয়ে দেওয়া, কলেমা পড়িয়ে ধর্মান্তরিত করা, ধর্মনির্বিশেষে পুরুষদের রাস্তায় কাপড় খুলে ১মুসলমান' কি না যাচাইয়ের মতো তীব্র অপমানজনক মানবতাবিরোধী আচরণের জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে।
চুয়াল্লিশ বছর পরও নিজ দেশের একের পর এক নতুন প্রজন্মের কাছে পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে ১৯৭১এর পূর্ববর্তী, ১৯৭১কালীন এবং পরবর্তীকালের বিকৃত, ভুল ও বাংলাদেশ সম্পর্কে অমর্যাদাকর মিথ্যা ইতিহাস শিখিয়ে বাংলাদেশকে অপমান করার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে।
নিজ নিজ দেশের দূতাবাসের কূটনীতিকদের নিয়ে যে নাটক আমরা দেখেছি সর্বশেষ, তখনও দাবি উঠেছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের সঙ্গে অ্যাকাডেমিক সম্পর্ক রাখবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার পর্যবেক্ষণমূলকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চালিয়ে যাবার কথা বলেছে।
খোদ পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ ও সচেতন ব্যক্তিরা অনেক কাল ধরে একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানের ভূমিকার বিষয়ে ক্ষমা চাওয়া নিয়ে সোচ্চার। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে পাকিস্তানের মায়া এবং সে দেশের বুদ্ধিজীবী মহলের স্টেইটমেন্ট এটাই প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, পাকিস্তান আসলেই নিকৃষ্টতম অন্যায় করেছে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কাছে বাংলাদেশ ক্ষমা চাওয়ার দাবিদার।
পাকিস্তানের অপরাধ তো আসলে বহুমাত্রিক। নানা ভাবে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে তারা বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রাটর বিরুদ্ধে। গণমাধ্যমে কিছু দিন পর পর বিদেশি মুদ্রা এবং জাল মুদ্রা পাচারের বড় বড় যে খবর পাওয়া যায় তার সবই পাকিস্তানি নাগরিকদের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশে বসে দূতাবাসের উচ্চ পর্যাযের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন পাকিন্তানি কূটনীতিকের পক্ষে কীভাবে জঙ্গিবাদে সহায়তা দানের অভিযোগ আসে? তবে কি কোনো দুর্বল মুহূর্তের অপেক্ষায় আছি আমরা যার অবসরে পাকিন্তানের ইন্ধনে আরও বড় কোনো নাশকতা ঘটবে?
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে বাংলাদেশের গায়ে যতটুক না আঁচ লাগবে, তার চেয়ে বড় ক্ষতি হবে ওদের। প্রতি বছর কত জন বাংলাদেশি ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্যান্য কারণে পাকিস্তানে যান আর তার বিপরীতে কত হাজার পাকিস্তানিকে শিক্ষা, বাণিজ্যসহ আরও অসংখ্য কাজে বাংলাদেশে আসতে হয়, সে হিসাব নিলেই বোঝা যাবে।
সব কিছুর পরেও, একজন নারী হিসেবে কেবল একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের চালানো নারীনিপীড়নের ঘটনাগুলোর জন্যও দেশটিকে কখনও ক্ষমা করা যায় না। যতদূর জানি, ইতিহাসে আর কোনো যুদ্ধে বিপক্ষ শক্তির দ্বারা আর কোনো দেশের নারীদের এত নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়নি। ড. নীলিমা ইব্রাহিমের 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি' বইটির পাতা থেকে উঠে আসা নারীদের ভাষ্যে যে নৃশংস অত্যাচারের মর্মন্তুদ বিবরণ দেখা যায়, শুধুমাত্র এ অপরাধের কারণেও তো তাদের হাজার বার ফাঁসি দিতে চাওয়ার মতো তীব্র আক্রোশ জমে মস্তিষ্কে।
পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতেই হবে। সেটাই হোক আমাদের রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার।