Published : 31 Dec 2014, 05:36 PM
অনেক ছোটবেলা হইতেই আসহাব উদ্দীন আহমদের নাম শুনিতেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার–এ জীবনে তাঁহার সহিত কোনদিন দেখা হইল না। তিনি এন্তেকাল করিয়াছেন ১৯৯৪ সালে। দেখিতে দেখিতে আজ বিশ বছর হইয়া গেল। বাঁচিয়া থাকিলে এ বছর তাঁহার বয়স একশত বছর হইত। কিন্তু যতদূর জানি–এই দেশ–বিশেষ এই দেশের ধুরন্ধর সমাজ তাঁহাকে তাঁহার প্রাপ্য কদর বুঝাইয়া দেয় নাই। পরিবারের বাহিরে কোথাও কেহ তাঁহার শতবর্ষ পালন করে নাই।
১
আসহাব উদ্দীন আহমদ জীবনের প্রথম ভাগে পেশা হিশাবে শিক্ষকতার ব্রত গ্রহণ করিয়াছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি কুমিল্লায় শিক্ষক হিশাবে কর্মরত ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শাসক-শোষক শ্রেণীর কাণ্ডকারখানা দেখিয়া দিনের পর দিন তাঁহার মনে অসন্তোষ জমিয়া উঠিতেছিল। শিক্ষকতার সংকীর্ণ জীবন তাঁহার লাগিতেছিল বিস্বাদ। তাঁহার ভাষায়, '[শোষিত] জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যারা বৃহত্তর সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন তাঁদের পেছনের কাতারে গিয়ে দাঁড়ানোর এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা আমাকে পেয়ে বসেছিল। ভাষা আন্দোলন আমাকে ধাক্কা মেরে শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজনীতির অঙ্গনে পার করিয়ে দেয়।' (আহমদ ২০০৪: ৩১) তাহার পর প্রায় তিরিশ বছর তিনি একাধারে পেশাদার রাজনীতিবিদের, অন্যধারে লেখকের জীবন যাপন করিয়াছেন। তাহার মধ্যে পনের বছর আবার আত্মগোপনের রাজনীতি। শেষ জীবনে তিনি প্রচলিত রাজনীতির উপর বীতশ্রদ্ধ হইয়াছিলেন। শেষ জীবনের প্রায় পনের বছর তিনি ছিলেন শুদ্ধ একান্ত লেখক।
শেষ বয়সে তিনি অনেক উন্নতিশীল লেখকের সঙ্গে যুক্ত হইয়া নিজের একান্ত সাধনাকে আরো সংবর্ধিত করিয়াছিলেন। এই পর্বেই একদিন তিনি অধুনা পরলোকগত আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সহিতও পরিচিত হইলেন। ইলিয়াস তাঁহার সম্পর্কে দুইটি সত্য কথা শুনাইয়াছেন আমাদের।
লেখক পরিচয়ে আসহাব উদ্দীন আহমদ কোন জায়গায় বিশিষ্ট? ইলিয়াস বলিতেছেন, "আসহাব উদ্দীন আহমদ তাঁর বক্তব্য প্রকাশের জন্য কথা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত কোন মাধ্যমের কাছে হাত পাতেননি। টুকরো টুকরো ঘটনাকে কাহিনীর বিন্যাসে তিনি গাঁথেন না, সিকোয়েন্সের আড়ালে থেকে কোন ছবিকে সামনে ঠেলে দিতে তাঁর ঘোরতর আপত্তি, কোন চরিত্রকে নিজের মুখপাত্র হিসাবে নিয়োগের অভ্যাসও তাঁর নেই, তিনি নিজেই নিজের কথা বলেন।" তাঁহার বিষয়ে ইলিয়াসের দ্বিতীয় মন্তব্যও মনে সমানে দাগ কাটিতেছে। ইলিয়াসের মতে, "কোন পরিচিত কাঠামোর ভেতর না গিয়েও আসহাব উদ্দীন পাঠককে যে আকৃষ্ট করতে পারেন তার প্রধান কারণ তাঁর কৌতুক ও ব্যঙ্গ এবং হাস্যরস। তাঁর রচনা আগাগোড়া কৌতুক ও ব্যঙ্গরসে পূর্ণ।" (ইলিয়াস ২০১৩: ১১২-১১৪)
আসহাব উদ্দীন আহমদের অপর অনুরাগী আরও পরে পরলোকগত আহমদ ছফা। তিনিও তাঁহার ঋণ শোধ করিয়াছেন এই কায়দায়: "তাঁর বাড়ি বাঁশখালি থানায়–আমাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। ছোটবেলায় তাঁর কথা শুনে কমিউনিজমের প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলাম।" আসহাব উদ্দীন আহমদ যে বছর ইহলোক ছাড়িলেন সেই বছরের গোড়ার দিকে আহমদ ছফা কিছু অধিক স্মরণ করিয়াছিলেন: "আসহাব উদ্দীন আহমদ সাহেবকে আমি প্রথম দেখি আমাদের গ্রামে ন্যাপের জনসভায় বক্তৃতা দিতে। তাঁর সেই বক্তৃতাটি এখনো (মানে ঘটনার প্রায় চল্লিশ বছর পরও) মনে আছে। সেদিন তিনি আমাদের বাড়িতে খেয়েছিলেন।" দুর্ভাগ্যের কথা, আহমদ ছফাও তাঁহার সাহিত্য-বহির্ভূত লেখার বিশেষ কদর করেন নাই। হয়তো তিনি গূঢ় সত্যের দিকে অঙ্গুলি দেখাইতেছিলেন। তিনি বলিয়াছেন, "তাঁর লেখা 'ধার' বইটি ভাল লেগেছিল। পরের লেখাগুলো কোন কাজের জিনিশ নয়। তবে মানুষ হিসেবে তিনি খুব সজ্জন ছিলেন।" (ছফা ২০০৮: ৩৬৩-৬৪)
আমি সামান্য মানুষ। আহমদ ছফার সহিত বিবাদ করা আমার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। তবু সবিনয়ে শুদ্ধ একটা কথা নিবেদন করিতেছি–আসহাব উদ্দীন আহমদের জীবনস্মৃতি গোত্রের কিছু লেখা আছে। এইগুলি কিন্তু খুব কাজের জিনিশ হইয়াছে। সাহিত্য হিশাবে না হৌক, সত্য হিশাবে। বিশেষ করিয়া গত একশত বছরে বাঙ্গালি মুসলমান সমাজের যোগ্যতা আর উদ্বর্তনের কাহিনী যাঁহারা পরিহার করিতে চাহেন না (অর্থাৎ আমল করিতে চাহেন) তাঁহারা এখানে কিছু পোষ্যোচিত ভালমন্দ খোরাকও পাইবেন। আসহাব উদ্দীন আহমদ নামক একজন মানুষকে বুঝিতে পারিলে লাভ আছে, সন্দেহ নাই। গত একশত বছরে বাংলাদেশে যাহা ঘটিয়াছে তাহা বুঝিতে পারিলে আরও গুরুতর লাভ। আমি নগণ্য ছাত্র হিশাবে এখানে লিখিয়া দিতেছি, আসহাব উদ্দীন আহমদের কয়েক খণ্ড জীবনস্মৃতি পড়িয়া আমিও অনেকদূর শিক্ষালাভ করিয়াছি। সেই কথা পর্বে পর্বে বলিতে হইবে। আজ শুদ্ধ প্রথম পর্ব বলিলাম।
২
আসহাব উদ্দীন আহমদের জন্ম মোটামুটি সচ্ছল এক কৃষক পরিবারে। এই পরিবার গৌড় হইতে চট্টগ্রামে আসিয়া বসত স্থাপন করিয়াছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীতে। মোগল বাদশাহ শাহজাহানের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্রদের মধ্যে গৃহবিবাদের যুগে। এই পরিবারের এক শাখা বাঁশখালি উপজেলার সাধনপুর গ্রামে আর এক শাখা চট্টগ্রাম শহরের কাট্টলি পাড়ায় কায়েম মোকাম হইয়াছিল।
বাবার কথা বলিতে গিয়া আসহাব উদ্দীন আহমদ লিখিয়াছেন, "আমাদের গ্রামের পূর্বদিকে পাহাড়। এ পাহাড় গোটা থানার উত্তর সীমা থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পাহাড় বাঁশখালি ও সাতকানিয়া উপজেলার মাঝখানে অবস্থিত, উভয় জেলার বিভক্তিরেখা স্বরূপ। পাহাড়ের যে অংশ আমাদের গ্রামের পূর্বদিকে অবস্থিত, সেখানে ইংরেজ সাহেবের চা বাগান ছিল। বাবা ছিলেন চা বাগানের ম্যানেজার। সৎ লোক বলে বাবার সুখ্যাতি ছিল। এ জন্য সাহেবও তাঁকে খুব সম্মান করতেন।" একটু পরে তিনি আরো লিখিয়াছেন: 'বাবার কাজকর্মে সাহেব এত সন্তষ্ট ছিলেন যে, বিলেত চলে যাওয়ার সময় এই পাহাড় তিনি অল্প সালামিতে দশ বছরের জন্য বাবাকে বন্দোবস্ত দিয়ে যান। এতে আমাদের পরিবারের আর্থিক জীবনে দ্রুত আশাতীত উন্নতি লাভ ঘটে। পাহাড়ের আয় থেকে বহু জায়গা-জমি কিনে বাবা একজন জোতদারে পরিণত হন।" (আহমদ ২০০৪: ৫১-৫২)
আসহাব উদ্দীন আহমদের জীবনে বাবার ছায়া দীর্ঘ হইয়া পড়িয়াছিল। তাঁহার একটা ইশারা এই রকম: "বাবার জীবনে প্রচুর অর্থাগম হয়েছিল। কিন্তু তাঁর অর্থলোভ ছিল না। দীর্ঘ দশ বছর এই পাহাড় বন্দোবস্ত সূত্রে বাবার মালিকানায় ছিল। তিনি কোনদিন গ্রামের লোক থেকে লাকড়ি কাটা, গরু ছাগল চরানোর জন্য কোন ট্যাক্স নিতেন না।" (আহমদ ২০০৪: ৫৪)
আসহাব উদ্দীন আহমদের জীবনে মায়ের প্রভাবও কম নহে। তিনি লিখিয়াছেন, "আমার নানার বাড়ি ছিল পার্শ্ববর্তী সাতকানিয়া উপজেলার আলিনগর গ্রামে। নানা মুন্শী নাদেরুজ্জামান ছিলেন ফার্সি উকিল। মনে করি যে, তিনি যখন ওকালতি শেখেন তখন ফার্সিই অফিস আদালতের ভাষা ছিল। মা অত্যন্ত দয়ালু মহিলা ছিলেন। পরের দুঃখে তাঁর হৃদয় গলে যেত। দুঃস্থ ও বিপন্নকে তিনি যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি পাড়ার গরিব-দুঃখী মানুষ বিশেষ করে অসহায় বিধবাদের বলে দেন, খবরদার, উপোস থেকো না। আমার দু'ছেলে রুজি রোজগার করছে।" (আহমদ ২০০৪: ৫৭)
আসহাব উদ্দীন আহমদ লিখিয়াছেন, 'আমাদের গ্রামের লোকসংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য অংশ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। নানা দিক থেকে তুলনামূলকভাবে অগ্রসর হিন্দু সমাজের আচার-আচরণ, রীতিনীতি আমরা অনগ্রসর মুসলমানরা অনুসরণ অনুকরণ করতাম। এমনকি এক সময় এ দেশের সর্বত্র ভদ্রস্থানীয় মুসলমানরা ঘরে লুঙ্গি পরলেও অফিস-আদালতে, স্কুল-কলেজে, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার সময় ধুতি পরতেন। সে হিসেবে জন্মের পর ব্রাহ্মণ ডেকে নবজাতকের কোষ্ঠী তৈরি করান আমাদের পরিবারে রেওয়াজ ছিল। কিন্তু যে সব এলাকা একচেটিয়া মুসলমান অধ্যুষিত ছিল সে সব এলাকায় মুসলমানরা ব্রাহ্মণ ডেকে কোষ্ঠী লিখাত না।' যে বছর আসহাব উদ্দীন আহমদ জন্মগ্রহণ করেন তাহার চারি কি পাঁচ বছর পর তাঁহাদের গ্রামে একবার আগুন লাগে। তাহাতে অন্যান্য সবকিছুর সহিত তাহার কোষ্ঠীটাও পুড়িয়া ছাই হইয়া যায়। ফলে ঠিক কত তারিখে বা কি বারে তাঁহার জন্ম হইয়াছিল তাহা আর জানিবার উপায় ছিল না। জীবনস্মৃতির এক জায়গায় তাই তিনি লিখিয়াছেন, "পরবর্তীকালে পাড়ার বয়স্ক লোকদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে জেনেছি যে, আমার জন্ম ১৯১৪ সালের এপ্রিল মাসের কোন এক দিনে।" (আহমদ ২০০৪: ৩৩)
এই আগুন লাগার ঘটনায় শুদ্ধ কোষ্ঠীটাই পুড়িয়া যায় নাই, যে নবজাতকের ভাগ্যে কোষ্ঠী তৈরি করানো হইয়াছিল সেই নবজাতকও পুড়িয়া মরিতে বসিয়াছিল। মায়ের কারণেই সেবার তাঁহার প্রাণ রক্ষা পায়। আগুন লাগার ঘটনাটি তিনি সবিস্তার বয়ান করিয়াছেন। শ্রুতলিপিটা ভালই লিখিয়াছেন তিনি: "মাটির দেয়ালের ঘর। ওপরে মাটির ছাদ। অর্থাৎ বাঁশের বেড়া দিয়ে তার ওপর মাটি লেপে দেয়া হয়েছিল। আগুন লাগাতে সবাই ঘরের দরজা বন্ধ করে দৌড়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। আর পানি ছুঁড়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিল। ঘরের ছনের ছাউনি জ্বলে ভেঙে ভেঙে পড়ছিল। এ সময় আমার মা চিৎকার দিয়ে ওঠেন: আমার ছেলে কই? আগুন লাগাতে দিশেহারা হয়ে তাড়াহুড়ো করে তারা সবাই আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় ফেলে বাইরে চলে এসেছিল।" (আহমদ ২০০৪: ৩৭)
বাড়ির একজন মৌসুমি দিনমজুরের বুদ্ধি ও সাহসের সুবাদে সেদিন একটি মাসুম শিশুর প্রাণ বাঁচে। ইহার পর আসহাবের বাবা নিয়ত করিলেন, এই শিশুকে তিনি আরবি শিক্ষায় শিক্ষিত করিবেন, মৌলবি বানাইবেন। আসহাব উদ্দীন আহমদ লিখিয়াছেন, "আল্লাহতালার অপার কৃপায় যার জীবন রক্ষা পেয়েছে, তার আল্লাহ এবং ইসলামের সেবায় জীবন কাটানোই শ্রেয় হবে। তাছাড়া তখনকার দিনে লোকের ধারণা ছিল কোন লোক আলেম হলে তিনি হাশরের ময়দানে আল্লাহতালার কাছে সুপারিশ করে সাতপুরুষকে (generation) বেহেশতে নিয়ে যেতে পারবেন।" (আহমদ ২০০৪: ৩৭)
বাবার জীবদ্দশাতেই আসহাব উদ্দীন আহমদের হাতেখড়ি হইয়াছিল। হাতেখড়ির পর পরই তাঁহাকে নিজ গ্রামের মক্তবে ভর্তি করাইয়া দেওয়া হয়। তিনি স্মরণ করিয়াছেন, সেদিন তাঁহার মক্তবে ভর্তি হওয়া উপলক্ষে মক্তবের সকল ছাত্রছাত্রীকে মুরগির গোশ্ত দিয়া চালের গুঁড়ার রুটি খাওয়ানো হইয়াছিল। সেই দিনের কথা তিনি এইভাবে স্মরণ করিয়াছেন: "মক্তব ছুটির পর যখন বাড়ি গেলাম তখন আমার মনে হতে লাগল আমি আগের মানুষটি নেই। আমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। এখন আমার পরিচয় আমি একজন মক্তবের ছাত্র। এই ভেবে আমি গর্ববোধ করতাম।" (আহমদ ২০০৪: ৩৬)
তখন খেলাফত আন্দোলনের যুগ। তিনি লিখিয়াছেন, "খেলাফত আন্দোলনের অস্পষ্ট ছবি আমার মনে রয়েছে। চারদিকে বিলিতি কাপড় পোড়ান হচ্ছিল। একদিন বাবা আমাকে দর্জির দোকানে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং আমার জন্য একটা খদ্দর কাপড়ের জামা সেলাই করে নিয়েছিলেন। গান্ধীর চট্টগ্রাম আগমনের খবর গ্রামাঞ্চলেও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। তার ঢেউ আমার মনেও দোলা দিয়েছিল।" (আহমদ ২০০৪: ৩৬)
আসহাব উদ্দীন আহমদের বয়স যখন সাত বছরের মতন তখন তাঁহার বাবার আকস্মিক মৃত্যু হয়। তিনি ছিলেন বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। তাঁহার মায়ের ঘরে বড় একটি ভাই থাকিলেও তিনি তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার ভয়ে বাড়ি হইতে পলাইয়া ছিলেন। আসহাব উদ্দীন আহমদ লিখিয়াছেন, "বাবার মৃত্যুর পর আমাদের জীবনে নেমে এল এক অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়।" (আহমদ ২০০৪ : ৫৪)
কিন্তু এই বিপর্যয়ের মধ্যেও মনে হয় একটা কল্যাণ লুকাইয়া ছিল। বাবা ঐ সময়ে যদি মৃত্যুবরণ না করিতেন তবে আসহাব উদ্দীন আহমদ হয়তো কোনদিন আসহাব উদ্দীন আহমদই হইতেন না–পিতৃদত্ত নাম অনুসারে 'আসহাব মিয়া চৌধুরী'ই থাকিয়া যাইতেন। "আরবি লাইনে পড়াশোনা করলে," তিনি লিখিতেছেন, "হয়তো আমার পরিচয় হত আমি একজন জেহাদি মওলানা, তলোয়ারে বাংলা–এ জাতীয় কিছু।" (আহমদ ২০০৪: ৩৮)
৩
মক্তবের পড়া শেষ করিবার আগেই আসহাব উদ্দীন আহমদ পিতাকে হারাইলেন। তাঁহার মক্তবের পড়া শেষ হইবার পর ভবিষ্যতে লেখাপড়ার কথাটা আরো জোরেশোরে উঠিল। পড়শিরা বলিতে থাকিলেন, মুনশি সাহেব–মানে শিশুর বাবা–বাঁচিয়া নাই। থাকিলে তিনি এ ছেলেকে মৌলবি বানাইতেন। তাঁহার অবর্তমানে পিতার ইচ্ছাই পূরণ করা দরকার। সমস্যার মধ্যে, তাঁহাদের বাড়ির ধারে কাছে কোন মাদ্রাসা ছিল না। আর মায়ের সাহসেই সেবারও তাঁহার জীবন–মানে মানস জীবন–রক্ষা পাইল। মা জননী তাঁহাকে মাদ্রাসায় না পাঠাইয়া মধ্য-ইংরেজি স্কুলে পাঠাইবার সিদ্ধান্ত লইলেন। ছেলের ভাষায়, 'এ ক্ষেত্রে ধর্মের চেয়ে মাতৃস্নেহই প্রবলতর ভূমিকা পালন' করিল। আসহাব উদ্দীন আহমদ লিখিয়াছেন, "আমার মধ্যে কোমলতা বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে তার অনেকখানি আমি মায়ের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি বলে মনে করি। মা ছিলেন আমার কাছে 'কোমলতার প্রতীক'। (আহমদ ২০০৪: ৫৭)
মাতার এই কোমলতাই আসহাব উদ্দীন আহমদকে বাঁচাইয়া দিল। তিনি লিখিলেন, 'বাবার ইচ্ছে, ধ্যানধারণার প্রতি মার অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি বাধ সাধলেন। তাঁর কথা হল, আমি আমার এত কম বয়সের ছেলেকে আরবি এলেম হাছেলের জন্য বাড়ির থেকে দূরে কোথাও পাঠাব না। আগে স্কুলের পড়া শেষ করুক। তারপর না হয় আরবি লাইনে দেয়ার কথা বিবেচনা করা যাবে।' আসহাব উদ্দীন আহমদ লিখিয়াছেন, "যাক, মাদ্রাসায় না পাঠিয়ে আমাকে মধ্য-ইংরেজি স্কুলে পড়ানোর আমার মায়ের সিদ্ধান্তকে আমি আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিকাল (turning point) বলে মনে করি।' (আহমদ ২০০৪: ৩৭-৩৮)
আমরাও তাহাই মনে করি। যদি তিনি মধ্য-ইংরেজি স্কুলে ভর্তি না হইয়া কোন আরবি লাইনের মাদ্রাসায় দাখেল হইতেন তো তাহার নতুন নামটাই জারি হইত না। ঘটনাটা তাঁহার 'কলেজ-স্মৃতি' অর্থাৎ জীবনস্মৃতির দ্বিতীয় পর্বে আছে। আমি তাঁহার জবানিতেই বলিতেছি: "১৯৩১ সাল। আমি বাঁশখালি থানার বাণীগ্রাম হাই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। এ সময়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্কুল ইনস্পেক্টর (এখন বলা হয় জনশিক্ষা উপ-পরিচালক, ইংরেজিতে সংক্ষেপে ডি.ডি.পি.আই.) ছিলেন শামসুল ওলামা কামাল উদ্দীন আহমদ। এর আগে একসময় তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি আমাদের স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। দশম শ্রেণীতে ঢুকে তিনি আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, 'আসহাব মিয়া।' তিনি বললেন, 'আসহাব মিয়া নয়', 'আসহাব উদ্দীন আহমদ' লিখবে।' (আহমদ ১: ১২৪)
আসহাব উদ্দীন আহমদ এই জায়গায় থামিয়া মন্তব্য করিয়াছেন, 'সে যুগে (বাঙ্গালি) মুসলমানদের মধ্যে (ইংরেজি) শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে প্রায় ক্ষেত্রে নামের শেষে 'মিয়া' লাগানোর ব্যাপক প্রচলন ছিল।' একথা ষোল আনা মিথ্যা নহে। শুদ্ধ মনে রাখিতে হইবে, আসহাব উদ্দীন আহমদের বাবার নাম ছিল সফর আলী চৌধুরী আর তাঁহার বড় ভাইয়ের নাম ছিল আশরাফ মিয়া চৌধুরী। তাহার এক চাচার নাম মুনশি আবদুর জব্বার চৌধুরী। অধিক কি, তাঁহার বংশের একটি শাখা চট্টগ্রাম শহরের উত্তরে কাট্টলি গ্রামে বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন। সেই শাখার এক উজ্জ্বল রত্নের নাম নূরুল হক চৌধুরী। তিনি ছিলেন যুক্তবঙ্গের একজন প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতা।
একদিকে আসহাব উদ্দীন আহমদ 'চৌধুরী' পদটা যেমন পরিহার করিয়াছেন তেমনি অন্যদিকে তাঁহার নামের 'উদ্দীন' ও 'আহমদ' পদদ্বয় কোথা হইতে আসিয়াছে তাহার একটা সুরাহাও করিয়াছেন। এই নাম আসিয়াছে শামসুল ওলামা কামাল উদ্দীন আহমদের নাম হইতে। এই ঘটনাকেও বাঙ্গালি মুসলমানের 'আধুনিক' হইবার পথে একটি সন্ধিকাল বলিয়া গণ্য করা যায়।
২৩ ডিসেম্বর ২০১৪
দোহাই
১. আসহাব উদ্দীন আহমদ, রচনা সমগ্র, ১ম খণ্ড, আনু মুহাম্মদ ও এনতেজার উদ্দীন আহমদ সম্পাদিত (ঢাকা: মীরা প্রকাশন, ২০০৪)।
২. আহমদ ছফা, আহমদ ছফা রচনাবলি, ৩য় খণ্ড, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত (ঢাকা: খান ব্রাদার্স, ২০০৮)।
৩. আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনা সমগ্র, ৩য় খণ্ড, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস সম্পাদিত, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৩)।