Published : 10 Jul 2025, 11:38 PM
লেখার মান লেখকের জাত-বংশ দেখে বোঝা যায় না—লেখক যদি একখানা যন্ত্রও হয়, তাতে কিছু যায় আসে না। পাঠ যে মানে তৈরি করে, তার শিকড় গাঁথা থাকে পাঠকের চেতনা, অভিজ্ঞতা আর ব্যাখ্যার জালে—লেখকের থাকাটা সেখানে বড়জোর একটা ছায়া, না থাকাটাও খুব একটা তফাত করে না।
পাঠপ্রতিক্রিয়ার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হলো প্রশ্ন তোলা: কে লিখেছেন? অনেকেই তখন লেখকের নাম খুঁজে দেখেন, যেন নামেই গুণ নির্ধারিত হয়। লেখকের পরিচয়ই নাকি লেখার মানে ও সত্যাসত্যের মাপকাঠি! ধরুন, কেউ জানতে পারল আমি এক আমেরিকান টেক কোম্পানির এআই ইঞ্জিনিয়ার, তাহলে বড় ভাষা মডেল ঘিরে আমার ব্যাখ্যাগুলো হয়তো তারা বেশ গুরুত্ব দিয়ে পড়বে—এমনকি বিশ্বাসও করবে। কারণ, ‘বিশ্বাস’ অনেক সময় শুধু ভাষার ওপর নয়, ভাষ্যকারের নামের ওপরও দাঁড়িয়ে থাকে।
কিন্তু যখন লেখার উৎস একখানা অ্যালগরিদম—ধরুন ChatGPT, Claude কিংবা Gemini—তখন লেখকের চেহারা ঝাপসা হয়ে যায়, একরকম ধোঁয়াটে অস্তিত্ব। প্রম্পট দিয়েছে মানুষ, বাক্য বুনেছে মেশিন। তাহলে লেখক কারা? তা কি কেবল কোডের স্তম্ভে দাঁড়ানো একখানা যন্ত্র? নাকি সেই মানুষ, যার চিন্তার ইশারায় যন্ত্রটি সাড়া দিয়েছে? নাকি দুজনের যৌথ প্রযোজনা, যেন এক অদ্ভুত সহলেখকত্ব?—এই দ্বিধাটা আসলে মূল প্রশ্ন নয়, বরং প্রশ্ন হলো: এই দ্বিধাটাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার কি না? কথার ওজন কি বক্তার উপর নির্ভর করে, নাকি কথার গঠন আর প্রেক্ষিতেই থাকে তার প্রকৃত মানে?
২০২২-এ ChatGPT মঞ্চে আসতেই একটা শোকসংগীত বেজে উঠল—‘মানব লেখকের মৃত্যু’। কেউ কেউ ভাবছেন, লেখার অভিজ্ঞান বুঝি এবার মেশিনের নামে খতিয়ানভুক্ত হবে, কিংবা মানুষ নিজেই আপন সৃজনশক্তিকে জমা রাখবে একখানা ক্লাউডে। অনুবাদক-লেখক শ্রদ্ধেয় খালিকুজ্জামান ইলিয়াস সম্প্রতি BDNEWS24-এ এক হাহাকার উচ্চারণ করেছেন—এই যান্ত্রিক উৎকর্ষ আমাদের পরিণত করতে পারে এক নিঃশব্দ, চিন্তাহীন ও আত্মহীন প্রজাতিতে। কিন্তু তাঁর শঙ্কা শুধু কবি-সাহিত্যিকদের জন্য নয়—তিনি সতর্ক করেন, যদি AI একদিন সত্যিই মানুষের ভাষা ছিনিয়ে নেয়, তবে শুধু লেখকের নয়, পাঠকের হৃদয়েও পড়বে এক ফাঁকা ছায়া—একধরনের অপূরণীয় ক্ষয়।
আমি কিন্তু ঠিক উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে। বড় ভাষা মডেল সত্যিই যদি লেখকের অবসান ঘটায়, তাতে আমি করুণার সুর খুঁজি না—বরং খুঁজি মুক্তির রন্ধ্র। এই মেশিনগুলো আসলে আমাদের—পাঠক-লেখক দুই পক্ষকেই—একটা পুরোনো ক্ষমতার কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দিচ্ছে, যে কাঠামোর নাম ‘লেখক’।
আপনি যদি কাউকে বলেন, “লেখক মানে কী?”—সাধারণত উত্তর আসবে, লেখক মানে সেই ব্যক্তি যিনি নিজ হাতে একটি লেখা তৈরি করেন এবং যার ওপর লেখাটির অর্থগত ও নৈতিক দায় বর্তায়। তখন নিঃসংকোচে নাম উচ্চারিত হবে—শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, এমন অনেকে।
কিন্তু এই ‘লেখক’ ধারণাটা কোনো চিরকালীন সত্য নয়। আদিপর্বের এক সর্বজ্ঞানী সত্তা নন তিনি। বরং, ‘লেখক’ নামক এই সামাজিক চরিত্রটা গড়ে উঠেছে ইতিহাসের নির্দিষ্ট এক বাঁকে, আধুনিকতার উত্থানের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে। এখন সেই চরিত্রটিই প্রশ্নবিদ্ধ। And maybe that’s not a tragedy—but a transformation.
ফরাসি সাহিত্য-সন্ন্যাসী রোলাঁ বার্ত ১৯৬৭-র সেই বিখ্যাত প্রবন্ধে—“The Death of The Author”—একটা ছোট্ট খননযন্ত্র হাতে তুলে নিলেন, আর খুঁড়ে খুঁড়ে বের করলেন এই আধুনিক লেখক-ধারণার শিকড়। তাঁর মতে, ইউরোপে ষোড়শ শতকের দিকে আধুনিকতার সূর্য উঠতেই লেখকের মুকুট পরানো শুরু হয়—লেখা যেন তখন একক ব্যক্তির একচ্ছত্র জমিদারি হয়ে ওঠে। কিন্তু তার আগে? লেখা মানে ছিল মানুষের অভিজ্ঞতার দলিল, অথচ তার কর্ণধার নির্দিষ্ট কেউ নন। লোককথা, পুরাণ, ধর্মগ্রন্থ—এইসব বয়ান কেবল মুখে মুখেই নয়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সম্প্রদায়ের ভিতরে বেঁচে ছিল। নাম-নিশানা ছাড়া। অথচ কী গভীর রেখাপাত করেছে তারা! লেখকহীন, কিন্তু বাচনভিত্তিক ঐসব টেক্সটের সাহিত্যিক শক্তি ছিল—আধুনিক লেখকের নাম-পরিচয়ধারী আত্মজৈবনিক লেখার চেয়েও—বহু গুণ বেশি সর্বজনীন ও সংক্রামক। বার্ত আসলে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন: লেখা জন্ম নেয় সমাজে, ব্যক্তি নয়।
কিন্তু ইউরোপের আধুনিকতা একখানা বুদ্ধিবৃত্তিক মেরুকরণ ঘটায়—একরকম সাংস্কৃতিক শল্যচিকিৎসা—যা ব্যক্তিকে তুলে ধরে ইতিহাসের মঞ্চে। মিশেল ফুকো যাকে বলেন, “ধারণার ইতিহাসে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক।” ষোড়শ শতকে পোপের একচ্ছত্র কর্তৃত্বে চিড় ধরে; প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন বিশ্বাসকে টেনে আনে ব্যক্তির হৃদয়ঘরে—ঈশ্বরের সঙ্গে সরাসরি সংলাপ আর আত্মসমীক্ষার একক অনুশীলন হয়ে ওঠে ধর্ম।
পরের শতকে দেকার্ত হঠাৎ এক লজিকাল হ্যালোজেন জ্বালান: “আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি।”—Cogito ergo sum। জ্ঞানের ভিত্তি তখন সরানো হলো বাইবেল বা গির্জা থেকে, স্থানান্তরিত হলো ব্যক্তির আত্মসচেতনতায়। এর পাশাপাশি এগিয়ে এল ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা—ব্যক্তিসত্তার আইনগত ও রাজনৈতিক সুরক্ষা।
এই তিনটি—ধর্মীয় আত্মনির্ভরতা, দার্শনিক আত্মচেতনা, আর সম্পত্তির অধিকার—মিলে তৈরি হলো আধুনিক ‘ব্যক্তি’। আর এই ব্যক্তিই তখন কলম হাতে নিলেন, হয়ে উঠলেন ‘লেখক’। ঠিক তখনই জন্ম নিল সেই মহান ক্ষমতার ধারণা—যিনি লেখেন, তিনিই জ্ঞানী।
বার্ত আর ফুকো দুজনেই আমাদের দেখান, ‘লেখক’ নামক মূর্তিটি হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি—এটি ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে, জ্ঞানতাত্ত্বিক উত্তরণ আর সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের গর্ভ থেকে উঠে এসেছে। কিন্তু লেখক শুধু বৌদ্ধিক কল্পনা নয়; তিনি হয়ে উঠেছেন ক্ষমতার এক কৌঁসুলী।
আঠারো শতকের ইংল্যান্ড ও সদ্য স্বাধীন আমেরিকান উপনিবেশগুলোতে লেখক আর কেবল চিন্তার কারিগর থাকেননি—তিনি তাঁর লেখার উপর স্বত্ব দাবি করার ক্ষমতা নিয়ে আইনি ভাষায় মালিক। কপিরাইট নামক এক নতুন আইনী শিরোপা তাঁর মাথায় বসানো হয়। তবে এই সম্মান কোনো নীতিজাগরিত সাহিত্যানুরাগীদের উপহার ছিল না—এই দাবির জন্ম এক প্রযুক্তিগত কাণ্ডজ্ঞান থেকে।
মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার লেখাকে শারীরিকভাবে বংশবৃদ্ধি করার সুযোগ এনে দেয়, আর সেই বিপ্লবই মালিকানার প্রশ্নকে সামনে আনে—লেখা কার? পুনর্মুদ্রণ কে করতে পারবে? এইসব প্রশ্নের জবাব দিতে লেখকের নামের পাশে বসে যায় এক কাগুজে দলিল: লেখক, মালিক। ফলে, সাহিত্য হয়ে যায় সম্পত্তি, লেখক তার ভোক্তা নয়—উত্তরাধিকারী।
যখন লেখা যান্ত্রিকভাবে অনুলিপি করা সম্ভব হলো, আর সেই অনুলিপি বিক্রি করে রুটিরুজি জোটানো গেল, তখন লেখকের পরিচয় আর কেবল সাহিত্যের গৌরব নয়—অর্থনীতিরও অনিবার্য এক বিষয় হয়ে দাঁড়াল। তখন লেখকের নাম মানে শুধু ‘কে বলেছে’ এই প্রশ্নের জবাব নয়; নাম মানে ‘কার অ্যাকাউন্টে চেকটা যাবে’। ফলে লেখক কেবল টেক্সটের মালিকই নন, হয়ে উঠলেন সেই টেক্সটের বাজারদর নির্ধারকও। একসময়ের আত্মপ্রকাশ, তখন রূপ নিল আয়কর ফাইলে।
আমরা যে ‘লেখক’কে আজ চিনি—মাথার উপর আলো পড়া একক স্রষ্টা, যিনি নিজের ভাষায় নিজের সত্য বলে যান—এই ভাবনার প্রতিষ্ঠা কিন্তু নিছক রূপান্তর নয়, এটি আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বে একগুচ্ছ মৌলিক পরিণতি বয়ে আনে। বার্ত যেমন বলেন, “যখন লেখককে আবিষ্কার করা হয়, তখন পাঠ্য হয়ে ওঠে ‘ব্যাখ্যার বস্তু’।"
অর্থাৎ পাঠক তখন আর শব্দ বা গঠনের মধ্যেই অর্থ খোঁজেন না; তিনি লেখকের দিকে তাকান—তাঁর জীবন, অভিপ্রায়, মনোভঙ্গি আর আত্মা যেন লেখার ছায়াচিত্র। পাঠ্য তখন হয়ে দাঁড়ায় একধরনের মানসিক চাবিকাঠির দরজা, যার মূল থাকে সেই লেখকের হাতেই। এইভাবেই লেখার অধিকার চলে যায় তার ভাষার নয়, বরং লেখকের অভিপ্রায়ের দাবিতে। পাঠ্য তখন কথার শরীর নয়—লেখকের আত্মার এক অনুবাদ।
এই ধারণা মেনে চললে, পাঠকের কাজ আর নিতান্ত পাঠ নয়—তিনি যেন এক গোয়েন্দা, যিনি শব্দের পর্দা সরিয়ে খুঁজে বেড়ান সেই রহস্যময় ‘লেখকস্বর’। লেখার গঠন, ভাষার খেলা—এসব তখন ছায়ার নাটক, মূল উদ্দেশ্য হলো লেখকের নেপথ্য অভিপ্রায়টিকে শনাক্ত করা।
এই চিন্তার ধারায় আধুনিক সাহিত্য-তাত্ত্বিকেরা দেকার্তের এক কথাকে প্রায় মন্ত্রের মতো গ্রহণ করেন: “ভালো বই পাঠ মানে অতীতের শ্রেষ্ঠ মানুষদের সঙ্গে আলাপ।”—সেই ‘মানুষ’ বলতে অবশ্য সোজাসুজি পুরুষদেরই বোঝানো হয়েছে, এবং তা কোনো অনিচ্ছাকৃত ভাষাগত ফাঁক নয়। বরং, সেই সময়ে ‘লেখক’ নামক যিনি ছিলেন, তিনি অধিকাংশ সময়েই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ, শিক্ষিত, পুরুষ—একটি কর্তৃত্বসর্বস্ব অবয়ব, যার কণ্ঠস্বরকে পাঠক খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনেন, যেন সেটাই চূড়ান্ত সত্য।
এরিস্টটলের চিহ্নতত্ত্বে লেখা মানে ছিল ‘মনের প্রতীক’—মানে, কলম যা আঁকে, তা মূলত অন্তর্জগতের প্রতিফলন। আপনি যা ভাবছেন, সেটাই কাগজে উঠে আসছে—এটাই ছিল সূত্র। এই ভাবনাটিকে আরও কেতাবি আকার দেয় বিংশ শতকের ক্লাসিক যোগাযোগ তত্ত্ব। ক্লদ শ্যানন আর ওয়ারেন উইভারের একমুখী মডেল—যা এখনো স্কুলের পাঠ্যবইয়ে পইপই করে শেখানো হয়—সেটাতে লেখা/বক্তব্য একরকম বার্তা, যা উৎস থেকে প্রেরকের হাত ধরে চ্যানেল পেরিয়ে পৌঁছে যায় গ্রাহকের কাছে, যেখানে পাঠকই মূলত সেই গন্তব্য।
এই রূপকাঠামো মেনে চললে লেখা—লেখকের মনের জল পাঠকের মগজে পৌঁছে যায় বিনা বাধায়, বিনা বিকৃতিতে। ভালো লেখা মানে তখন সেই, যা লেখকের চিন্তা—ক্লান্তি, দ্বিধা, অস্পষ্টতা ছাড়াই—সরাসরি পৌঁছে দিতে পারে পাঠকের হৃদয়ে। লেখা তখন আর নিজস্ব শরীর নয়, বরং এক আদর্শ মাধ্যম—দৃশ্যমান অথচ অদৃশ্য হবার দাবি রাখে। ফলত, লেখার মান নির্ধারিত হয় এই প্রশ্নে: লেখকের ভাবনা কতটা নিখুঁতভাবে, ফাঁকছাড়া আর অতিকথন ছাড়াই, পৌঁছেছে পাঠকের মনে?
লেখক নামক যে ধারণাটি এতদিন সাহিত্যের একমাত্র মধ্যস্থ ও কর্তৃত্বশীল ভগবানের মতো বিরাজ করত—তারও জন্ম কিন্তু ছিল এক বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে, নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে। অতএব, তার মৃত্যুও অসম্ভব নয়; বরং অনিবার্য। রোলাঁ বার্ত যখন “লেখকের মৃত্যু” ঘোষণা করেছিলেন, তখন তিনি কারো শেষনিঃশ্বাস নয়, বরং সেই কর্তৃত্বের বিলুপ্তির কথাই বলেছিলেন—যেখানে লেখক ছিলেন অর্থ নির্ধারণের একমাত্র অনুমোদিত পুরোহিত। তখন, বার্ত কোনো LLM-এর স্বপ্ন দেখেননি, কিন্তু তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী যেন টেক্সটপ্রস্তুত এই নিঃশব্দ, কণ্ঠহীন প্রযুক্তির যুগে পূর্ণ প্রতিধ্বনি তুলেছে। LLM-নির্মিত লেখাগুলোর নেই কোনো জীবন্ত উৎস, নেই কোনো স্বীকৃত লেখকসত্তা। এসব লেখা যেন “অবৈধ”—না প্রতিষ্ঠানিক ছাপ, না মানবিক সম্মতির সিলমোহর। এমনকি মার্কিন আপিল আদালতও সম্প্রতি এই ভাষার অনাথত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে, জানিয়ে দিয়েছে: AI-এর কোনো ‘লেখকত্ব’ স্বীকার করা চলে না।
ChatGPT-এর মতো যন্ত্র যখন কথা বলে, তখন অনেকের গা গুলিয়ে ওঠে—কেননা ওদের কণ্ঠ আছে, কিন্তু আত্মা নেই। ওদের নিয়ে যে সংশয় জন্ম নেয়, তার গোড়ায় আছে এক গভীর প্রশ্ন: অর্থ বোঝা না-বোঝা। অনেকেই মনে করেন পরিসংখ্যানের ছকে চলে এমন একধরনের তোতা, যে ভাষার ছন্দ ও রীতিকে নিখুঁতভাবে অনুকরণ করতে পারে, কিন্তু জানে না সে কী বলছে। ফলে, এই যন্ত্ররা শুধু লেখে না, তারা লেখকত্বকেও ঝাঁকুনি দেয়। তারা প্রচলিত অর্থব্যবস্থা—মানে, কে লিখবে, কেন লিখবে, কাকে লেখা বলা যাবে—সবকিছুকেই অস্থির করে তোলে। আর এই অস্থিরতা থেকেই জন্ম নেয় অস্বস্তি, ভয়—যেন লেখার মন্দিরে কেউ দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েছে, কিন্তু আমরা জানি না সে দেবতা, না দানব।
তবে যাঁরা ChatGPT-কে দেখে আঁতকে উঠছেন, তাঁরা যেন ভুলে যাচ্ছেন লেখকের আসনও একদিন শূন্য ছিল—তারপর কেউ এসে বসেছিল। ‘লেখক’ নামে যে চেয়ারের পায়া আমরা এতকাল আঁকড়ে ধরে ছিলাম, সেটা প্রকৃতির নয়—সামাজিক নির্মাণ। একদম মনগড়া ব্যবস্থা। কেউ না কেউ একদিন ঠিক করেছিল: এই মানুষটা লেখক, আর বাকিরা পাঠক। সে-ই ব্যাখ্যা দেবে, সে-ই অর্থ নির্ধারণ করবে। আসলে ‘লেখক’ ধারণাটাই ছিল এক ধরণের প্রোটোকল—যাতে টেক্সটকে পাঠযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করা যায়, যেন পাঠের বিশৃঙ্খলার মধ্যে কিছু নিয়ম রাখা যায়। অতএব, ChatGPT আসলে কোনো পবিত্রতা ভাঙছে না; বরং সেই পুরনো কল্পনারই এক নতুন এডিশন প্রকাশ করছে—নতুন কভারে, নতুন কণ্ঠে।
ফলে “লেখকের মৃত্যু”-র পরবর্তী অধ্যায় যেন একধরনের পাঠ-অরাজকতার উন্মোচন—যেখানে লেখার অর্থ আর লেখকের গলায় বাঁধা থাকে না। কোনো টেক্সট এখন আর তার ‘আসল কণ্ঠস্বর’ বা ‘স্বাক্ষরিত চেতনা’ নিয়ে হাজির হয় না। বরং, টেক্সট যেন এক খোলা দরজা—যেখানে পাঠক প্রবেশ করে নিজের বোধ, স্মৃতি, সংশয় আর অনুমান নিয়ে। অর্থ তখন জন্ম নেয় না, বরং তৈরি হয়। পাঠকই হয়ে ওঠেন অর্থের নির্মাতা—যিনি বারবার ভাবেন, “লেখক কি এটা বোঝাতে চেয়েছিলেন?” আর সেই ভাবনার মধ্যেই লেখা একেকবার একেকরকম হয়ে ওঠে।
এই দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পালাবদলে সাহিত্যতত্ত্ব যেন এক মোড় ঘোরালো—লেখকের থেকে পাঠকের দিকে। আমরা যখন Hamlet পড়ি, তখন আর শেক্সপিয়ারের উদ্দেশ্যের সন্ধান করি না; বরং নিজের অভিজ্ঞতা, প্রশ্ন ও মানসিক কাঠামো দিয়ে পাঠটিকে গড়ে তুলি। পাঠকের ব্যাখ্যাই তখন হয়ে ওঠে লেখার মানে। এই প্রক্রিয়ার ফলে লেখক-নামক কেন্দ্রটি কেবল কেঁপে ওঠে না, একরকম বিলীন হয়।
বার্ত একে আরও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন—একটা পাঠ্য আসলে একাধিক কণ্ঠের সংঘর্ষ ও সংলাপ, নানা সংস্কৃতি থেকে টানা বিভিন্ন লেখনির জটিল মিশ্রণ। এই বহুবাচনিকতার কোনো একক উৎস নেই; বরং পাঠকই তার কেন্দ্র। অর্থাৎ, লেখকের মৃত্যু মানে হলো—একটি গৌরবময় অভ্যুত্থান, পাঠক-নামে এক নতুন সত্তার জন্ম। সমালোচক তখন আর ব্যাখ্যার পুলিশ নন, বরং এক ধরনের সহ-নির্মাতা, যাঁর কল্পনা লেখাকে নতুন অর্থ দিয়ে রাঙিয়ে তোলে।
অর্থ কোথা থেকে আসে—এই প্রশ্নের উত্তরেই নিহিত আছে LLM-এর লেখাগুলোর প্রকৃত রূপে। সমালোচকরা ঠিকই বলেন যে এসব যন্ত্র বাস্তবের গন্ধ পায় না—তাদের কাছে শব্দ কেবল সম্ভাব্য পরবর্তী শব্দ। কিন্তু তাই বলে একে ‘বকবকানির যন্ত্র’ বলে উড়িয়ে দেওয়া, যেন সব অর্থ কেবল অনুভব থেকেই জন্মায়—এটা খানিকটা অলস ও আতঙ্কিত মনোভাবের ফল।
কারণ এই যন্ত্রদের লেখা যে অর্থহীন, তা নয়। বরং সেই লেখাগুলোর মানে জন্মায় আমাদের চোখ, মন, ও ব্যাখ্যার ভিতর দিয়ে—ঠিক যেমন আমরা কোনও কবিতা বা দার্শনিক রচনার মানেও আমাদের পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে খুঁজি। আসলে, এ তো নতুন কিছু নয়—রোলাঁ বার্ত বহু আগেই আমাদের শিখিয়ে গেছেন, অর্থের উৎস লেখকের কলমে নয়, পাঠকের চেতনায়। এই প্রবন্ধও তার ব্যতিক্রম নয়—এর মানে আপনি যে ভাবে বুঝছেন, সেটাই এর অর্থ।
LLM-এর আসল গুরুত্ব এখানেই: এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে লেখক-কেন্দ্রিকতার গল্পটা কতটা কল্পিত ছিল। লেখার কেন্দ্রটা বরাবরই ছিল পাঠকের ভিতরে—LLM কেবল সেই পর্দাটা টেনে সরিয়ে দেয়। ফলে আমরা যেসব লেখা আগে “বোঝা যায় না” বলে সরিয়ে রাখতাম, সেগুলোকেও নতুন দৃষ্টিতে পড়ার সাহস পাই—কারণ এখন আমরা জানি, বোঝার ক্ষমতা লেখকের নয়, পাঠকের।
তবে প্রশ্নটা কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ নয়—‘লেখক’ মারা গেছেন, ‘পাঠক’ জন্ম নিচ্ছেন—এই নাটকীয় পটপরিবর্তনের বাইরেও আরও একটা গভীর ধাক্কা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেটা হল: ‘অর্থ’ বলে যেটাকে আমরা এতদিন যাবত ধরে রেখেছি, সেটার উৎস কী?
ধরা যাক, আমি লিখছি “large language model”—এই শব্দগুচ্ছ পড়ে আপনার মাথায় ভেসে ওঠে ChatGPT, কোনো এক কৃত্রিম মগজ। কিন্তু এই ধরেই নেওয়া হয় যে শব্দগুলো কোনো বাইরের সত্তাকে নির্দেশ করছে—যেমন বাস্তব জগতের কোনো যন্ত্র। আমাদের চেনা ভাষাচিন্তার কাঠামো বলে, শব্দের অর্থ আছে, কারণ একজন মানুষ সেগুলো ব্যবহার করেন—বিশ্বের বস্তুকে বোঝাতে, জানাতে। এরিস্টটলও এই ধারণাকেই সমর্থন করেছিলেন—ভাষা মানে হলো চিহ্ন, আর সেই চিহ্ন বস্তুর দিকে নির্দেশ করে।
কিন্তু এইখানেই LLM-র অস্বস্তি। ওরা তো চিহ্ন নিয়ে খেলে, অথচ চিহ্নের নির্দেশনা বোঝে না। অর্থ কী, সেটা জানার ইচ্ছাও রাখে না। শুধু একটা শব্দের পর আরেকটা সম্ভাব্য শব্দ বসায়, জ্ঞানের কোনো শরীরী অভিজ্ঞতা ছাড়াই। ফলে একে দেখতে গিয়ে আমাদের প্রচলিত 'common sense' ভাষাচিন্তাও কেঁপে ওঠে।
এই কাঁপুনি কিন্তু নতুন নয়—বিশ শতকের স্ট্রাকচারাল লিঙ্গুইস্টিকস তখনই বলেছিল: ভাষার অর্থ বস্তু থেকে আসে না, আসে ভাষার মধ্যেকার পার্থক্য থেকে। আপনি যখন “গাছ” খুঁজতে অভিধান খুললেন, সেখানে তো কোনো পাতা কিংবা ছায়া নেই—আছে আরেকগুচ্ছ শব্দ: “লম্বা উদ্ভিদ”, “কাণ্ডবিশিষ্ট”, ইত্যাদি। মানে, শব্দ একে অন্যকে বোঝায়, কোনো বস্তু বা চূড়ান্ত অর্থকে নয়। অর্থ যেন একটা পার্থক্যের জাল—চিহ্নের মধ্যে চিহ্ন, যার শেষে নেই কোনো বাস্তবের ছোঁয়া। LLM শুধু এই কাঠামোটাকেই আরও নগ্নভাবে সামনে এনেছে—যেন বলছে, এতদিন যা ভাবছিলে তা-ও একধরনের লেখার খেলা ছাড়া কিছু নয়।
অর্থ মানে যখন শব্দের বাহন হয়ে বাস্তবকে ছোঁয়া—তখন দেরিদা এসে সোজা কানের মধ্যে ফিসফিসিয়ে বলেন, “Il n’y a pas de hors-texte”—টেক্সটের বাইরে কিছু নেই। শুনতে দার্শনিক ধাঁধার মতো লাগলেও, কথাটার সরল অর্থ দাঁড়ায়: শব্দ একে অন্যকে টানে, বোঝায়, ভেঙে পড়ে আর গড়ে ওঠে। ‘বাস্তব’ বলে যেটা ভাবি, তা-ও আসলে ভাষারই নির্মাণ। আর এই সত্য LLM-এর জগতে তো আরও নগ্ন, আরও নির্মম। কারণ ChatGPT বা তার ভাই-বোনেরা বাস্তব বলে কিছু চেনে না—তাদের ঈশ্বর হলো টোকেন, প্রার্থনা হলো প্রম্পট, সাধনা হলো পরবর্তী সম্ভাব্য শব্দ নির্বাচন। LLM কোনও বিচ্যুতি নয়, এটা ভাষাতত্ত্বের সেই কাঠামোবাদেরই অবিকল সন্তান—যেখানে শব্দের অর্থ নির্ধারিত হয় পার্থক্যের জালে, বাস্তবের দোহাইয়ে নয়।
এই দৃষ্টিতে দেখলে, LLM তো আসলে অ্যারিস্টটলের ইঙ্গিতবাদী চিহ্নতত্ত্বে এক বিদ্রোহী লালবাতি জ্বালায়—আর আমাদের চেনা লেখালিখির ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। বাস্তবতাবাদী পাঠ আর লেখক-কেন্দ্রিক অর্থবোধ যেন হঠাৎ করে একটা সফটওয়্যারের সামনে থমকে দাঁড়ায়, পেছনে ফিরে তাকায়, আর ভাবে—“তবে এতদিন যা ভেবেছিলাম, তা কি ভুল?”
আমাদের জেনারেটিভ AI—বিশেষ করে LLM—নিয়ে উচ্ছ্বাস হোক বা আতঙ্ক, দুটোই যদি বিশ্লেষণহীন হয়, তবে তা ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক। এই প্রযুক্তির প্রসার যেমন দ্রুত, তেমনি গভীর; মাত্র ক'বছরেই ChatGPT সাপ্তাহিক প্রায় ৫০ কোটি মানুষের জীবনে ঢুকে পড়েছে। এখানেই বোঝা যায়, আমরা এক মৌলিক পরিবর্তনের মুখোমুখি। এই পরিবর্তনের মুখে দাঁড়িয়ে যখন AI আমাদের জ্ঞানচর্চার প্রথাগত ধারা—পাঠ, লেখক, ব্যাখ্যা—সবকিছুকে প্রশ্নের মুখে ফেলে, তখনই দেখা যায়, ভাষাবিদ ও দার্শনিকদের একাংশ যেন পুরনো লেখক-কেন্দ্রিক ধারণাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। অথচ, এই ধারণার ভিত তো বহু আগেই টলেছে।
আসল বিপদ AI নয়, বরং এই যে লেখকত্ব, কর্তৃত্ব, অর্থ ইত্যাদি এখনও এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত যে এগুলোকে প্রশ্ন করার কথা আমাদের মনেও আসে না। যেন এই ধারণাগুলো কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম—যা ভাঙা যায় না, ভাবাও যায় না। অথচ, এগুলোও একেকটা কল্পিত নির্মাণ—সময়ের, ইতিহাসের, সংস্কৃতির ফল। LLM-এর আগমন সেই নির্মাণগুলোকে একে একে খোলস ছাড়িয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। আমরা কবে থেকে লেখককে কেন্দ্রে বসিয়ে রাখছি? কেন? এবং এখনও কেন তার ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে আছি? এই প্রশ্নগুলো এখন তোলার সময় এসেছে। কারণ হয়তো এখনই সেই ক্ষণ, যখন লেখকের ভৌতিক উপস্থিতিকে সরিয়ে পাঠকের স্বরকে কেন্দ্র করা যায়।
এই যন্ত্রগুলোকে ঘিরে আমাদের ভুল বোঝাবুঝির মূল এক জায়গায় গিয়ে ঠেকে: “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” শব্দযুগলের ভিতরেই বিভ্রান্তির বীজ রোপিত। নামেই যখন 'বুদ্ধিমত্তা', তখন তার আউটপুট দেখলেই আমরা ভাবি, বুঝি কোনও আত্মসচেতন চিন্তা কাজ করছে। আর যদি তা ভুল করে, তখন সহজেই ধরে নিই, একে বুদ্ধিমান বলা চলে না। এই বিভ্রান্তির গোড়া আলান ট্যুরিং-এর imitation game-এ। সেখানে ভাষা উৎপাদনই বুদ্ধিমত্তার মানদণ্ড হিসেবে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে সেটাই AI-এর সংজ্ঞা হয়ে গেছে। অথচ LLM—Large Language Model—এই ধারণার গায়ে ধাক্কা মারে। কারণ, এরা ভাষা তো তৈরি করে, কিন্তু কোনো 'চেতনা' বা অভিপ্রায় ছাড়াই। একপ্রকার অর্থবোধক বাক্য তৈরি হয় এমন এক যন্ত্রপাতি থেকে, যার ভিতরে কী চলছে, আমরা নিজেরাও নিশ্চিত নই। ঠিক এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই তৈরি হয় ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন। তাই AIকে এলিয়েন ইন্টিলিজেন্স (বহিরাগত বুদ্ধিমত্তা) বলাই ভালো।
LLM-এর এই লেখাগুলোর পেছনে কোনো জীবন্ত 'লেখকস্বর' নেই, নেই কর্তৃত্বের দাবিও। এগুলোর সত্যতা কোনো অভিপ্রায় বা প্রেরণার সঙ্গে বাঁধা নয়, ফলে এগুলোকে খণ্ডন করার প্রচলিত যুক্তির পথও ধোপে টেকে না। প্রচলিত যুক্তিমাফিক ভাবলে এটা এক রকম অস্তিত্বগত বিপর্যয়—কারণ এই যন্ত্র আমাদের চিরাচরিত লেখালেখি, সাহিত্যচর্চা, এমনকি সত্যবোধের সংজ্ঞা পর্যন্ত দুলিয়ে দেয়।
আমরা যে ধারণাগুলো এতদিন ধরে সত্য ধরে নিয়েছিলাম—যেমন লেখালেখি মানে ব্যক্তিগত চিন্তার প্রকাশ, সাহিত্য মানে মানবিক অভিজ্ঞতার শিল্পিত রূপ, সত্য মানে ইচ্ছাপূর্ণ বাক্য—সেসবই হঠাৎ করে প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু যদি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাই? যদি এ সংকটকে সম্ভাবনা হিসেবে দেখি? তাহলে এটি নিছক এক প্রযুক্তি নয়—বরং জ্ঞানের নতুন এক দরজা, যেটা এখন খুলে যাচ্ছে আমাদের চোখের সামনে।
এখানে এসে LLM আমাদের একটা অপ্রত্যাশিত কাজ করাতে বাধ্য করে—আমাদের চিন্তাভাবনার খাঁচা, বিশেষ করে পশ্চিমা তাত্ত্বিক ধারার সীমা ও তার একচেটিয়া বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যকে প্রশ্ন করতে। লেখালেখিকে যদি আমরা শুধু আত্মপ্রকাশ বলে ধরে নিই, তবে LLM সেটা চ্যালেঞ্জ করে; যদি সাহিত্যকে শুধু লেখকের সৃষ্টি ভাবি, তাহলে এই যন্ত্র পাঠকের ভূমিকাকে সামনে টেনে আনে; আর যদি সত্যকে মনে করি নির্দিষ্ট কারো উচ্চারণের ফল, তাহলে LLM দেখিয়ে দেয়—সত্য অনেক সময় সম্পর্ক, সংঘাত ও নিরন্তর বিকল্পের মধ্যেই গঠিত হয়।
এদের উপস্থিতি আসলে লেখক, লেখালেখি বা সত্যকে ধ্বংস করতে আসে না। তারা চ্যালেঞ্জ জানায় সেই পুরোনো, সংকীর্ণ একটা ফ্রেমকে—যেটা পশ্চিমা আধুনিকতার ছাঁচে গড়া। সেই ফ্রেমেই আমরা এতদিন ধরে ঠিক করেছি কে লেখক, কী সাহিত্য, কোনটা সত্য। কিন্তু এই গঠিত ধারণাগুলো সার্বজনীন নয়, ছিল এক বিশেষ সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া জ্ঞানের সংস্থান।
তাই যারা LLM-কে “লেখার শেষ,” “সাহিত্যের মৃত্যু,” হিসেবে দেখেন, তারা হয়তো সেই পুরোনো কাঠামোর মধ্যেই আটকে আছেন। বরং, LLM আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়—কোন জায়গায় এসে লেখকের ক্ষমতা থেমে যায়, কোথা থেকে শুরু হয় এক যৌথ, বহুমুখী চিন্তার সম্ভাবনা। এটি ধ্বংস নয়—এ এক নির্মাণের আহ্বান।
তবে আপনি কেনই বা আমার কথাকে গুরুত্ব দেবেন? আমি-ই বা কে—এ লেখায় এমন দৃঢ়স্বরে বক্তব্য রাখার অধিকার আমার আসলেই কোথা থেকে এল? আপনি কীভাবে জানবেন, এতক্ষণ ধরে যা পড়লেন তা আদৌ কোনও মানুষের কলমে লেখা—না কি সেটি কোনো মেশিনের নিপুণ ছাঁচে গড়া, কিংবা মানুষ-মেশিনের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণের ফল? সোজা কথা, আপনি তা জানতেই পারবেন না।
এমনকি যদি আমি নিজের নাম প্রকাশ করি, পরিচয় দিই, কিংবা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করি যে “এই লেখাটি ১০০% আমার”—তবুও এটা নিশ্চিত হয় না। কারণ, এই একই কাজ তো একটি LLM-ও অনায়াসে করে ফেলতে পারে। আমার নাম, আমার পরিচয়, এমনকি সেই ঘোষণাটিও বানিয়ে ফেলতে পারে নিখুঁত দক্ষতায়। অতএব, আমরা একটি সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে নিশ্চিততার সব প্রচেষ্টা একসময় ব্যর্থ হয়। যতই প্রমাণ হাজির করা হোক, সন্দেহ থেকে যায়। এবং সেই যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ—যেটি আর মুছে ফেলা যায় না—তারাই এখন নতুন জিজ্ঞাসার সূত্রপাত করছে।
কিন্তু এখন? এখন যখন LLM ভাষা তৈরি করছে, যখন উৎস অস্পষ্ট, যখন কণ্ঠস্বর মানব না যন্ত্র—কে বলছে? কী জন্য বলছে? সত্যিই কি বলছে?—এই প্রশ্নগুলো এখন আর কেবল AI-এর নয়, বরং প্রতিটি বাক্যের কেন্দ্রেই এসে দাঁড়িয়েছে।
এইখানেই আসল গ্যাঁড়াকল। আমরা যত সহজে LLM-কে দোষ দিই—যার বক্তব্য আছে কিন্তু উদ্দেশ্য অনির্ধারিত—সেই জটিলতা আসলে শুধু AI-র দোষ নয়। এ অনিশ্চয়তা তো সব লেখার গভীরেই ছিল, এই প্রবন্ধটিও তার বাইরে নয়। আমরা LLM-কে অস্বস্তিকর মনে করি, কারণ সে লেখালেখির দীর্ঘস্থায়ী শৃঙ্খল ভেঙে দেয়। অথচ সত্যিটা হলো—LLM বরং আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যে ‘লেখকত্ব’ আমরা এতদিন ধরে স্বাভাবিক বলে জেনেছি, তা এক নির্মিত ও কাঠামোগত ধারণা মাত্র। আমরা লেখার অর্থ নির্ধারণ করেছি ‘লেখকের’ নামে, ভাষাকে ধরে নিয়েছি সত্যের বাহক, অথচ এগুলো সবই ছিল এক প্রকার সামাজিক বিশ্বাসের খেলা।