Published : 04 Nov 2023, 11:44 PM
পথিকৃৎ আলোকচিত্রশিল্পী ও বাংলা ছোটগল্পের দিকপাল গোলাম কাসেম ড্যাডির ‘যোগাযোগ’ গল্পটি ছাপা হয়েছিল আজ থেকে ৬৪ বছর আগে ১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাসিক `দিলরুবা' পত্রিকায় [আশ্বিন ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ, ১১শ বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা]। কিন্তু ‘ড্যাডিসমগ্র’ প্রকাশের সময় দিলরুবার এই সংখ্যাটি বাংলাদেশের কোনো লাইব্রেরিতে খুঁজে পাওয়া যায় নি। একদিন গবেষক ড. ইসরাইল খান বললেন, ‘দিলরুবার সম্পাদক এএসএম আবদুল কাদিরের মনীপুরীপাড়ার বাড়িতে গিয়ে একবার খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, ওখান থেকেই তো বের হতো দিলরুবা।’ দুই দিন মনিপুরীপাড়ায় গিয়েও ওই বাড়ির খোঁজ পাইনি। সুনির্দিষ্ট ঠিকানা ছাড়া ৬০ বছর আগে বন্ধ হওয়া একটি পত্রিকা অফিস কিংবা এর সম্পাদকের বাড়ি খুঁজে পাওয়া সত্যি কঠিন! তবে এ কথা ঠিক যে, পৃথিবীতে কোনো কিছু একবার প্রকাশিত হলে তা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় না; কোথাও না কোথাও এর অস্তিত্ব থেকে যায়। বিশ্বাস ছিল, একদিন না একদিন গল্পটি পাবোই।
বছরখানেক পর এক পূর্ণিমার রাতের ঘটনা। ঢাকা কলেজের সহপাঠী মুশতাক আহমেদ দীপুর কলাবাগানের বাসার ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। দীপু ড্যাডিসমগ্রের কথা জানতে চাইলো। বললাম, ‘ড্যাডির লেখা দুটি গল্প এখনো খুঁজে পাইনি। ‘যোগাযোগ’ গল্পটি ছাপা হয়েছিল দিলরুবায়, আর ‘ডাক্তার বাবু’ ১৯২০ সালে বঙ্গনূরে।’ দীপু বললো, ‘আমার স্ত্রীর নামই তো দিলরুবা! এত দিন তো আমার বাসায়ই দিলরুবার বাঁধাই করা সমস্ত পত্রিকা ছিল।’ আমি বললাম, ‘দিলরুবা তো ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন; দেশভাগের সময় বা তার আগের বছর এক পুত্রসন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তিনি মারা যান। পরে তার স্বামী ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ স্ত্রীর নামে এই পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলেন।’ দীপু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘দিলরুবা যাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান তিনিই আমার শ্বশুর; নাম শামীম কাদির। আমার দাদাশ্বশুর নাতনীর মুখ দেখেই তার নাম রাখেন দিলরুবা। আর সেই দিলরুবাই আমার স্ত্রী। তবে বছর তিনেক হলো, আমরা আলাদা থাকি।’
দীপু আমাকে তার শ্যালক হামীম শাখাওয়াত সুসমের নম্বর দেয়। ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি বিকেলে আমি ফোন করে সুসমকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলি। সুসম জানালেন, দিলরুবার কিছু সংখ্যা তার সংগ্রহে আছে, বাকিগুলো তার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী চাচার কাছে। কোন সংখ্যাটা দরকার লিখে পাঠাতে বললেন। আমার আকুতি শুনে সুসম বললেন, ‘গুরুত্বের সঙ্গে খুঁজবো। তবে ভাগ্য ভালো থাকলে পেয়েও যেতে পারেন।’ ফোন রেখে আমি বড় করে শ্বাস নিই; আর উপরের দিকে তাকিয়ে বলি, গল্পটি এই জায়গায় পাওয়া না গেলে পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়ার কোনো সম্ভবনা নাই! ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যা। অফিসে বসে ছবি সম্পাদনা করছি। ৭টা ১১ মিনিটে ফোনটা টুকটুক করে বেজে উঠলো। হোয়াটসঅ্যাপের ইনবক্সে ঢুকে দেখি গোলাম কাসেমের গল্প ‘যোগাযোগ’! কী ঝরঝরে গদ্য, ভাষার কী মাধুর্য; দিলরুবায় প্রকাশিত ১২ পৃষ্ঠার গল্পটি পড়ে কিছুক্ষণ বুদ হয়ে রইলাম।
এই গল্পটি যখন ছাপা হয় তখনো তিনি ‘ড্যাডি’ হয়ে ওঠেন নি। তাই তার নাম ছাপা হয় ‘গোলাম কাসেম’। এ দেশের আলোকচিত্রীদের পিতা হিসেবে ১৯৬২ সালে তিনি ‘ড্যাডি’ খেতাপ পেয়েছিলেন। ড্যাডি ১৯১৫ সালে ২১ বছর বয়সে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শিবিরে বসে গল্প লিখতে শুরু করেন। তার প্রথম গল্প ‘সুন্দরী’ ছাপা হয় ১৯১৮ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় [প্রথম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, কার্তিক ১৩২৫]। সেই গল্প পড়েই কিংবদন্তি সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন তাকে সওগাতে গল্প লিখতে অনুরোধ করেন। সেই থেকে মাসিক সওগাতে তার নিয়মিত গল্প ছাপা হয়। সওগাতযুগে তাকে মুসলমান বাংলা সাহিত্যের ‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ বলা হতো-- লিখেছেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম তার লেখালেখির সঙ্গে তেমন পরিচিত নয়। আজ ৫ নভেম্বর ড্যাডির ১৩০তম জন্মদিন উপলক্ষে এই অগ্রন্থিত গল্পটি বিডিনিউজের পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হলো। ড্যাডি ও তার সময়কে বুঝতে ছয় দশক আগের বানান হুবহু রাখা হয়েছে। ১০৪ বছরের জীবনকালে ষাটের অধিক গল্প লিখেছেন ড্যাডি। আমার সম্পাদিত ‘ড্যাডিসমগ্র’ গল্পখণ্ডে তার ৪৭টি গল্প অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছি। বাকি গল্পগুলো খুঁজে ফিরছি। তবে শত বছর আগে লেখা ‘ডাক্তার বাবু’ গল্পটি পাওয়া গেলে তা হবে আমাদের কথাসাহিত্যের জন্য এক পরম পাওয়া। --সাহাদাত পারভেজ
এক
শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের টুকরাগুলি লঘু পদে ছুটিয়া যাইতেছে, আর নীচে পাহাড়িয়া নদীর বুকে, অফুরন্ত বিচিত্র ছবি টানিয়া চলিয়াছে। নদীর অপর পারে কিছু দূরের পাহাড়গুলি তাহাদের বিরাট ও সৌম্য সৌন্দর্য্য লইয়া স্তব্ধ ভাবে দাঁড়াইয়া আছে। বিকালের সূর্য্যরে কোমল রশ্মি রঙ্গের তুলিতে রং চড়াইয়া প্রকৃতরি শ্রীকে অপরূপ করিয়া তুলিয়াছে।
নদীর তীরে একটি রমণী ইজল্ খাটাইয়া এই অদ্ভুত দৃশ্যের ছবি আঁকিতেছিল। রমনীর সমস্ত অন্তরাত্মা ছবি আঁকিতে ব্যস্ত। নারী জগতের সব কিছু ভুলিয়া এই রূপের নেশার মধ্যে নিজকে ডুবাইয়া রাখিয়াছে।
হঠাৎ পিছন হইতে কে বলিয়া উঠিল, “ফাইন ভারী চমৎকার।’’
নারী চমকিত হইয়া পিছন ফিরিয়া দেখিল, ত্রিশ বত্রিশ বৎসরের একজন পুরুষ। লোকটির বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম, দেহ বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট, গায়ে হাফ শার্ট, পরনে খাকি শর্ট। তাহার গলা হইতে একটি মিনিয়েচার, ক্যামেরা কেস্ সহিত ঝুলিতেছে।
পুরুষটি আবার বলিল, ‘‘চমৎকার হয়েছে ছবিখানি। যেমন সিনারি তেমনি তার উপযুক্ত আর্টিষ্ট।’’
এবার রমণী নিজেকে সংযত করিয়া লইয়া বলিল, ‘‘আপনি কে? আর এখানেই বা কেন? আগন্তক মৃদু হাসিয়া বলিল, “আমি? আমি একজন সামান্য লোক, কি-ই-বা এমন পরিচয়। তবে আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য আপনারই মত। আপনি এখানে এসেছেন ছবি আঁকতে, আমি এসেছি ফটো তুলতে। হ্যাঁ, আজ আমি খুব লাকি। দেখুন না, আপনার একখানা ক্যানডিড্ ছবি তুলে নিলাম, কিছু মনে করবেন না যেন। হ্যাঁ তা আপনি এখানে কি একলা এসেছেন? আপনি থাকেন কোথায়?’’
একজন পুরুষ অযাচিত ভাবে তাহার নিকট আসিয়া তাহার কাজে বাধা দেওয়ার রমণী প্রথমেই বিরক্ত হইয়াছিল, এখন আবার তাহার ফটো তুলিয়াছে জানিয়া সে রীতিমত চটিয়া গেল।
ফোল্ডিং ক্যানভাস্ টুল ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বিরক্ত স্বরে সে বলিল, ‘‘আমি কে আর কোথায় থাকি, তা জানবার আপনার কোনও দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। আপনাকে আমি নিমন্ত্রণ করিনি এখানে আসবার জন্যে। আপনি আমার কাজে কতখানি বাধা দিয়েছেন তা কি আমার খুলে বলতে হবে? আর আমার ফটো তুলবার অনুমতিই বা আপনাকে কে দিল?’’
পুরুষটি পকেট হইতে একটি সিগারেট বাহির করিয়া তাহা হাতে পাকাইতে পাকাইতে বলিল, ‘এক্সকিউজ্ মি, বিশ্বাস করুন, ক্যামেরা নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এখানে এসে পড়েছি। আর আপনার যে ফটো নিলাম, সেটাত পোর্ট্রেট নয়, ওটা আপনি আঁকছেন তারই ফটো, ওটাকে genre [শৈলী] ফটো বলা চলে। আশা করি কাজটা এমন কিছু অন্যায় হয় নি?’’
ছবি আঁকার সাজসরঞ্জামগুলি প্যাক করিতে করিতে রমণী বলিল, ‘‘না, খুব ভাল কাজ করেছেন। এখন দয়া করে একটু যদি আমায় রেহাই দেন ত বড় বাধিত হব। আর, আমার ছবির নেগেটিভখানা আমার চাই। ও নেগেটিভে আপনার কোনও অধিকার নেই। আশাকরি এটুকু ভদ্রতা আপনি করবেন।’’ তাহার প্রতি কথায় শ্লেষ ঝরিয়া পড়িতেছিল।
পুরুষটি কহিল, ‘‘তাইত, ভারি অন্যায় করে ফেলেছি দেখছি। আচ্ছা আমি যাচ্ছি। তবে একটা ব্যাপার বড্ড গোলমেলে ঠেকছে। আপনার মত একজন যুবতী নারীর পক্ষে এইরকম লোকজনশূন্য জায়গায় একাকি থাকাটা সত্যিই বিস্ময়ের জিনিষ, বিপজ্জনকও বটে। আপনি কি এখানেই থাকেন? মানে আপনি কি এখানকার ষ্টেশন মাষ্টারের কোনও আত্মীয়া হবেন? কিন্তু তাই বা হয় কি করে? মাষ্টার ত নেপালী। আর আপনি ত আমারই মত একজন খাঁটি বাঙ্গালী।’’
রমণী তেমনি ঝাঁঝাল স্বরে উত্তর দিল, ‘‘উত্তরটা শুনলেই যদি আপনি খুশী হয়ে চলে যান, তা হলে শুনুন। আমি টাউন থেকে আসছি। ট্রেনে ফিরে যাব এখন।’’
পুরুষটি হাতে সিগারেটখানি ধরাইয়া তাহাতে একটি টান দিয়া বলিল, ‘‘বিশ্বাস করুন, আপনার কথাটা কিন্তু একটা মস্ত হেঁয়ালীর মত শোনাল। আপনি বলছেন, ট্রেনে ফিরে যাবেন এখন, কিন্তু ট্রেন কোথায়?’’
নারী দৃঢ়কণ্ঠে বলিল, ‘‘মিথ্যা কথা! আপনার মতলবটা কি বলুন-ত? ছ’টায় একটা ট্রেন রয়েছে না?
পুরুষটি বলিল, ‘‘ছ’টা দু-মিনিটে যে ট্রেন ছিল তা আজ থেকে উঠে গেছে। তার বদলে পাঁচটা তের মিনিটের ট্রেন হয়েছে। এখন পাঁচটা চৌত্রিশ। বিশ্বাস না হয়, ষ্টেশনে খবর নিন। আচ্ছা, আসি তা হলে।’’ এই বলিয়া সে ষ্টেশনের দিক পদক্ষেপ করিল।
কি ভাবিয়া রমণী ডাকিল, ‘‘একটু দাঁড়ান।’’ রমণীর আহ্বানে লোকটি ফিরিয়া দাঁড়াইল। ইতিমধ্যে ছবি আঁকিবার জিনিষপত্রগুলি গুছান শেষ হইয়াছিল। শাড়ীর আঁচল দিয়া ঘর্মশিক্ত মুখখানি মুছিতে মুছিতে সে বলিল, ‘‘শুনছেন। আচ্ছা, ট্রেন যদি চলেই গিয়ে থাকে তা হলে Next train ক’টায়? আপনি নিশ্চয়ই এখানে থাকেন না, আর আপনাকেও ত ফিরতে হবে?’’
ভদ্রলোকটি বলিল, ‘নেকষ্ট ট্রেন কাল সকাল ৯টা ১৮ মিনিটে। আর, আমি ট্রেনে যাব না। আমার জীপ্ আছে, জীপে এসেছি জীপেই চলে যাব।’’
‘‘আপনিও কি শহর থেকে আসছেন?’’
‘‘না, আমি হাতীখেদায় থাকি। এখান থেকে সতের মাইলের মত হবে। আসবার সময় ষ্টেশনটা হয়ত লক্ষ্য করেছেন। ওধারে একটা চা বাগান আছে, ওখানেই থাকি। আপনার জিনিষপত্র ত সব গুছিয়ে নিয়েছেন দেখছি। দিন ওগুলো আমায়। ষ্টেশন পর্য্যন্ত পৌঁছে দেই।’’
রমণী প্রথমে একটু আপত্তি করিল, কিন্তু পরে তাহার অনুরোধ অগ্রাহ্যও করিতে পারিল না।
ষ্টেশনে আসিয়া খবর লইয়া রমণী জানিল ভদ্র লোকটির কথা সত্য। ফিরিয়া যাইবার কোনও ট্রেন সে দিন আর নাই।
রমণীর দিকে চাহিয়া একটু মৃদু হাসিয়া লোকটি বলিল, ‘দেখলেন ত?’’
সে হতাশ স্বরে বলিল, ‘‘তাই ত। তা হলে উপায়? রাত কাটাবার মত এখানে কোনও ব্যবস্থা আছে বলে ত মনে হচ্ছে না।”
লোকটি বলিল, ‘‘আপনার চিন্তার কোনও কারণ নেই। আমার গাড়ীতে চলুন, আমার ওখানে গিয়ে উঠবেন। কোনও অসুবিধা হবে না। ওখান থেকে সকালে সাড়ে ছয়টার একটা ট্রেন ছাড়ে, তাতে আপনি চলে যেতে পারবেন। হ্যাঁ, ভাল কথা, একটা খবর ত আপনার বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। কি ঠিকানায় খবরটা পাঠান যায় বলুন ত?’’
রমণী বলিল, “আমার নাম শেফালী রায়। ডুয়ার্সে থাকি। ওখানকার মেয়ে স্কুলের মিষ্ট্রেস্। স্কুলের সাথে কোয়াটার্স আছে, সেইখানেই আমি থাকি। হেড্ মিষ্ট্রেস, ডুয়ার্স গার্লস স্কুল, এই ঠিকানায় খবর দিলেই হবে।’’
‘‘ঠিক আছে। আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি মেসেজ্টা এখুনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। হ্যাঁ, কিছু মনে করবেন না। আপনি মিস্ না মিসেস্ খবরটা পাঠাবার সময় ওটা দরকার হতে পারে।’’
শেফালী বলিল, ‘‘আমার মিস্ বলতে পারেন। ভাল কথা, খবরটা নিয়ে যান।’’
‘‘ঠিক আছে, ওর জন্যে ব্যস্ত হবেন না।’’ বলিয়া ভদ্রলোকটি ষ্টেশন কক্ষে চলিয়া গেলেন। মিনিট দশ পরে লোকটি ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘‘আপনার খবর পাঠিয়ে দেওয়া হল। লাইন ক্লিয়ার আছে। রাত আটটার মধ্যেই খবর পৌঁছে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’’
শেফালী তাহার শিথিল খোঁপাটি একবার দুহাতে চাপিয়া বসাইয়া বলিল, “ধন্যবাদ। ভাল, আমার পরিচয় ত পেলেন, এবার আপনার পরিচয়টা দিলে ভাল হয়।’’
ভদ্রলোকটি হাসিয়া বলিলেন, আমার পরিচয়ের জন্যে আপনি ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন দেখছি। আচ্ছা সেটা হবে এখন। এবার একটু জলযোগের বিশেষ দরকার হয়ে পড়েছে। পেটের তাগিদটা খুব প্রখর হয়ে উঠেছে। চলুন, কাছেই একটা চমৎকার জায়গা আছে। সেখানে বসে টিফিনটা শেষ করা যাক্।’’ এই বলিয়া সে জীপ হইতে একটি টিফিন কেরিয়ার ও একটি ফ্লাস্ক বাহির করিয়া শেফালীর সহিত একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে চলিল।
যাইতে যাইতে শেফালী বলিল, ‘‘আপনি বরং খান, আমার খাবার ইচ্ছে নেই।’’
‘পেটকে বৃথা বঞ্চিত করে মিথ্যে কষ্ট পাবেন কেন? এটা কিন্তু মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আপনি কখন খেয়ে বেরিয়েছেন তা আমার জানা আছে। না না, ও সব বাজে কথা রাখুন। আমার সঙ্গে একটু চা খেলে আপনার মর্য্যাদার কোনই হানি হবে না এটা, আপনি বিশ্বাস করুন।’’
ষ্টেশনের খুব কাছেই জায়গাটা। বেশ চমৎকার জায়গা। কৃষ্ণচূড়া গাছটি তাহার ঘোর সবুজ সাজান পাতাগুলি মেলিয়া ধরিয়া চোখে একটা নিবিড় তৃপ্তি আনিয়া দিতেছে। গাছের ফাঁকে একটু দূরেই নদীটাকে দেখা যাইতেছে। তাহারা চঞ্চল গতিছন্দে সোনায় কিরণ ঝিলিক মারিতেছে।
উভয়ে পরোটা ও মাংস সহযোগে চা পান করিতে লাগিল। শেফালীর যৌবনদীপ্ত মুখের উপর সূর্য্যের এক ফালি সোনালী আলো পড়িয়া তাহাকে অপরূপ করিয়া তুলিয়াছিল। লোকটি তাহার মুখের দিক প্রশংস দৃষ্টিতে ঘন ঘন চাহিতে লাগিল।
শেফালী বিরক্তির ভঙ্গিতে বলিল, ‘‘অমন করে চেয়ে আছেন কেন?’’
‘‘বিশ্বাস করুন, আপনাকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। একখানা যদি পোর্ট্রেট নিতে পারতাম! কিন্তু আপনি ত তাতে রাজি নন, সে ত আগেই ভাল করে জানিয়ে দিয়েছেন।’’
“সুন্দরী বলিলে নারী খুশী হয় না এমন নারী জগতে খুবই বিরল। রূপের প্রশংসায় সে খুশী হইলেও মুখে বলিল, ‘‘থাক্ থাক্, আর আমার রূপের ব্যাখ্যার কাজ নেই”।
লোকটি মৃদু হাসিয়া বলিল, ‘‘ও, আচ্ছা মাফ করবেন। অন্যায় হয়ে গেছে।’’
জলযোগ শেষ করিয়া উভয়ে মোটরের নিকট আসিয়া দাঁড়াইল। জিনিসপত্রগুলি মোটরে গুছাইয়া রাখিয়া লোকটী বলিল, ‘‘উঠে পড়ুন। সন্ধ্যা হয়ে গেল। যাওয়া যাক এবার।’’
গাড়ীতে না উঠিয়া শেফালী বলিল, ‘‘আপনি কি বিবাহিত?’’
‘‘হ্যাঁ’’।
‘‘আপনার পচিয় কিন্তু এখনও পেলাম না?’’
‘ও-- বেশ-- আমার নাম বিকাশ সোম। হাতীখেদা টি এষ্টেটের ম্যানেজার। এবার খুশী হলেন বোধ হয়?”
দুই
বিকাশের পরিচয় শুনিয়া শেফালী চমকিয়া উঠিল। সে বলিল, ‘‘আপনি চা বাগানের ম্যানেজার। তাই ত, আর আমায় আপনারই সাথে যেতে হবে?”
‘‘কেন? চা-বাগানের ম্যানেজাররা বাঘ না ভালুক?’’
‘‘মাফ করবেন মিঃ সোম, কিন্তু চা-বাগানের ম্যানেজারদের চরিত্র সম্মন্ধে নানারকম শোনা যায়।’’
বিকাশ একটা উচ্চহাস্য করিয়া বলিল, “তা যদি বল্লেন, তবে বিশ্বাস করুন, স্কুলের মিষ্ট্রেস্দের সম্বন্ধেও মাঝে মাঝে-- কি বলে ইয়ে--।’’
শেফালী বাধা দিয়া বলল, ‘‘থাক্ থাক। এখন কথা হচ্ছে এই, আপনার সঙ্গে আমার যাওয়া ছাড়া কি আর কোনও উপায় নেই?”
বিকাশ বলিল, ‘‘হ্যাঁ, উপায় আছে বই কি। আপনি ইচ্ছা করলে নেপালি মাষ্টার তারা সিং-এর বাসায় রাত কাটাতে পারেন, অবশ্য তার এখানে মেয়ে ছেলে কেউ নেই। আর না হয়, একটা ভুটিয়া [ছোট আকৃতির] ঘোড়া ভাড়া নিয়ে সোজা ডুয়ার্সের দিকে রওয়ানা হয়ে যেতে পারেন। যেমন আপনার অভিরুচি।’’
শেফালী একটু কঠিন স্বরে বলিল, ‘‘ঠাট্টা তামাসার কি এইটিই প্রশস্ত সময় মিঃ সোম?”
বিকাশ বলিল, ‘‘না, না, বিশ্বাস করুন। আমি ঠাট্টা করছি না। আপনি উপায়ের কথা বলছিলেন, আমি তারই জবাব দিয়েছি। এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় ত নেই।”
পাহাড়ের দিক হইতে একটি দমকা বাতাস আসিয়া শেফালীর আঁচলখানি স্থানচ্যুত করিল। আঁচলখানি তাড়াতাড়ি বুকের উপর চাপিয়া ধরিয়া হতাশ স্বরে সে বলিল, ‘‘না, উপায় আর কিই বা থাকতে পারে। সবই আমার অদৃষ্ট, তা না হলে ভবেশটা ট্রেন মিস করে?”
বিকাশ একটু চমকিত হইয়া বলিল, ‘‘ভবেশ সে আবার কে?’’
শেফালী বলিল, ‘‘ভবেশ আমার ছোট ভাই। আমার সাথে ওর আসার কথা ছিল, কিন্তু ও গাড়ী একটুর জন্য মিস্ করল।”
বিকাশ হাসিয়া বলিল, দেখছি ট্রেন মিস্ করা আপনাদের ফ্যামিলির একটা বিশেষত্ব। তা এবার উঠে পড়ুন, আর দেরী নয়।” এই বলিয়া সে গাড়ীতে উঠিয়া ষ্টিয়ারিং ধরিল।
শেফালী পিছনের সিটের দিক চলিল। বিকাশ ডাকিয়া বলিল, ‘‘সামনে আসুন।”
‘‘না এখানেই বেশ হবে” এই বলিয়া সে পিছনের সিটে গিয়া বসিল।
গাড়ী ছাড়িল। বন জঙ্গলের ভিতর দিয়া পাহাড়িয়া পথে জিপ্ ছুটিয়া চলিল।
দেখিতে দেখিতে আঁধার নামিয়া আসিল। জীপের তীব্র হেড্লাইট দুটি জ্বলিয়া উঠিল। আলোর স্পর্শে আঁধারের কোলের লুকান দৃশ্যগুলি সিনেমার ছবির মত ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। পথ কোথাও খাড়াই কোথাও উতরাই, কোথাও বা পাহাড়ের কোলের বাঁক অতিকায় অজগর সাপের মত ঘুরিয়া অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে। পথের দুপাশে বড় বড় গাছ, শুদ্ধ প্রহরীর মত দাঁড়াইয়া আছে।
একে ত জীপের আরোহী মাত্র দুজন, তাহার উপর পথও অসমতল, কাজেই মাঝে মাঝে গাড়ী অত্যন্ত লাফাইয়া উঠিতে লাগিল। শেফালী কয়েকবার ঝাঁকুনি খাইল, তাহার পর তাহার মাথাটি বেশ ঠুকিয়া গেল। আঘাত পাইয়া চীৎকার করিয়া সে ডাকিল, ‘‘শুনছেন? ও মিঃ সোম, শুনছেন?”
গাড়ীর স্পিড্ শ্লো করিয়া একটুখানি ঘাড় ফিরাইয়া। বিকাশ বলিল, ‘‘কি বলছেন?”
শেফালী মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, ‘‘একটু আস্তে চালান না? মাথাটা যে গেল একেবারে!”
বিকাশ চীৎকার করিয়া বলিল, ‘‘আস্তেই ত যাচ্ছি। তা পেছনে বসলে ওরকম একটু আধটু অসুবিধা ভোগ করতে হয়, কি করব বলুন?” সে আবার গাড়ীর স্পিড কিছুটা বাড়াইয়া দিল। শেফালী নিরুপায় হইয়া কষ্ট সহ্য করিতে লাগিল।
প্রায় পনের কি কুড়ি মিনিট পর হঠাৎ গাড়ী দাঁড়াইল। দুপাশে খাড়া পাহাড় বাহিরের সব কিছু ঢাকিয়া রাখিয়াছে। শেফালীর মনে হইল দুর্ভেদ্য প্রস্তর কারাগারে কে তাহাকে বন্দী করিয়া ফেলিল। ভয়ে সে চিৎকার করিয়া বলিল, ‘‘আপনি থামলেন যে?”
বিকাশ সিট হইতে নামিয়া পড়িয়া বলিল, “আমি থামিনি, গাড়ীই থেমেছে। দেখি কি হল” এই বলিয়া সে বনেট খুলিয়া টর্চের সাহায্যে এঞ্জিন পরীক্ষা করিতে লাগিল।
শেফালী গাড়ীর ভিতর হইতে বলিল, ‘‘সত্যিই কি এঞ্জিনের কিছু গোলমাল হয়েছে? মিঃ সোম আমার কিন্তু বড্ড ভয় করছে।”
বিকাশ টর্চের সাহায্যে কলকব্জাগুলি দেখিতে দেখিতে বলিল, ‘‘এই যে কারবুরেটর। হ্যাঁ-- বিশ্বাস করুন, এখুনই ঠিক হয়ে যাবে।”
শেফালী কিছুটা আশ্বস্ত হইয়া বলিল, ‘‘তবুও ভাল। যত শিগ্গীর পারেন আমার ঠিকানায় পৌঁছে দিন, কেমন?”
বিকাশ কোনও উত্তর দিল না। গোলমাল মেরামতে ব্যস্ত রহিল।
শীঘ্রই দোষ সংশোধন করিয়া যে একটি সিগারেট ধরাইয়া শেফালীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। সিগারেটে একটি প্রকাণ্ড টান দিয়া অনেকখানি ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল, ‘‘আপনার বুঝি খুব ভয় পাচ্ছে?”
শেফালী বলিল, ‘ভীষণ।”
‘‘এ পথে অবশ্য রাতে কখন কখন বনের জানোয়ারের সঙ্গে দেখা হয়, তবে মোটরের হেড্লাইটকে ওরা বেশ একটু শ্রদ্ধা করে চলে।”
শেফালী ধীরে ধীরে বলিল, ‘‘না ঠিক তা বলছিলাম না। তবে কি না-- সে কথা শেষ না করিয়াই থামিয়া গেল।
বিকাশ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। তাহার হাস্যধ্বনি দুপাশের খাড়া পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খাইয়া ভীষণ প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করিল।
শেফালী বিরক্ত স্বরে বলিল, ‘‘এর মধ্যে এত হাসির ব্যাপার কি হল? একজন নারীর পক্ষে এক অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে একাকি এভাবে ভ্রমণ বিপজ্জনক নয়?”
বিকাশ রুমাল দিয়া মুখ মুছিয়া লইয়া বলিল, ‘‘মিস্ রায়, আমার দুর্ভাগ্য আপনার সুবিধার জন্যে আমি হঠাৎ পুরুষ থেকে মেয়েছেলে হয়ে যেতে পারছি না। বিশ্বাস করুন, সম্ভব হলে তা করতাম। তা যখন সমস্ত জেনে শুনেও আমার সাথে বেরুবার দুঃসাহস হয়েছে, তখন আর ওসব কথা চিন্তা করে লাভ কি? তা যদি আমায় বাঘ, ভালুক, হাতী-- এসবের চেয়েও বেশী ভয় লাগে আপনার, তবে বলুন, এখানেই আপনাকে নামিয়ে দিই।”
জনমানবশূন্য আঁধার ধরণী, একটু দুরেই কিসের শব্দ হইল, “ঘ্যাক্ ঘ্যাক।”
শেফালী চমকিয়া উঠীয়া বলিল, “ওটা কিসের শব্দ?”
বিকাশ উদাস স্বরে বলিল, ‘‘কি আর এমন হবে? ওটা লেপার্ড বলেই মনে হচ্ছে।”
শেফালী গাড়ীর সিটে সঙ্কুচিত হইয়া বসিয়া শিহরিয়া বলিল, লেপার্ড? আপনি শিগ্গীর গাড়ীতে উঠে ষ্টার্ট দিন।”
বিকাশ গাড়ীতে উঠীয়া ষ্টিয়ারিং ধরিয়া বলিল, ‘‘বিশ্বাস করুন ও আমাদের কোন ক্ষতি করবে না।”
শেফালীর উত্তর সে শুনিতে পাইল না। এঞ্জিন গর্জন করিয়া উঠিল। জীপ্ আবার গন্তব্য পথে ছুটিল।
তিন
বিস্তৃত চা বাগানের ভিতর কয়েকটি বাঙ্গলো প্যাটানের বাড়ী, তাহার একটু দূরে কেরানীদের কোয়াটার্স, আর এক দিকে কুলিদের বস্তি। বাঙ্গলোগুলির মধ্যে যেটি সবচেয়ে বড় ও সুন্দর তাহারই সম্মুখে জীপ আসিয়া দাঁড়াইল।
দু’জন চাপরাশি ছুটিয়া আসিয়া সালাম করিয়া গাড়ীর পাশে দাঁড়াইল। শেফালীকে লইয়া বিকাশ নামিয়া পড়িল। লোক দুটি গাড়ীর জিনিষপত্রগুলি নামাইয়া লইল।
বাঙ্গলোর বাহিরটি যেমন সুন্দর ভিতরটিও তেমনি পরিপাটি। অনেকগুলি ঘর। শেফালীকে নিয়ে বিকাশ ড্রইংরুমে বসাইল।
ড্রইংরুমটি আধুনিক আসবাবপত্রে সজ্জিত। দেয়ালে বহু সুদৃশ্য ছবি বিরাজ করিতেছে। শেফালী নিজে আর্টিস্ট, কাজেই সে ঘুরিয়া ফিরিয়া উজ্জ্বল ইলেকট্রিক লাইটে ছবিগুলি দেখিতে লাগিল।
একটু পরে সে বলিল, ‘‘ভারি সুন্দর ছবিগুলি। ফটোগুলি বোধ হয় আপনারই তোলা?”
বিকাশ আনন্দিত হইয়া বলিল, ‘‘ফটোগ্রাফী আমার একটা ভীষণ নেশা। এ ছাড়া আর কোনও নেশা আমার নেই, এটা আপনি বিশ্বাস করুন। হ্যাঁ, ফটোগুলি আমার নিজের হাতেরই তোলা, শুধু তোলা নয়, ডেভেলপ করা, প্রিন্ট করা, এনলার্জ করা, ফিনিশ করা সবকিছুই। একজন আর্টিস্টের কাছে ওগুলো যে মর্যাদা পেল তার জন্যে আমি বেশ একটু গর্ব অনুভব করছি।”
একটু পরে শেফালী বলিল, ‘‘কই, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিন?”
বিকাশ একটু যেন চমকিত হইয়া বলিল, ‘‘আমার স্ত্রী? ও, তা শিগগীরই তার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। আসুন আপনি আমার সাথে।”
শেফালী তাহার সহিত একটা শয়ন কক্ষে প্রবেশ করিল। তাহাদের সহিত একজন মধ্যবয়সী কুলি রমণীও গেল।
শয়ন কক্ষের এক পাশে একটা পালঙ্ক, তাহাতে পরিষ্কার, সুদৃশ্য, মূল্যবান শয্যা। পাশে একটি ড্রেসিং টেবিল, প্রসাধনের সব কিছুই তাতে আছে। আর এক পাশে একটি আলনা তাহাতে নানা রূপ শাড়ী ও ব্লাউজ ঝুলিতেছে।
বিকাশ বলল, ‘‘এইটি আপনার ঘর। পাশেই বাথরুম। আলনা থেকে ইচ্ছামত কাপড় চোপড় নেবেন। লুসিয়া রইল, ও আপনাকে সাহায্য করবে। আচ্ছা আমি এখন একটু আসি। কয়েকটা কাজ সেরে আবার আসব আপনার কাছে।” এই বলিয়া সে কক্ষ হইতে বাহির হইয়া গেল।
পালঙ্কের সম্মুখে দেওয়ালে একখানি প্রকাণ্ড ফটো টাঙ্গান ছিল। একটি অতি সুশ্রী নারীর ব্লাক অ্যান্ড হোয়াইট্ ফটো। ফটোখানির লাইট শেডের সমন্বয় অপূর্ব। উহা ছবিখানিকে সজীব করিয়া তুলিয়াছে।
শেফালী লুসিয়াকে জিজ্ঞাসা করিল, এ ছবিখানি কার? ইনিই কি সায়েবের স্ত্রী?”
লুসিয়া বলল, ‘‘না সায়েবের ত স্ত্রী নেই। এ ছবিখানি ওর কোনও আত্মীয়ের হবে আমি ঠিক জানি না।”
শেফালী স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ঐ ছবিখানির চেহারা তাহার চেনা চেনা বোধ হইতে লাগিল। কিন্তু উহা কে, তাহা ঠিক স্মরণ করিতে পারিল না।
খানিকক্ষণ ছবির দিক চাহিয়া তাহার পর নিজের মনে মনেই বলিয়া উঠল, ‘‘মিথ্যুক, ধাপ্পাবাজ।”
সে আবার লুসিয়াকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘‘যদি ওর স্ত্রী নেই তবে এ ঘরে মেয়েছেলের কাপড় চোপড় কেন?”
লুসিয়া মৃদু হাসিয়া বলিল, ‘‘কখন কখন মেয়েছেলে আসেন। আসলে তারা এই ঘরে থাকেন। এই যেমন আপনি এসেছেন।”
“ও” বলিয়া শেফালী লুসিয়াকে লইয়া বাথরুমের দিক চলিয়া গেল।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পর একখানি ভিজা রোল ফিল্ম হাতে ঝুলাইয়া লইয়া বিকাশ শেফালীর সম্মুখে আসিয়া বলিল, ‘‘এই দেখুন, ফ্লিমখানা ডেভেলপ করে নিয়ে এলাম। আপনার একখানি ফটোই তুলেছিলাম, এই তার নেগেটিভ। বিশ্বাস করুন, ফিল্ম সুখিয়ে [শুকিয়ে] গেলে নেগেটিভখানা আপনাকে দেব।”
শেফালী নেগেটিভের দিক এক লহমা চাহিয়া লইয়া বলিল, ‘ধন্যবাদ। একটা কথা আপনাকে বলতে চাই। আপনি দয়া করে আমার শোবার ব্যবস্থা আর কোথাও করে দিলে বাধিত হব।”
বিকাশ বিস্মিত কণ্ঠে বলিল, ‘কেন? এখানে কি আপনার কোনও অসুবিধা হবে?”
শেফালী দৃঢ় কণ্ঠে বলিল, ‘হ্যাঁ, আমার তাই বিশ্বাস।”
বিকাশ একটি শুষ্ক হাসি হাসিয়া বলিল। ‘ও, আই সি। দেখ লুসি, হালদার সাহেবকে বলে আয় ইনি ওদের ওখানেই থাকবেন?”
শেফালীর দিক চাহিয়া বলিল, ‘‘হ্যাঁ, মিঃ রায়, আমার মনে হয় ওখানে আপনি বেশ আরামেই কাটাবেন। ওখানে হালদার, হালদারের স্ত্রী। আটটি ছেলে-মেয়ে, দুটি ভাগ্নে, বৃদ্ধা মা। এক বিধবা ভগিনী-- এরা অনেকেই আছেন। ওখানে নিরাপদে থাকবেন বলে আমার বিশ্বাস তবে রাতের খাওয়াটা আমার এখানেই শেষ করলে ভাল হত না? ‘আশা করি এ সৌভাগ্যটুকু থেকে আমি বঞ্চিত হব না!”
শেফালী পুনরায় সেইরূপ মৃদুস্বরে বলিল, “মাফ করবেন। আমি আর আপনার ঋণ বাড়াতে চাই না। আর আমার ক্ষিদেও নেই। রাতে কিছু না খেলেও চলে।”
সে রাত্রে শেফালী মিঃ হালদারদের ওখানেই রহিল। সামান্য একটু আহার করিয়া সকাল সকাল বিছানায় আশ্রয় লইল। কিন্তু চোখে ঘুম আসিতে বেশ অনেকখানি বিলম্ব হইল। গভীর রাত্র পর্য্যন্ত বিকাশের নানা কথা সে চিন্তা করিয়া অবশেষে ঘুমাইয়া পড়িল।
ভোর হইতেই সে বিছানা ছাড়িয়া হাত মুখ ধুইয়া কাপড় পরিয়া যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইল তাহার গাড়ী সাড়ে ছয়টায়।
ছয়টার সময় বিকাশ জীপ্ লইয়া হালদার সায়েবের বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল শেফালী বাহির হইয়া আসিতে সে বলিল, ‘‘নমস্কার মিস্ রায়। আশা করি রাতে বেশ সুনিদ্রা হয়েছে? একেবারে তৈয়ার হয়ে গিয়েছেন দেখছি। গুড্, উঠে পড়ুন। ষ্টেশন যাওয়া যাক। আমার খুবই দুর্ভাগ্য যে একটু চা খাওয়ার অধিকারটুকুও আমার নেই। এই নিন্ আপনার নেগেটিভ।” এই বলিয়া সে কাগজে মোড়া নেগেটিভখানি শেফালীর হাতে দিল।
আজ অপর একজন লোক ড্রাইভ করিতেছিল। শেফালীকে সম্মুখে ড্রাইভারের পাশে বসিয়া সে নিজে পিছনে বসিল। গাড়ী ষ্টেশনের দিক ছুটিল।
ষ্টেশনে পৌঁছিলে শেফালী বলিল, ‘‘আপনি আমার জন্যে এত কষ্ট করছেন কেন? আমার বিশেষ অনুরোধ এবার আমায় মুক্তি দিন। এখন ত আর আপনার সাহায্যের কোনও দরকার নেই?’’
বিকাশ বলিল, “বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে বন্দী করে রাখিনি যে আপনাকে মুক্তি নিতে হবে।” আর কষ্ট? কেন আপনি ত হালদারদের অতিথি হয়ে আমায় সব দায়িত্ব থেকে ছুটি দিয়েছেন। আর কথাটা হচ্ছে এই আমায় একবার কুচবিহারের দিকে যেতে হবে। চলুন খানিকটা পথ এ অভাগাটার সঙ্গেই। রাত্রে যখন একা আমার সাথে মোটরে আসতে পেরেছেন তখন দিনের বেলায়, এত লোকের মধ্যে আমার সাথে আর একটুখানি যাবেন, এতে আপনার যে কোনও অসুবিধা হতে পারে তা ত মনে হয় না।”
শেফালীর আপত্তি স্বত্তেও বিকাশ ফার্স্টক্লাসের দুখানি টিটিক কিনিল ও ট্রেন আসিলে একখানা কামরায় দুজনে উঠিয়া পড়িল।
ট্রেন ছাড়িয়া দিল।
চার
দু’জনে সামনা-সামনি দুটি বার্থে। হঠাৎ শেফালী বলিল, ‘‘আপনি এত মিথ্যে কথা বলেন কেন?”
সিগারেটের ধুম সুক্ষ ধারায় ছাড়িয়া বিকাশ বলিল, ‘‘মিথ্যা কথা? কই, না ত?”
“আপনি যে বললেন আপনি বিবাহিত, অথচ দেখলাম তা নয়।”
“ও, আপনাকে দেখছি সব কথা খুলে না বললে চিরদিনই আমার সম্বন্ধে একটা জঘণ্য ধারণা থেকে যাবে। বিশ্বাস করুন, আমি বিবাহিত ও আমার স্ত্রীও আছে।”
“কই, দেখলাম না ত তাঁকে?”
“তিনি আছেন ঠিকই তবে কি না তিনি চলে গেছেন, আমার কাছে নেই।”
বিস্ময় ও কৌতূহলের আতিশয্যে শেফালী সোজা হইয়া বসিয়া বলিল, “ছেড়ে চলে গেছেন? সে কি? আপনায় তিনি ছেড়ে চলে গেলেন? কোথায় গেলেন? কারণটাই বা কি?”
“চলে গেলেন আর একজনার সাথে। তার কারণটা খুবই সোজা। আমায় তাঁর ভাল লাগল না।”
“আপনি এ সম্বন্ধে কিছু করলেন না?”
জানালার বাহিরে ছুটন্ত দৃশ্যগুলির দিকে চাহিয়া বিকাশ বলিল, “কি আর করব বলুন? গরু ছাগল না যে তাড়িয়ে আবার খোয়াড়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসব। মানুষটাকে না হয় কোনও রকমে নিয়ে আসা গেল, কিন্তু মনটা?”
‘‘আচ্ছা কি নিয়ে আপনাদের বিচ্ছেদটা হল? মাফ করবেন বড্ড বেশী কৌতূহলী হয়ে পড়ছি?”
বাহির হইতে মুখ ফিরাইয়া বিকাশ বলিল, ‘‘না কিচ্ছু না। তাঁর সঙ্গে ঝগড়ার কারণ এই ফটোগ্রাফী!”
“সে কি?”
আমি সব সময়ই মেয়েদের পেছনে ক্যামেরা নিয়ে ছুটে বেড়াই-- এই সব আর কি। আর্ট জিনিষটা বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কোনও ফল হয় নি।”
“আচ্ছা! যে ঘরে আমার থাকবার ব্যবস্থা করেছিলেন সেখানে একখানা বড় ফটো টাঙ্গান ছিল। যেমন চমৎকার মেয়েটি তেমনি চমৎকার ছবিখানি।
ও ছবিখানা কার?”
“উনিই আমার স্ত্রী।”
বিস্ময় স্বরে শেফালী বলিল, “ছবিখানা যে এখনও রেখেছেন?”
“আর্টের পূজারি বলেই রেখেছি, আমার স্ত্রী হিসেবে ওটা রাখি নি।”
এক টুকরা কয়লা উড়িয়া আসিয়া শেফালীর চোখে পড়িল। সে তাহার চোখ হাত দিয়া দলিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে তাহার চোখটি লাল হইয়া উঠিল।
বিকাশ নিজের রুমালখানি পকেট হইতে বাহির করিয়া বলিল, ‘‘আমি ওটা বার করে দিচ্ছি। চোখ রগড়ালে আরও কষ্ট পাবেন।” সে নিজের সিট হইতে উঠিয়া অতি সাবধানে রুমালের কোন দিয়া কয়লার গুড়াটি বাহির করিয়া দিল।
চোখের যন্ত্রণার লাঘব হইল। আঁচলে চোখটি একবার মুছিয়া লইয়া সে বলিল, ‘‘আপনি ভারি আশ্চর্য্য লোক। হ্যাঁ কি বলছিলাম। উনি কত দিন হ’ল চলে গেছেন?”
“তা সাত বছর হ’ল।”
‘আশ্চর্য্য! তা বিয়ে করলেন না কেন আবার?”
বিকাশ হাসিয়া বলিল, ‘‘ক্যামেরা নিয়ে মেয়েদের পেছনে ছুটাছুটী করা অভ্যাসটা এখনও যায় নি। সেটা ত আপনিও দেখলেন। না, এই নেশা নিয়ে আর পরের মেয়েকে নিয়ে আসতে সাহস হয় না।”
“আপনার যুক্তি কিন্তু ঠিক না। একজন চলে গেছে বলে যে আর একজনও তাই করবে এর কোনও মানে হয় না।”
বিকাশ হাসিয়া বলিল, “কেন হবে না? একজন চা বাগানের ম্যানেজারের চরিত্র সম্বন্ধে কিছু শুনে যদি সিদ্ধান্ত করে ফেলা যায় যে, সব ম্যানেজারই ঐ রকম তা হ’লে আমিই বা সে রকম ভাবতে পারি না কেন?”
“শেফালী হাত দুটি এক সঙ্গে করিয়া মিনতি স্বরে বলিল, “আমার খুবই অন্যায় হয়ে গিয়েছে বিকাশ বাবু, মাফ চাচ্ছি।”
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সে আবার বলিল, “উনি কার সঙ্গে চলে গেলেন?”
“যার সঙ্গে উনি চলে গেছেন তিনি আমার বিশেষ অন্তরঙ্গ বন্ধু। বন্ধুত্বের চরম পুরষ্কার স্বরূপ তিনি সন্ধ্যাকে নিয়ে চলে গেছেন।”
“তাঁর নামটা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?”
“নিশ্চয়ই এই বন্ধু প্রবরের নাম হিমাংসু বোস।’
শেফালী নিজের বুকখানি দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া কম্পিত কণ্ঠে বলিল, “হিমাংসু? হিমাংসু আপনার স্ত্রীকে নিয়ে গেছে?”
বিকাশ শেফালীর উত্তেজনা লক্ষ্য করিয়া বলিল, “হিমাংসুকে আপনি চেনেন?”
শেফালী, “হ্যাঁ, চিনি বই কি। আপনার ঘরের ছবিখানি দেখে চিনি চিনি করেও চিনে উঠিতে পারিনি; এখন কিন্তু সব পরিষ্কার হইয়া গেল। হিমাংসু আমার স্বামী।”
বিকাশের হাত হইতে অর্দ্ধ দগ্ধ সিগারেটটি তাহার অজ্ঞাতে নীচে পড়িয়া গেল। বিস্মিত কণ্ঠে সে বলিল, “মাই গড্! হিমাংসু আপনার স্বামী? কিন্তু আপনি না বললেন আপনি মিস্?”
“আপনিও বললেন আপনি বিবাহিত। দুজনার অবস্থাই ত দেখছি হুবহু একই। আশ্চর্য্য, ভীষণ আশ্চর্য্য ব্যাপার।”
বিকাশ বলিল, “ভারি মজার ব্যাপার ত? তা আপনার এ ঘটনা কতদিন হল হয়েছে?”
“সাত বছর হবে।”
“ও, তা হলে আপনার বয়স ত দেখছি--”
তাহার মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া শেফালী বলিল।
“হ্যা, ষোল বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়, দুবছর পরই উনি চলে যান। এখন আমার বয়স পঁচিশ।”
“আচ্ছা, আপনার এ দুর্ঘটনার কারণটা কি? আপনিও বুঝি পুরুষের পেছন পেছন ইজল্ ও রঙের তুলি নিয়ে ছুটোছুটি করে বেড়িয়েছেন?”
এবার শেফালী হাসিয়া উঠিল। হাসিয়া বলিল, “ঠিক তাই না হলেও, অনেকটা তাই। ছবি আঁকার ব্যাপারে অন্যান্য পুরুষ আর্টিস্টদের সঙ্গে মেলামেশা করত সে, তারাও অনেকে আমায় মডেল করত। এটা তিনি সহ্য করতে পারলেন না।
প্রভাতি আলো ট্রেনের জানালা দিয়া আসিয়া উভয়েরই মুখের উপর তাহার শোভার হাত বুলাইয়া দিয়াছিল। তাহারা একে অপরের মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে চাহিয়া রহিল।
গাড়ী ষ্টেশনে আসিয়া দাঁড়াইল। কুলিরা হাঁকিল, ‘ডুয়ার্স, আলিপুর ডুয়ার্স!
শেফালী সম্বিৎ [চেতনা] হারাইয়া শুদ্ধভাবে নিজের সিটে বসিয়াই রহিল।
একটি তরুণ ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া জানালার নিকট দাঁড়াইয়া ডাকিল, ‘‘দিদি।”
শেফালী চেতনা ফিরিয়া পাইল। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলিল, “তুই এসেছিস্! বিকাশ বাবু, এই আমার ভাই ভবেশ।”
বিকাশ ভবেশকে বলিল, Good morning young man, ভারি খুশী হলাম তোমায় দেখে। তা একটুখানি উপদেশ দিচ্ছি, শোন। আর কখন ট্রেন মিস্ করার চেষ্টা কর না। দেখ না, এর জন্য তোমার দিদিকে কি লাঞ্চনাই না সহ্য করতে হয়েছে। এই বলিয়া কৌতূহল নয়নে সে শেফালীর দিক চাহিল।
ভবেশ দিদির জিনিষপত্র নামাইয়া লইল। গাড়ী ছাড়িবার সময় হইল। শেফালী নেগেটিভখানি ফিরাইয়া দিয়া জোড়হাত করিয়া বলিল, “আমার সব ত্রুটি মার্জ্জনা করবেন। এই আপনার নেগেটিভ নিন।’’
বিকাশ নেগেটিভখানি পকেটে রাখিয়া মৃদু হাসিয়া বলিল Thanks, তা বিশ্বাস করুন, এর একটা টেন টুয়েলভ, এন্লার্জমেন্ট আপনাকে Present করব।”
গাড়ী ছাড়িবার ঘণ্টা বাজিল। শেফালী ট্রেন হইতে নামিয়া পড়িল। বিকাশ জানালা হইতে গলা বাড়াইয়া বলিল, যাবেন আমাদের ওখানে। আপনার তুলিতে আর আমার ক্যামেরায় প্রকৃতি সুন্দরীকে কতখানি ধরা যেতে পারে, দেখা যাবে-- আচ্ছা, তবে আসি, নমস্কার।”
শেফালী দুই হাত কপালে তুলিয়া প্রতি নমস্কার এক দৃষ্টিতে করিল। ট্রেন ছাড়িয়া দিল। বিকাশ দেখিল, শেফালী ট্রেনের দিক চাহিয়া আছে। একটি বাঁক ঘুরিতেই ডুয়ার্সের প্ল্যাটফর্মের সহিত শেফালী অদৃশ্য হইয়া গেল। সিগারেটের কুণ্ডলি ধোয়ার দিক চাহিয়া বিকাশ বলিয়া উঠিল, “ওয়ানডারফুল! সিম্প্লি ওয়ানডারফুল!”
গাড়ী অদৃশ্য হইতেই শেফালীর চোখে যেন হঠাৎ অন্ধকার নামিয়া আসিল। এই লোকটির সঙ্গে সে কি দুর্ব্যবহারই না করিয়াছে।
ভবেশ চলিতে চলিতে বলিল, “দিদি, উনিই ম্যানেজার? বেশ লোকত?”
দিদি ভারি গলায় উত্তর দিল, “বেশ? খুব ভাল লোক।” এই বলিয়া সে মুখখানি একটুখানি ঘুরাইয়া লইয়া চোখ হইতে দু’ফোটা অশ্রু মুছিয়া ফেলিল।