Published : 27 Feb 2025, 05:25 PM
মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাত চলার মধ্যেও রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সমাধানে তাগাদা দেওয়ার উপর জোর দিয়েছেন জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা-ইউএনএইচসিআরের প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি।
বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “মিয়ানমারের পরিস্থিতি খুবই জটিল।
“একটা সংঘাত চলছে, বাস্তবিক অর্থে অনেকগুলো সংঘাত চলছে, তবুও আমাদেরকে সমাধান পাওয়ার জন্য অবশ্যই তাগাদা দিতে হবে।”
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও গণহত্যার মুখে ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্টের পর রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে স্রোতের মত ঢুকতে শুরু করে রোহিঙ্গারা।
কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। যেখানে আগে থেকেই ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ওই বছরের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চির সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও তারা সই করে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি রোহিঙ্গারা, ফলে ভেস্তে যায় আলোচনা।
এরপর আসে কোভিড মহামারী; রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগেও ঢিল পড়ে। বিশ্বজুড়ে সেই সংকটের মধ্যেই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সু চির সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। তাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আসে নতুন ধাক্কা।
এর মধ্যে চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের অংশ হিসেবে কয়েকবার রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের যুদ্ধের তীব্রতার মধ্যে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আলোচনাতেই কম আসছে।
প্রত্যাবাসনের আলোচনা আপাতত বন্ধ; উল্টো রাখাইনে যুদ্ধের কারণে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে আরও ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের তথ্য দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া সব এলাকা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি দখলে চলে যাওয়ার মধ্যে নেপিদোর সঙ্গে যোগাযোগেও ভাটা পড়েছে ঢাকার।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের এক নির্বাহী আদেশে বিশ্বব্যাপী দেশটির সব উন্নয়ন সহযোগিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত হওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভরণপোষণ নিয়েও দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
কেননা, একক দেশ হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় দাতা যুক্তরাষ্ট্রই। তবে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জরুরি খাদ্য সহায়তার ক্ষেত্রে অর্থায়ন চালু থাকার কথা যুক্তরাষ্ট্রের বরাতে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এমন প্রেক্ষাপটে ঢাকা সফরে এসে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন ইউএনএইচসিআর প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি।
মিয়ানমারে তৈরি হওয়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সূত্র যে ঢাকায় নয়, বরং নেপিদোর কাছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের সঙ্গে একমত হওয়ার কথা বলেন তিনি।
ইউএনএইচসিআর প্রধান বলেন, মিয়ানমারে এসব সমাধান পাওয়ার গুরুত্ব নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি; যার সঙ্গে আমি সবসময় একমত।”
আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আমরা আলোচনা করেছি, এই জটিল পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনা কীভাবে অব্যাহত রাখা যায়।
“পালাবদলের চ্যালেঞ্জের মধ্যে তাদেরকে আশ্রয় দিতে থাকায় আমি বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছি।”
গণআন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও বড় পরিসরে সম্পৃক্ত করার কথা বলছে।
এর অংশ হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের সাইড ইভেন্টে ‘সব অংশীজনের সম্মেলন’ আয়োজনের প্রস্তাব দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
গত ৭ নভেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে লেখা চিঠিতেও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
২০ নভেম্বর সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবে জাতিসংঘ মহাসচিবকে এ সম্মেলন আয়োজনের আহ্বান সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে কাতারের রাজধানী দোহায় রোহিঙ্গা বিষয়ক ওই সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
ওই সম্মেলন আয়োজনে সমর্থন দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে সরকার সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে এবং আমরা ওই সম্মেলনকে সমর্থন দিব।”