Published : 04 Jul 2023, 10:15 PM
ঈদের রাতে এক মোটরসাইকেল নিয়ে ‘শিকারের খোঁজে’ ঢাকার এ মাথা থেকে ও মাথা চষে বেরিয়েছিলেন তিনজন। কুপিয়ে, ভয় দেখিয়ে তারা সেই রাতে অন্তত ছয়টি ছিনতাই করেন।
তাদের মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ বলছে, চক্রটিতে মোট ছয়জন আছে। ছিনতাইয়ে বের হওয়ার আগে তারা সবাই ইয়াবা সেবন করেন। নেশার ঘোরে থাকায় কাউকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করতেও তারা দ্বিধা করেন না।
ঈদের ছুটিতে ফাঁকা ঢাকায় ছিনতাইকারীদের তৎপরতা নগরবাসীর মনে আতঙ্ক ছড়ায়। ছুটি থেকে ঢাকায় ফিরেই ফার্মগেইটে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান এক পুলিশ সদস্য।
আর ঈদের দিন রাতে রামপুরার একরামুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির সহকারী প্রযোজক রাকিবুল হাসান রানা ও তার বন্ধু মোহনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা।
গুরুতর আহত অবস্থায় রানা বর্তমানে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন আছেন। মঙ্গলবার সেখানে তাকে দেখতে যান ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
হাসপাতালে তিনি বলেন, “পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যার ঘটনায় জড়িত সকলকেই গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর আদালতে নেওয়া হয়েছে।
“সাংবাদিক রানাকে আহত করে ছিনতাইয়ের ঘটনায় তিনজন ছিল। ইতোমধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে। পলাতক ব্যক্তিকেও খুব দ্রুতই ধরা হবে।”
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সাংবাদিক রানাকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় সরাসরি যুক্ত ছিল তিনজন। তারা একটি সবুজ রঙের হোন্ডা হর্নেট মোটরসাইকেলে ছিলেন। তাদের ‘ব্যাকআপ’ হিসেবে ছিলেন আরও তিনজন।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলা ও নবীনগর হাউজিংকেন্দ্রিক ছয়জনের এই দলটি নিয়মিতভাবে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ঘুরে ঘুরে ছিনতাই করে আসছিল।
এদের মধ্যে সোহেল (৩০) ও ইউসুফ (২৪) নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে সোহেল ভাড়ার মোটরসাইকেল চালক আর ইউসুফ ইলেকট্রিসিয়ান হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তবে তাদের মূল পেশা ছিনতাই।
অভিযানের তত্ত্বাবধানে থাকা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আল ফারুক বলেন, “এরা সবাই মাদকাসক্ত। মোহাম্মদপুরের বছিলা, নবীনগর হাউজিং, ঢাকা উদ্যান এলাকায় এদের আস্তানা।
“এদের বিরুদ্ধে আগেও মামলা হয়েছে। আর এদের পলাতক সঙ্গীর কাছে রয়েছে সাংবাদিক রানার লুট হওয়া মোবাইল ও মানিব্যাগ। তাকে শনাক্ত করা হয়েছে, অচিরেই গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।
ইয়াবা দিয়ে শুরু
ওই দুইজনকে গ্রেপ্তার অভিযানে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সোমবার রাতে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং থেকে যখন তাদের গ্রেপ্তার করা হয়, তখনও তারা তিনজন বের হয়েছিল ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে। পুলিশ সোহেল ও ইউসুফকে ধরে ফেলে।
আরেকজন পুলিশকে ধাক্কা দিয়ে পাশের নর্দমায় লাফ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে দুজন পুলিশ সদস্যও তার পিছু নিয়ে নর্দমায় লাফিয়ে পড়ে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে ধরা যায়নি।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, প্রতিবার ছিনতাইয়ে বের হওয়ার আগে এরা ‘ইয়াবা’ সেবন করে। যেদিন তারা ‘ইয়াবা’ যোগাড় করতে পারে না সেদিন ছিনতাইয়ে বের হয় না।
ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার অভিযানের নেতৃত্বে থাকা পুলিশের সহকারী কমিশনার (তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোন) এস এম আরিফ রাইয়ান জানাচ্ছেন, ঈদের রাত ২টার দিকে রামপুরার একরামুন্নেছা স্কুলের সামনে সাংবাদিক রানা ও তার বন্ধু মোহন এদের খপ্পড়ে পড়ে। মোটরসাইকেলে ঘুরতে থাকা ছিনতাইকারীরা একেবারে তাদের সামনে এসে হঠাৎ মোটরসাইকেল থামিয়ে ব্যাগ থেকে প্রায় দুই ফুট লম্বা দুটি চকচকে চাপাতি বের করে।
মোহন তার পকেটে থাকা রেডমি ফোন ও মানিব্যাগটি তাদের দিয়ে দেয়। এ সময় তারা রানার হাতে থাকা মোবাইল ও সঙ্গে থাকা হ্যান্ডব্যাগটি কেড়ে নিতে চাইলে রানা তাতে অস্বীকৃতি জানান। এরপরই তারা চাপাতি দিয়ে রানার মাথা, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মোটরাসাইকেলে উঠে পালায় তারা।
ছিনতাইকারীদের কোপে রানার হাত ও হাতের আঙুল গভীরভাবে কেটে গেছে। সেখানে বুধবার দ্বিতীয়বারের মতো অস্ত্রোপচার করা হবে বলে জানিয়েছেন পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম। রানার মাথায় ৩৪টি সেলাই লেগেছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, এই ছিনতাইকারীদের ধরতে তাদের অর্ধশতের বেশি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে হয়েছে। দোকান-মার্কেট বন্ধ থাকায় অনেক জায়গার ফুটেজও পাওয়া যায়নি।
ঈদের রাতে ছিনতাই করার এক পর্যায়ে ছিনতাইকারীরা একবার পোশাকও পাল্টায় জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ছিনতাইকারীদের মোটরসাইকেলটি শনাক্তের পর দেখা যায়, তারা ঈদের রাতে মোহাম্মদপুর থেকে বের হয়। বিজয়সরণি, লাভ রোড, হাতিরঝিল হয়ে বনশ্রী এলাকায় যায়।
সেখানে ঘুরে ফিরে আসার সময় তারা রামপুরার একরামুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পেয়ে যায় সাংবাদিক রানা ও তার বন্ধুকে। তাদের কুপিয়ে আহত করে সর্বস্ব লুটে নিয়ে ছিনতাইকারীর দলটি বাড্ডার দিকে যায়।
বাড্ডা ইউলুপে ইউটার্ন নিয়ে তারা কাকরাইল, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের আশপাশে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে এবার ডিএমপি হেডকোয়ার্টারের সামনে দিয়ে তেজগাঁও বিজি প্রেসের সামনে আসে। সেখানে একটি কভার্ড ভ্যানের ‘চিপায়’ পোশাক পাল্টায়। তাদের কাপড়ে রক্তের দাগ লেগে ছিল, বাড়তি পোশাক সঙ্গেই ছিল।
এরপর তারা মোটরসাইকেল নিয়ে যায় মিরপুর। সেখানে তারা অন্তত দুটি ছিনতাই করে। মিরপুর এলাকায় ঘোরাঘুরি করার পর তারা বিজয়সরণি, মগবাজার ফ্লাইওভার, কাকরাইল হয়ে যায় টিকাটুলি এলাকায়। সেখানে ভোর পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে অন্তত তিনটি ছিনতাই করে সকালের দিকে মোহাম্মদপুরে ফিরে যায়।
পুলিশ কর্মকর্তা এস এম আরিফ রাইয়ান বলেন, “এরা ভুক্তভোগীদের কাছে আতঙ্ক ছড়াতে শুরুতেই চাপাতি বের করে কোপ দিতে চায়। ছিনতাই এদের মূল পেশা। আর ছিনতাইয়ে পাওয়া টাকার বড় অংশ তারা খরচ করে মাদকের পেছনে।
“নেশার ঘোরে এরা উচ্চ গতিতে মোটরসাইকেল চালায়, কাউকে কুপিয়ে আহত করার পর ফিরেও তাকায় না। লোকটা বাঁচবে না মরবে- এ রকম বোধবিবেচনাও এদের কাজ করে না।”
পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বছিলা ও নবীনগর হাউজিং এলাকায় ঘুরে এদের বাসার অবস্থান শনাক্ত করা যায়নি। তবে নবীনগর হাউজিং এলাকার নির্মানাধীন একটি ভবনের তত্ত্বাবধায়ক আনোয়ার হোসেন জানান, সোমবার রাতের বেলায় হইচই শুনেছিলেন। তবে তিনি বের হননি।
এ এলাকায় বিভিন্ন জনকে ধরতে প্রায়ই পুলিশ আসে বলে জানান তিনি।