Published : 23 Oct 2023, 10:49 AM
সতের কোটি মানুষের দেশে যাদের ‘সংখ্যালঘু’ বলা হয়, সেই দুই কোটি জনগোষ্ঠীকে ‘বাদ রেখে’ দেশের গণতন্ত্রযাত্রা কোথায় পৌঁছাবে, সেই প্রশ্ন রাজনৈতিক নেতাদের সামনে রেখেছেন আইনজীবী, অধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত।
তিনি বলেছেন, “আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলো যদি গণতন্ত্রের কথা বলে, আইনের শাসনের কথা বলে, তাহলে তাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংখ্যালঘুদের বাদ রেখে দাঁড়াতে পারে না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই রাষ্ট্রীয় কৌঁসুলির ভাষায়, “যারা এখনো প্রায় দুই কোটি জনগণ, এবং তাদেরকে রাজনীতি বা সামাজিক অঙ্গন থেকে বাদ রেখে কিংবা তাদেরকে অবজ্ঞা করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে না।”
সারাদেশে দুর্গাপূজার আয়োজনের মধ্যে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে এসেছিলেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘুদের’ সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে সেখানে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। তুলে ধরেছেন হিন্দুদের দেশত্যাগ, বঞ্চনা, এবং উৎসবের সময় হামলার মুখোমুখি হওয়ার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয় ইনসাইড আউটের এই সর্বশেষ পর্বটি।
এবার এমন এক সময়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা এসেছে, যখন জাতীয় নির্বাচনের তিন মাসও বাকি নেই। সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং ক্ষমতাসীনদের পাল্টা অবস্থানে উত্তাপ ছড়াচ্ছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে।
দুর্গাপূজার মধ্যে বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে মণ্ডপের নিরাপত্তা নিয়ে এর আগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ। এ বিষয়ে এক প্রশ্নে পূজার ছুটির মধ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি না দেওয়ায় সাধুবাদ জানান সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজস্ব কর্মসূচি নেবে, সেখানে আমাদের কিছু বলার নাই। আমরা বিএনপির কর্মসূচির বিরুদ্ধে কিছু বলিনি। বিএনপি বলেছে, ২০-২৪ তারিখে পূজার ছুটির সময় তারা কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করবে না। আমরা মনে করি, এটা ইতিবাচক পদক্ষেপ।”
বিএনপির এমন অবস্থান ‘কৌশলগত’ কি-না, সেটা পরিষদের ‘মাথাব্যথা’ নয় মন্তব্য করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, “আমাদের মাথাব্যথা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়েই স্বীকার করেছে সংখ্যালঘুরা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।”
২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের বাড়িঘর-উপাসনালয়ে হামলা-ভাঙচুর হয়, প্রাণহানিও ঘটে। তবে পরের বছর শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশেই দুর্গাপূজা হয়েছে।
দুই বছরের পরিবেশ তুলনা করে অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, সংঘাত ঠেকানো সরকারের ‘ইচ্ছার উপর নির্ভর করে’।
“২০২১ সালে পূজা উৎসবের সময় প্রায় ২৭টি জেলায় ১০-১৫ দিন ধ্বংসযজ্ঞ চলে। ২০২২ সালে দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণভাবে এবং উৎসবমুখর পরিবেশে হয়। ২০২১ ও ২০২২ তুলনা করে আমি বলেছি, যদি সরকার চায় কোনো ঘটনা ঘটবে না, তাহলে কোনো ঘটনা ঘটবে না। যেটা আমরা ২০২২ সালে দেখেছি।”
তিনি বলেন, “২০২১ সালে আমরা অনেক জায়গায় ঘটনা দেখেছি। তখন প্রশাসন ঘটনা মোকাবেলায় তেমন তৎপর ছিল না। এমনকি তারা ঘটনার আগে কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা কোথায় ছিল? তার মানে গোয়েন্দা সংস্থা ব্যর্থ হয়েছে।”
স্বাধীনতার আগে থেকে এখন পর্যন্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সংখ্যা কমতে থাকার চিত্রও আলোচনা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক।
১৯৭০ সাল পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে বৈষম্য, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও নির্যাতন চলতে থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ১৯৪৭ সালের ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ওই সময়ে ১৯-২০ শতাংশে নেমে আসে। এই ১৯-২০ শতাংশ বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দেয় এবং আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলনে যোগ দেয়। আর এর মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু প্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হন।”
সে কারণেই অপারেশন সার্চলাইটসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় সব আক্রমণের ‘প্রথম লক্ষ্যবস্তু’ হিন্দুরা ছিল বলে মন্তব্য করেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই কৌঁসুলি। তিনি বলেন, “ওই সময়ে দেশের সবগুলো হিন্দু এলাকায় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।”
রানা দাশগুপ্ত বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইম মুহম্মদ এরশাদের সময় আবার ‘জাতিগত নিধনের’ নীতি নেওয়া হয় এবং ‘সংখ্যালঘু-বিরোধী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি’ তৈরি করা হয়।
“যার মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের তাদের ভূমি ও ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এ কারণে দেশ সংখ্যালঘু শূন্য হতে থাকে।”
১৯৯১ সালে এবং ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘ব্যাপক মাত্রায়’ সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন রানা দাশগুপ্ত। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় ২০০৮ সালে গঠিত সাহাবুদ্দিন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় তিনি হতাশা প্রকাশ করেন।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত ওই কমিশনের প্রধান ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সে সময় তিনি ছিলেন একজন বিচারক।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, ২০১১ সালে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে।
“কিন্তু সেই সাহাবুদ্দিন কমিশনের, যিনি বর্তমানে রাষ্ট্রপতি, সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। সরকার কোনো কিছু করেনি। এবং আমরা জানি না কেন।”
২০১১ সালের পরে দেশের কয়েকটি স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলায় ইসলামপন্থিদের সঙ্গে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের ‘যোগসাজশ’ দেখলেও সেটা রাষ্ট্রীয় মদদে হামলা ছিল না বলে মনে করেন রানা দাশগুপ্ত।
তিনি বলেন, “ইসলামি শক্তি ও সরকারি দলের একটি অংশ একযোগে তারা একই ধরনের কাজ করে। কিন্তু সবগুলো ঘটনা রাষ্ট্রীয় মদদে হয়েছে তা নয়; যেভাবে আগের সবগুলো ছিল রাষ্ট্রীয় মদদে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও সাম্প্রদায়িক কার্যক্রম।
“তবে ২০১১ সালের পর থেকে সবগুলো ঘটনা ঘটেছে রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে। যে শক্তি ১৯৭১ সালে দেশকে হিন্দুশূন্য করতে চেয়েছিল, তারা এখনো সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।”
সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমে যাওয়ার চিত্র তুলে ধরে ২০২২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি এবং অধ্যাপক আবুল বারকাতের গবেষণার উদাহরণ টানেন এই আইনজীবী।
তিনি বলেন, “২০২২ সালের বিবিএসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৭০ সালের ১৯-২০ শতাংশ থেকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৯.১ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তী দুই দশকে বাংলাদেশ সংখ্যালঘু-হীন হয়ে যাবে।’
“এটাই বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা। আমরা অনিরাপদ অবস্থায় আছি।”
সংসদ, বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ ও প্রশাসনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থান থাকলেও ‘অনিরাপত্তা’ এখনো রয়ে গেছে বলে মনে করেন রানা দাশগুপ্ত।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের ‘রাষ্ট্রীয় সংখ্যালঘু’ হিসাবে রূপ দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “রাষ্ট্রীয় সংখ্যালঘু হওয়ার জন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানরা মুক্তিযুদ্ধে জীবন দেয়নি।”
এই অধিকারকর্মী বলেন, “সংখ্যাগুরুর ধর্মকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী কেবল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়নি, তারা রাষ্ট্রীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।
“এবং আমরা মনে করি, আমরা সমতা, সমঅধিকার, ন্যায়বিচারের জন্য লড়ছি, যার উপর ভিত্তি করে জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রবাসী সরকারের শপথ গ্রহণের আগে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ঘোষণা করা হয়েছিল। আমরা সেই সমতা, সমানাধিকার ও ন্যায়বিচারের ওপর দৃঢ় থাকতে চাই এবং এখনও লড়াই করছি।”
চট্টগ্রামের হাটহাজারীসহ দুই জায়গার বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এ বছর দুর্গোৎসব ‘শান্তিপূর্ণ’ থাকার কথা তুলে ধরে রানা দাশগুপ্ত বলেন, “পর্যবেক্ষণ করতে হবে শেষ পর্যন্ত; উৎসবের আমেজে পূজা শেষ হল কি-না দেখতে হবে।”
তবে নিরাপত্তার অভাবের কারণে পুলিশি নিরাপত্তার কড়াকড়ি যেভাবে উৎসবের অংশ হয়ে উঠেছে, তাতে মনোবেদনার কথাও বলেন রানা দাশগুপ্ত।
তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ছাড়া যদি সব ধরনের ধর্মীয় উৎসব পালন করা যায়, তাহলে বলা যাবে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা বাস্তবে প্রতিষ্ঠা হয়েছে।”