Published : 12 Oct 2023, 11:24 AM
বাংলাদেশে ২০০৭ সালে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন শুরু করে গোল্ডেন চ্যাঙ সুজ। এই দেশে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ ১৩ কোটি ডলার। প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে ৩০ কোটি ডলারের চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করেছে।
কুমিল্লা ইপিজেড ও চট্টগ্রামে গোল্ডেন চ্যাংঙ সুজের রয়েছে চারটি কারখানা; পঞ্চম কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে ব্যবসা বড় করার কাজও শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে চামড়াজাত পণ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেমস হো।
“শুরুতে বিদেশি ক্রেতারা বলেছিল, বাংলাদেশে এ ধরনের কারখানা সম্ভব না। কিন্তু আমি মনে করি, ভালো পরিকল্পনা ও সদিচ্ছা থাকলে বাংলাদেশই এ ধরনের বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত স্থান। আমি বিশ্বাস করি, আমরা যদি সাহস করে স্বপ্ন দেখতে পারি, তাহলে সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।”
জেমস হো’র মত আশাবাদী এই খাতের উদ্যোক্তরাও। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ আর নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আগামী দুই বছরে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও কৃত্রিম চামড়াপণ্য রপ্তানি করে তিন বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের মাইল ফলকে পৌঁছাতে চান তারা।
সেজন্য নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি পোশাক শিল্পের মত আন্তর্জাতিক বাজারে এই খাতের পরিচিতি ও ব্র্যান্ডিংয়ের কৌশল নেওয়া হয়েছে।
সেই লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বৃহস্পতিবার ঢাকায় শুরু হচ্ছে চামড়া খাতের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ‘বাংলাদেশ লেদার ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদারগুডস ইন্টারন্যাশনাল সোর্সিং শো’ বা ব্লিস-২০২৩। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, হংকং, ভারত, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, কম্বোডিয়াসহ ১৫টি দেশের ক্রেতা, ফ্যাশন বিশেষজ্ঞ, ব্র্যান্ডকে প্রদর্শনীতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
রপ্তানিকারকদের সমিতি লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি এবং অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, “প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের ৪৬টি শীর্ষস্থানীয় চামড়াপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকের অংশগ্রহণে এই শিল্পের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং শুরু হচ্ছে। সেখানে কমদামি পণ্যগুলোর পাশাপাশি অনেক দামি পণ্যও প্রদর্শন করা হবে। পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ও বহুমুখীকরণে বাংলাদেশের নিজস্ব যে পরিকল্পনা রয়েছে, তার কিছু বাস্তবায়নও আমরা সেখানে দেখাতে পারব।”
ভবিষ্যৎ লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ অনেকরকম প্রতিকূল অবস্থা পার করে আসছে। শুধু মহামারী আর যুদ্ধ নয়; আরও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ভালো করছে। এই শক্তির ওপর ভর করে বর্তমান ১৭০ কোটি ডলার থেকে এই খাতকে ৫০০ কোটি ডলারের শিল্পে উন্নীত করাই আমাদের লক্ষ্য।”
এলএফএমইএবির সাবেক সভাপতি ও মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্সের বর্তমান সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ চামড়া রপ্তানি করে আসছে। কিন্তু ১৯৮০ সালের আগে কোনো ভ্যালু এডিশন ছিল না। এখন মাত্র ৭ শতাংশ যাচ্ছে ওয়েট ব্লু, ক্রাস্ট ও ফিনিশ লেদার। ৩৩ শতাংশ হচ্ছে চামড়াজাত পণ্য, ৪১ শতাংশ হচ্ছে চামড়ার জুতা এবং বাকিটা নন লেদার ফুটওয়্যার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাত থেকে রপ্তানি হয়েছে ১৭০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “গ্রোথ রেট বেশ ভালো। এভাবে আগাতে থাকলে ২০২৪-২৫ অর্থবছর নাগাদ ৩০০ কোটি ডলারের একটা খাত হবে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এটাকে ৫০০ কোটি ডলারের খাতে রূপান্তর করা।”
সাম্প্রতিক রপ্তানি চিত্র তুলে ধরে সাইফুল ইসলাম বলেন, “জাপানে গতবছর রপ্তানি প্রবদ্ধি হয়েছে ৫১ শতাংশ, ভারতে হয়েছে ৩৮ শতাংশ। এর মানে হচ্ছে চামড়াজাত পণ্যে বৈচিত্র্য আনার পাশাপাশি বাজার বহুমুখীকরণেও আমাদের সাফল্য আসছে। আমরা চাচ্ছি এই খাতকে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত করে তুলতে। এই খাতে এখন ২৬৪টি কারখানা রয়েছে, যার ৯৮ শতাংশই কমপ্লায়েন্স মর্যাদায় উত্তীর্ণ। সবাই ইনস্যুরেন্স, কমিউনিটি স্কুল, হসপিটাল এসব আমাদের আছে।
“আমরা ক্রেতা ও ব্র্যান্ডের আস্থা অর্জন করতে শুরু করেছি। এখন যে ব্লিস-২০২৩ হচ্ছে, এর মাধ্যমে আমরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরও বেশি পরিচিতি লাভ করবে।”
বর্তমানে দেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ বছরে ৬ থেকে ৭ হাজার কোটি ডলার জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, “২০৪১ সালের মধ্যে বছরে মোট ৩০ হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে। পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ১০০ কোটি ডলার রপ্তানির মাইলফলক অতিক্রম করা চামড়া ও অন্যান্য খাত এগিয়ে এলে এটা সম্ভব।
“চামড়া পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ও বিদেশি রপ্তানির একটা প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। ২০৩০ সালে এই খাতকে অন্তত ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির একটা খাতে পরিণত করার চেষ্টা চলছে।”
কমপ্লায়েন্সের কী হবে?
বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় কাঁচা চামড়ার যোগান থাকার পরও তা প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানির ভালো সুযোগ তৈরি করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্বের চাহিদামত কমপ্লায়েন্স পূরণ করতে না পারায় বাংলাদেশের চামড়া রপ্তানি হয় না। আর বিদেশি ভালো ক্রেতাদের কাছে যেসব চামড়াপণ্য রপ্তানি করতে হয় তার অনেক কাঁচামাল দেশে থাকা সত্ত্বেও মান ধরে রাখার জন্য তা আমদানি করতে হচ্ছে।
ঢাকার সাভারে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে উঠলেও নানা জটিলতায় আন্তর্জাতিক মানের কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা যায়নি এখনও। তবে এই চামড়া শিল্পনগরীকে আন্তর্জাতিকমানের করে গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছে বলে জানান নাসিম মঞ্জুর।
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নিজে এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মুখ্য সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান ও এলডব্লিউজি স্ট্যান্ডার্ডের একটি সিইটিপি নির্মাণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পার্টনার সিলেকশনের কাজ চলছে। এই উদ্যোগ সফল হলে শুধু ফিনিশড চামড়া পণ্যই নয়, কেবল চামড়া খাত থেকে ভালো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে।”
এক প্রশ্নে নাসিম মঞ্জুর বলেন, যে কোনো উদ্যোগ নিতে গেলেই সেখানে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। চামড়া শিল্পও এর ব্যতিক্রম নয়।
“একটা হচ্ছে নতুন বাজারে পরিচিত হওয়া। সেটার জন্যই আমাদের এরকম প্রদর্শনী। আরেকটি হচ্ছে লিড টাইম। এখন ক্রয়াদেশ নেওয়ার পর ১১০ দিন লেগে যাচ্ছে, যেটাকে ৯০ দিনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সেজন্য কাস্টমসের প্রক্রিয়াটা সহজ করা, সরকারি দপ্তরগুলোর অটোমেশন করা এবং ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে ভালো করা। সর্বোপরি যে বিষয়টা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংটা ঠিক মত করা, যেটা বর্তমানে পোশাক খাত করতে পেরেছে,” বলেন তিনি।