Published : 25 Nov 2024, 01:40 AM
আন্দোলনের মুখে সরকার দাবি মেনে নিয়েছিল, কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণের মহাপরিকল্পনা সেনাবাহিনীকে দিয়ে বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব হবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছেন, “সেনাবাহিনীকে কাজ দিতে গেলে প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে যায়। আসলে এ বিষয়ে সকল বিকল্প রেখে আমরা এগোচ্ছি। খুব শিগগিরই একটা আশানুরূপ ফল পাব।”
আর কী বিকল্প বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে আছে? উপাচার্য তা স্পষ্ট করেনেনি। তবে তিনি বলেছেন, বিশদ প্রকল্প পরিকল্পনা সংশোধনের একটি প্রস্তাব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
পুরান ঢাকার ‘ঘিঞ্জি পরিবেশ’ আর হল সংকট থেকে শুরু করে হাজারো অসুবিধা দূর করতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণের এই মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেটি আলোর মুখ দেখেনি আট বছরেও।
প্রকল্প অনুমোদনের ছয় বছরে কেবল শেষ হয়েছে লেক আর পুকুর খননের কাজ। সীমানা প্রাচীর ও ঘাট নির্মাণের কাজ শেষ দিকে। ভূমি উন্নয়নের কাজ হয়েছে অর্ধেক। চলছে পরিকল্পনা ও প্রকৌশল ভবন নির্মাণ।
ঢাকার কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় সেই নতুন ক্যাম্পাসের সীমানায় দাঁড়ালে এখন দেখা যায় শুধু খোলা মাঠ। ছয় বছরে যে প্রকল্পের ‘তেমন কিছুই হয়নি’, সেখানে কবে শেষ হবে এ মহাপরিকল্পনা, নকশায় দেখানো একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কবে বাস্তবে রূপ পাবে, এসব প্রশ্নের রয়েছে নানান অনিশ্চয়তা।
বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের ১৯ বছর পরেও শিক্ষার্থীদের থাকতে হচ্ছে পুরান ঢাকার জরাজীর্ণ গলির মেসগুলোতে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শিক্ষার্থীরা হল সংকটে বছরের পর বছর থাকছেন সেখানে। অর্থ সংকটে যেখানে পড়ালেখা শেষ করাই দায়, সেখানে অতিরিক্ত খরচে থাকতে হচ্ছে মেসে। বছরের পর বছর নানা সংকটের মধ্য দিয়ে শেষ করতে হচ্ছে শিক্ষাজীবন।
এমন ভোগান্তির রাশ টানতেই শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিলেন। তাদের আন্দোলনের মুখে ২০১৬ সালে তেঘরিয়ায় ২০০ একর জমিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
এরপর আট বছরেও নতুন ক্যাম্পাস না পেয়ে সম্প্রতি ফের রাস্তায় নামেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আগের প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে সেনাবাহিনীকে নতুন ক্যাম্পাসের কাজ দেওয়ার দাবি তারা তুলে ধরেন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাতে সবুজ সংকেতও দেয়।
কিন্তু প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করতে গিয়ে অনিশ্চয়তার বিষয়গুলো আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে চার দফা
আন্দোলনের মুখে ২০১৬ সালে তেঘরিয়ায় ২০০ একর জমিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিল তৎকালীন সরকার।
অ্যাকাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, আবাসন ব্যবস্থা, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, ক্যাফেটেরিয়া, খেলার মাঠ, চিকিৎসা কেন্দ্র, সুইমিংপুল, লেক নির্মাণসহ আধুনিক ক্যাম্পাস নির্মাণের কথা বলা হয় সেই পরিকল্পনায়।
২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর জমির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। ওই বছরের ৯ অক্টোবর প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। ১ হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১৯ সালের জুলাইয়ে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার চেক পায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
পরের বছর ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি মোট ২০০ একর জমির মধ্যে ১৮৮ দশমিক ৬০ একর জমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বুঝে পায়। কিন্তু এখনও অবশিষ্ট ১১ দশমিক ৪০ একর জমি বুঝে পায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
তেঘরিয়ায় নতুন ক্যাম্পাসের জায়গায় গিয়ে দেখা যায়, লেক ও পুকুর খননের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। পরিকল্পনা ও প্রকৌশল ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। ভূমি উন্নয়ন কাজ প্রায় অর্ধেক শেষ হয়েছে। সীমানা প্রাচীর ও ঘাট নির্মাণ কাজও শেষ দিকে।
২০২০ সালের মাঝামাঝি নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিন দফা সময় বাড়ানোর পর সবশেষ গত সেপ্টেম্বরে আরও দুই বছরে জন্য ওই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। অথচ জমি অধিগ্রহণের কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রকল্পের কাজ সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়ার দাবি তোলেন শিক্ষার্থীরা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক শেখ গিয়াস উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে তিন দফা দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণের সময় বাড়ানো হয়েছে। চতুর্থ দফায় গত সেপ্টেম্বরে দুই বছরের জন্য কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। কাজের ব্যয় হবে ১ হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।”
প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে বর্তমান প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ আলী আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের প্রথম প্রকল্পের কাজটি দ্রুত শেষ করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। পুকুর ও লেকের কাজ শেষ হয়েছে। শিগগিরই অবশিষ্ট ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হবে।
“বর্তমানে প্রকৌশল ভবন, সীমানা প্রাচীর ও ঘাট নির্মাণের কাজ চলছে। আর এই কাজ শেষ হলে দ্বিতীয় প্রকল্পের কাজের অনুমতি পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় প্রকল্পের কাজ সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করছে।”
প্রকল্প কেন সেনাবাহিনীকে দেওয়ার দাবি?
১৮৫৮ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুলের। পরে জগন্নাথ উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ এবং পরে শুধুই কলেজ হয়ে সবশেষ ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পায়।
বর্তমানে সাড়ে ১৭ হাজার শিক্ষার্থী, ছয়টি অনুষদ, ৩৬টি বিভাগ ও দুটি ইনস্টিটিউট নিয়ে পুরান ঢাকার সাত একরের ক্যাম্পাসেই চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। তবে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রার শুরু থেকেই এ ক্যাম্পাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের অন্ত নেই।
স্বাধীনতার পর তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা ১১টি হল তৈরি করে বসবাস শুরু করলেও ১৯৮৫ সালের পর থেকে সেগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে চলে যায়, যা এখনও উদ্ধার সম্ভব হয়নি। আবাসন সংকট ছাড়াও ক্লাসরুম, ল্যাব, খেলার মাঠসহ পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বৈশিষ্ট্য, তার তেমন কিছুই নেই বলা চলে।
এ অবস্থায় আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ শুরু হয়। তবে প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে গত ৫ অগাস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর বাকি কাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তরের দাবি তোলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এই দাবিতে গত ১১ নভেম্বর শিক্ষার্থীরা প্রথমে আবদুল গণি রোডের শিক্ষা চত্বর অবরোধ এবং পরে সচিবালয় ঘেরাও করেন। পরে ডাক, টেলিযোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর ১২ নভেম্বর বসেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে।
শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণ কাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তরে সায় দেন শিক্ষা উপদেষ্টা।
সাম্প্রতিক আন্দোলনের কারণ ব্যাখ্যা করে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের কে এম রাকিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে নতুন ক্যাম্পাসের কাজ দ্রুত শেষ করার কথা আমরা বারবার বলেছি। তবে রাজনৈতিক কারণে বরাবরই মুখ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। যাদের কারণে ক্যাম্পাসের কাজ পেছাচ্ছিল বা এই কাজের সুবিধা পাচ্ছিলেন যারা, তারা ছিলেন আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট।
“নানা সংকটে শিক্ষার্থীরা ছিল অতিষ্ঠ। তাই জুলাই অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের ‘পেটোয়া বাহিনী ছাত্রলীগ’ বিতাড়িত হওয়ার পরও নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শেষ করা নিয়ে তালবাহানা সহ্য করতে না পেরেই ফের রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছিলাম আমরা।”
রাকিবের ভাষ্য, “আমরা নতুন ক্যাম্পাসের কাজ বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর ওপর ভরসা রাখছি। অন্য কারো ওপর আমাদের ভরসা নেই। সেনাবাহিনী যদি এ পর্যায়ে আমাদের ক্যাম্পাসের কাজ না নিতে চায়, আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করব।
“সরকার যদি চায় তাহলে সেনাবাহিনী কাজ নেবে। আর এর মাধ্যমে সরকার আর্থিকভাবে খুব একটা লাভবান না হলেও মানসম্পন্ন কাজ পাবে।”
জটিলতা কোথায়?
নতুন ক্যাম্পাসের কাজ হস্তান্তরে ‘জটিলতা’ রয়েছে জানিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে হস্তান্তরে কিছু জটিলতা আছে। সেনাবাহিনীর কাজ করে ডিরেক্ট পারচেজ ম্যানেজমেন্ট বা ডিপিএমের মাধ্যমে। সেজন্য প্রকল্প প্রস্তাব বা ডিপিপি সংশোধন করতে হবে। আমরা ডিপিপি সংশোধনের প্রস্তাব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। ডিপিপি সংশোধনের বিষয়ে অনুমোদন ইউজিসির মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পেতে হবে।”
তবে ডিপিপি সংশোধন করেও এ কাজ সেনাবাহিনী করবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ করে।
সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তারা বলছেন, সেনাবাহিনী সাধারণত মাঝপথে কোনো কাজে হাত দেয় না; কারণ তাতে বাহিনীর কাজের সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার শঙ্কা থাকে। তবে সরকার সিদ্ধান্ত জানালে বিষয়টি অন্যভাবে দেখা হতে পারে।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য রেজাউল করিম বলেন, “আসলে আমরা আন-অফিসিয়ালি যোগাযোগ করে এমনটা শুনছি। তবে অফিসিয়াল চ্যানেলে এগোতে আমরা ডিপিপি সংশোধনের পথে হাঁটছি।
“সেনাবাহিনীকে কাজ দেওয়া প্রসঙ্গে একাধিক বায়োডাটা আমাদের হাতে এসেছে। তারা প্রত্যেকেই সাবেক সেনা কর্মকর্তা। সেনাবাহিনীকে কাজ দিতে গেলে প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে যায়। আসলে এ বিষয়ে সকল ধরনের বিকল্প রেখে আমরা এগোচ্ছি। খুব শিগগিরই একটা আশানুরূপ ফলাফল পাব।”
আর কী পথ খোলা আছে?
দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ ঝুলে থাকায় অস্থায়ী উদ্যোগেও সমস্যা সমাধানের পথে হাঁটছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বাসা ভাড়া নিয়ে আবাসন সংকটের সমাধান ও পুরনো জেলখানার পাশের জমিতে ভবন নির্মাণে দাতা খোঁজার পরিকল্পনার কথাও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন উপাচার্য রেজাউল করিম।
তার ভাষ্য, “অস্থায়ী আবাসনের বিষয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক্রমে আমরা আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা, সে বিষয়টিও দেখছি। ইতোমধ্যে আমরা অনেক খোঁজ নিয়েছি, কিন্তু সেভাবে সম্পূর্ণ ফাঁকা ভবন পাচ্ছি না।
“আমাদের আরেকটি পরিকল্পনা রয়েছে। পুরনো জেলখানার পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৭ একরের যে জমি রয়েছে, সেখানেও আমরা ভবন নির্মাণ করতে পারি। সেক্ষেত্রে কোনো দাতব্য সংস্থাকে খুঁজতে হবে। এখন এই দুটি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি।”
নতুন ক্যাম্পাসের প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ আলী আহমদের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তাকে অপসারণের দাবিও উঠেছিল শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে।
বিষয়টি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, “আমরা নতুন একজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার জন্য জানিয়েছি, সেটা হয়ে গেলে উনি এমনিতেই অব্যাহতি পেয়ে যাবেন।”
‘ক্যাম্পাসের ভেতরে বাস, বাইরে বাসস্ট্যান্ড’
বর্তমান সাড়ে সাত একরের ক্যাম্পাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলো ক্যাম্পাসের ভেতরেই রাখা হয়। আর মূল গেইটের বাইরেই দাঁড় করানো থাকে ঢাকা শহরে চলাচল করা বিভিন্ন কোম্পানির বাস।
নতুন ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তরের আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক রাকিব বলেন, “এই ক্যাম্পাসে একটু বসার জায়গা নেই। ভেতরে আমাদের বাসগুলো পার্ক করে রাখা থাকে। আর বাইরে তো পুরোটাই বাস স্ট্যান্ড।”
দীর্ঘদিন ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ফটকে আজমেরী গ্লোরী, ভিক্টোর ক্লাসিক, বিহঙ্গ ও সাভার পরিবহন এবং দ্বিতীয় ফটকে বাহাদুর শাহ পরিবহন ‘অস্থায়ী বাসস্ট্যান্ড’ করে রেখেছে। গত ৫ অগাস্টের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাস মালিকদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম ফটক থেকে বাসগুলো সরিয়ে শাঁখারী বাজার মোড়ে নিয়ে যায়, কিন্তু বাহাদুর শাহ পরিবহন দ্বিতীয় গেটেই এখনও অবস্থান করছে।
বিষয়টি নিয়ে গত ১২ অক্টোবর বাস মালিক সমিতির সঙ্গে সভা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ওই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেইট ও কলাভবন গেইট সংযুক্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে কোনো বাস যাত্রী তুলতে পারবে না। মেইন গেইট অর্থাৎ টিএসসির পশ্চিম মোড় থেকে দক্ষিণে সদরঘাটের দিকে কোনো পরিবহন যাবে না।
আরও সিদ্ধান্ত হয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বাংলাবাজার গেইটে অবস্থানরত বাহাদুর শাহ পরিবহন দক্ষিণ গেইটে অবস্থান করতে পারবে না। বাহাদুর শাহ পার্কে থেকে পরিবহনগুলো টার্ন নেওয়ার সময় কোনো পরিবহনের চাকা থামবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. তাজাম্মুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সপ্তাহ দুয়েক এই নিয়ম মেনে চললেও পরে তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে না।
“এটা আসলে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। আমরা তাদের সঙ্গে একাধিকবার মিটিং করেছি। কিন্তু প্রত্যেকবারই দেখা যায়, তারা প্রথম দুয়েক সপ্তাহ এসব নিয়ম মেনে চলে। পরে আবারও একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এটার স্থায়ী কোনো সমাধান নেই।”
‘সংকটের শেষ নেই’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সমস্যা ছাড়াও শ্রেণিকক্ষ, ল্যাব ও খেলার মাঠ সংকটসহ নানা সমস্যা রয়েছে বর্তমান ক্যাম্পাসে।
লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এহসানুল কবির ফাহিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্লাসরুমের সংকট এখন চরমে। একটি ক্লাস শেষ না হতেই দেখা যায় অন্য একটি ব্যাচের ছাত্ররা ক্লাস করার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। ক্লাস করতে বসে থাকতে হচ্ছে।”
“বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবের সংকট আছে। এ জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়াতে হয় আমাদের। একটি খেলার মাঠও নেই,” যোগ করেন তিনি।
ইতিহাস বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের মো. শাহীন মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের লাইব্রেরির নামে যা আছে তা বইয়ের গুদাম, লাইব্রেরি নয়।
“ক্যাম্পাসে একটি লাইব্রেরি থাকলেও সেখানে প্রযুক্তি সুবিধা নেই। কোনো একটা রেফারেন্স সার্চ দেবেন, সে উপায় নেই।”
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের মো. রাশিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ক্যান্টিন থাকলেও সেটার খাবারের মান খারাপ। ক্যান্টিনের লাইন বাইরে পর্যন্ত চলে আসে। খাবারের পরিমাণও অনেক কম। ক্যান্টিনের জন্য কোনো ভর্তুকিও দেওয়া হচ্ছে না।”
খরচ সামলাতে হিমশিম
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের হল না পেয়ে বাধ্য হয়েই থাকতে হয় মেসে। সেখানে ভাড়া, খাবার খরচ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া, পড়ালেখার খরচ সামলাতে অনেক শিক্ষার্থীই হিমশিম খান। ফলে অনেক শিক্ষার্থীই টিউশনের ওপর নির্ভর করেন। যদিও পুরান ঢাকায় টিউশন পাওয়া আর ‘ঘিঞ্জি অলিগলি’ পেরিয়ে আসা-যাওয়াতেই তাদের সময় লেগে যায় অনেক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের মেহেদি হাসান বলেন, “বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আসে ঢাকার বাইরে থেকে এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। হলে থাকলে বাসা ভাড়ার খরচটা যেমন বাঁচত, তেমনি খাওয়া-দাওয়ার খরচটা কম লাগত।
“আর প্রতিদিনই একটা না একটা সমস্যা। আজ বাজার করতে হবে তো কাল ভাড়া দাও। আর পুরান ঢাকায় টিউশন পাওয়াও দায়। যে সব এলাকায় টিউশন একটু সহজে পাওয়া যায়, সেই সব এলাকায় যেতে হলে যানজটেই খোয়াতে হয় কমপক্ষে দু-তিন ঘণ্টা। আর যাতায়াত খরচ তো আছেই।”
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ফাতেমা আলীর ভাষ্য, “ছাত্রদের হল না থাকলেও ছাত্রীদের তুলনায় বাসা পাওয়াটা সহজ হয়। সাত হাজারের বেশি ছাত্রীর জন্য একমাত্র যে হলটি আছে সেখানে হাজার খানেকের একটু বেশি ছাত্রীর আবাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব। ফলে বাকিদের মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে পাওয়া বড্ড ভোগান্তির বিষয়।”
“নিজ জেলা থেকে দূরত্ব, অ্যাকাডেমিক রেজাল্টসহ কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে হলে সিট বরাদ্দের বিধান আছে। তবে এখন যারা আছেন, তাদের বেশিরভাগই সিট পেয়েছিলেন বিগত সরকারের ছাত্রসংগঠনের তদবিরের জোড়ে। একেক সিটে দুজন ছাত্রীকেও তোলা হয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়ে।”
পুরনো খবর-
জগন্নাথের নতুন ক্যাম্পাসের 'কাজ পাচ্ছে' সেনাবাহিনী
সচিবালয় 'ঘেরাওয়ে' জগন্নাথ শিক্ষার্থীরা, দেখা চান উপদেষ্টার
প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে জগন্নাথ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
জগন্নাথের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তরের দাবি