Published : 27 Apr 2023, 08:37 PM
রাস্তায় অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকা স্বজনহীন মানুষদের সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন স্থানে ছুটে গিয়ে আলোচনায় আসা পুলিশ কনস্টেবল শওকত হোসেনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিতি ও ‘চাকরিতে অনীহার কথা’ জানানোর পর তাকে বরখাস্ত করে আদেশ জারি করা হয়।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বন্দর জোনের উপ-কমিশনার শাকিলা সোলতানা তার বরখাস্ত আদেশ স্বাক্ষর করেন।
তবে শওকতের ভাষ্য, তিনি নিজেই চাকরি থেকে অব্যাহতির আবেদন করেছিলেন। চাকরি ফিরে পাবার জন্য তিনি আর আবেদন করবেন না।
বৃহস্পতিবার নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (সদর) আব্দুল ওয়ারিশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কনস্টেবল শওকত কুমিল্লা জেলা পুলিশে কর্মরত ছিল। নগর পুলিশে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় মামলা হয়েছিল।
“কমিটিকে ওই সময় তিনি ‘চাকরি করতে ইচ্ছুক নন’ বলে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন। গত ১৬ এপ্রিল থেকে তার চাকরিচ্যুতির চূড়ান্ত আদেশ হয়।”
পুলিশ কর্মকর্তা ওয়ারীশ বলেন, শওকত চাইলে আদেশের বিষয়ে সিএমপি কমিশনারের কাছে আবেদন করতে পারবেন।
নগর পুলিশের বন্দর জোনের অধীনে কর্ণফুলী থানায় কর্মরত থাকাকালে কনস্টেবল শওকত দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় তার বিরুদ্ধে ওই বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। ওই মামলায় সুপারিশের পর তাকে চাকরিচ্যুতির আদেশ জারি করেন বন্দর জোনের উপ-কমিশনার।
বন্দর জোনের উপ-কমিশনার শাকিলা সোলতানা জানান, কনস্টেবল শওকত বিনা নোটিসে ৭১দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। ওই সময়ের মধ্যে তার চট্টগ্রাম রেঞ্জ অফিসে বদলি আদেশ হয়েছিল। সেখান থেকে তাকে কুমিল্লা জেলা পুলিশে পদায়ন করা হয়েছিল, সেখানেও দীর্ঘদিন কাজে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বিভাগীয় মামলায় কন্সটেবল শওকতকে চাকরিচ্যুতির আদেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে কনস্টেবল শওকত বিনা নোটিনে কুমিল্লাতেও অনুপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছেন কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান।
তিনি বলেন, গত বছরের মার্চে কনস্টেবল শওকতের কুমিল্লা জেলায় পদায়ন হয়েছিল। কিন্তু বিনা নোটিসে তিনি একবছর কাজে যোগাদান করেননি। এ ঘটনায় একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে বিষয়টি খোঁজ নিতে বলা হয়েছে।
কুমিল্লা জেলা পুলিশ কার্যালয় থেকে জানা যায়, গত বছরের ১৩ মার্চ কুমিল্লা জেলা পুলিশে কনস্টেবল শওকতের বদলির আদেশ হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনি যোগদান না করে ৩৫৩ দিন পর এ বছরের ১ মার্চ যোগদান করেন। পরে আবার কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন।
কনস্টেবল শওকত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চাকরিচ্যুতির আদেশের আগেই আমি ইস্তফা দিয়েছি। পুলিশের চাকরিতে অনেক রেস্ট্রিকশন থাকে। বিভিন্ন মানবিক কাজ ও লাইভ প্রোগ্রামের বিষয়টি আমার ‘র্যাংকের’ সাথে যায় না।”
শওকতের ভাষ্য, “আমাকে বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং করা হচ্ছে, যার কারণে আমার মানবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। মূলত তাই স্বেচ্ছায় অব্যাহতির আবেদন করেছি। চাকরিচ্যুতির কথা বলা হলেও আমি আর আবেদন করব না।
“আমি কর্ণফুলী থানায় থাকা অবস্থায় দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলাম। সেগুলোসহ মোট ৭১ দিন আমি গরহাজির ছিলাম। পাশাপাশি আমাকে চট্টগ্রাম রেঞ্জ অফিসে বদলি করা হয়, সেখান থেকে পুনরায় কুমিল্লায় বদলির আদেশ হয়।”
চাকরি করার ইচ্ছা না থাকায় কুমিল্লা জেলা পুলিশে যোগদান করেননি বলে দাবি করেন শওকত।
৩৫৩ দিন পর গত ১ মার্চ কুমিল্লা জেলা পুলিশে যোগ দেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, “চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার জন্যই মূলত যোগদান করেছিলাম। সেখানেও আমি অব্যাহতির আবেদন করেছিলাম। আবেদনটি প্রসেস হওয়ার আগেই সিএমপি থেকে আগের বিভাগীয় মামলার অজুহাতে বরখাস্ত করা হয়।”
পুলিশের চাকরিতে ‘হিংসাত্মক’ আচরণের শিকার হয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
২০০৫ সালে কনস্টেবল হিসেবে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেওয়ার পাঁচ বছর পর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নগর পুলিশে বদলি হয়ে আসেন শওকত। নার্সিং ও প্যারামেডিক ডিপ্লোমাধারী হওয়ায় পদায়ন হয় দামপাড়া পুলিশ হাসপাতালে।
আরও ছয় সহকর্মীকে সাথে নিয়ে কনস্টেবল শওকত রাস্তার পাশে স্বজনহীন কাউকে শরীরে ক্ষত নিয়ে পড়ে থাকতে দেখলেই ছুটে যেতেন। হাসপাতালেও যাদের ঠাঁই হয় না, সেই সব রোগীদের জন্য ব্যবস্থা করেন চিকিৎসা, খাবার আর পোশাকের।
দীর্ঘদিন নীরবে কাজ করার পর ২০১৯ সালে ২৮ নভেম্বর নগর পুলিশের মাসিক কল্যাণ সভায় কনস্টেবল শওকত সেবার বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন। তার বক্তব্য শুনে তখনকার সিএমপি কমিশনার মাহবুবর রহমান ‘মানবিক পুলিশ ইউনিট’ চালু করেন।
রাস্তাঘাটে স্বজনহীন কোনো রোগী পড়ে থাকার খবর পেলেই ছুটে যেতেন এই ইউনিটের সদস্যরা। তাদের খাওয়া দাওয়াসহ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন।
মানবিক পুলিশ ইউনিটের এ কাজগুলো সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়লে কনস্টেবল শওকতও আলোচনায় আসেন। বিভিন্ন রেডিও, টেলিভিশনে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা সভায় তার ডাক আসতে থাকে।
২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি নগরীর দেওয়ান হাট এলাকায় একটি ওয়াজ মাহফিলে অতিথি করা হয় শওকতকে। সেখানে গিয়ে শওকত অসহায় মানুষদের সহায়তা করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সারাদিন ওয়াজ শুনেও কোনো লাভ নেই, সবাইকে মানবিক হতে হবে। সেখানে আরও কিছু বক্তব্য তিনি দেন, যা নিয়ে চট্টগ্রামে বিতর্ক শুরু হয়।
ওইসময় তাকে মানবিক পুলিশ ইউনিট থেকে বদলি করা হয় বন্দর জোনে। পরে তাকে পদায়ন করা হয় কর্ণফুলী থানায়। মূলত তখন থেকে নগর পুলিশে চালু করা মানবিক ইউনিটের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
পুরানো খবর: