Published : 30 Jun 2023, 06:48 PM
ঘন জঙ্গল ঘেরা উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ, মাঝখান দিয়ে সাপের মতে এঁকেবেঁকে চলে গেছে স্বচ্ছ পানির লেক; ফুল-পাখিদের মিলনমেলায় প্রাকৃতিক অপরূপ এই সৃষ্টি যে কাউকে দেবে অন্যরকমের অনুভূতি।
চট্টগ্রামে বন-পাহাড় ঘেরা নির্মল প্রাকৃতিক এই পরিবেশে পর্যটকদের ভিন্ন রকমের রোমাঞ্চের অনুভূতি দেবে ফয়’স লেক বেইসক্যাম্প।
এক পাহাড়ের চূড়া থেকে ঝুলে অন্য পাহাড়ে যাওয়া, সুনশান হ্রদের জলে নৌকা চালানো, জায়ান্ট সুইং, বিশাল হ্যামকে দলবেঁধে বসে আড্ডা দেওয়া, লেকের পাড়ে তাঁবুতে রাতযাপন আর রাতে পাহাড়ি পথে ট্রেইল- এমন সব আয়োজনে সাজানো হয়েছে বেসক্যাম্পটি।
চলতি বছর জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের প্রথম বেসক্যাম্প হিসেবে যাত্রা শুরু করা ফয়’স লেক বেইস ক্যাম্প ইতোমধ্যে কিশোর-তরুণ আর অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় নানা বয়সীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
৩৩৬ একরের বিশাল এলাকা জুড়ে ফয়’স লেক ঘিরে গড়ে ওঠা কনকর্ড ফয়’স লেক এমিউজমেন্ট পার্ক, ড্রাই পার্ক, ওয়াটাক ওয়ার্ল্ড আর ফয়’স লেক রিসোর্ট নিয়ে সাজানো নতুন সংযোজন এই বেইস ক্যাম্প।
ফয়’স লেকের পাড়েই বেসক্যাম্পের মূল ফটক। ভেতরে ঢুকে পাহাড়ি পথে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেই দেখা যায় জিপলাইনের কাঠামো।
সেখানে কয়েক শিক্ষার্থী জিপলাইনে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়ার জন্য ‘হারনেস’ পরে তৈরি হচ্ছিলেন। তাদের কেউ ততক্ষণে এক পাহাড় থেকে লেক পেরিয়ে অন্য পাহাড়ে চলেও গেছেন।
দলের সদস্য ইয়াশ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ছয়জন এসেছি। সবাই স্টুডেন্ট। চট্টগ্রামে এরকম অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ আগে ছিল না। শহরের ভেতর এমন সুন্দর ব্যবস্থা আগে জানা ছিল না। সবাই খুব মজা করেছি। অ্যাক্টিভিটিসগুলোও দারুণ।”
বেইস ক্যাম্পে সবই আউটডোর কার্যক্রম। এর মধ্যে রয়েছে- ট্রি টপ অ্যাডভেঞ্চার, অবস্টেকল কোর্স, জায়ান্ট সুইং, চিলড্রেন অ্যাক্টিভিটিস, জায়ান্ট হ্যামক, আর্চারি, ক্যাম্পিং, ওয়াটার জিপলাইন ও ক্রলিং।
জিপলাইনের চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠলেই ট্রি-টপ অ্যাডভেঞ্চার। সেখানে নিচে পাহাড়ি ঢাল, উপরে এক গাছ থেকে অন্য গাছে যেতে হবে কাঠের পাটাতন, টায়ার আর জিগজ্যাগ সরু কাঠের ব্রিজ বেয়ে।
এরপর অবস্টেকল কোর্স, তবে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অনুভূতি হবে জায়ান্ট সুইং-এ। বিরাট লোহার কাঠামোতে দুলে দুলে পাহাড়ের কিনার থেকে শহর দেখার সুযোগ আছে এখানে।
ফয়’স লেক বেসক্যাম্পের সহকারী ব্যবস্থাপক (অপারেশন) মোহাম্মদ ওমর ওসমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যত পেছন থেকে ছাড়া হবে জায়ান্ট সুইং-এ চড়া ব্যক্তি তত দূরে যাবে। দুলতে দুলতে পাহাড় ও শহরের বিশাল অংশ দেখাটা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের জন্য খুব আনন্দদায়ক।
“এর পাশেই আছে নাইট ট্রেইল। প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথ অনেকটাই নাইট সাফারির মত। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে সজারু, হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন প্রাণির দেখা মেলে এই ট্রেইলে।”
দিনের বেলায় খুব কমই এসব প্রাণির দেখা মেলে। তবে হরহামেশা দেখতে যায় নানা প্রজাতির পাখি।
পাহাড়ের কোল ঘেষে পাথর বসানো হাঁটার পথ। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় পাশেই ফোটা নাগবল্লী ফুল। ওই পথ ধরে এগিয়ে গেলেই লেকের ধারে ক্যাম্প ফায়ারের আয়োজন। রাতেও ক্যাম্প ফায়ারের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে।
এছাড়া পাশেই আছে রেস্টুরেন্ট, যেখানে খোলা আকাশের নিচে দুই পাহাড়ের মাঝের ঢালে বসে খাওয়ার সুযোগ, সামনে চোখ জুড়ানো এঁকেবেঁকে চলা লেক।
এর কাছেই রয়েছে কায়াকিং ও প্যাডেল বোটিং করার বন্দোবস্ত। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আসা কয়েক কিশোর কায়াকিং করছিল লেকে।
জানতে চাইলে তাদের একজন জাহিন হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লেকে কায়াকিং করে খুব আনন্দ পেয়েছি। ইটস এক্সাইটিং। জায়ান্ট হ্যামকও খুব ভালো লেগেছে। সব মিলিয়ে খুব সুন্দর আয়োজন। আবার আসব বন্ধুদের নিয়ে।”
যেখানে এসে লেকের বোট ভিড়ে, সেই ঘাটের পাশের টিলার উপরে ‘চিলড্রেনস হিল’। এখানে আছে শিশুদের জন্য নিরাপদে সময় কাটানোর আয়োজন। চিলড্রেন অ্যাক্টিভিটিস করতে পারবে ২-১০ বছর বয়সীরা।
এর পাশের টিলাতে জায়ান্ট হ্যামকে ২০ জনের দল উঠে বসে আড্ডা দিতে পারবে। আছে নিরিবিলিতে বসে লেক দেখার জন্য ছাউনি।
বেইস ক্যাম্পের আরেক আকর্ষণ ঝুলন্ত সেতু। ছোট ছোট কাঠের পাঠাতনে আর দঁড়িতে বানানো লেকের উপরের এই সেতু পার হওয়াও চ্যালেঞ্জের অংশ। আছে ক্যাম্প হিল, যেতে হবে ছোট্ট ‘উডেন ব্রিজ’ পেরিয়ে। সেখানে ক্যাম্প গ্রাউন্ডে ১০টি তাঁবু। কাঠের সুপরিসর পাটাতনের উপর এসব তাঁবু বসানো, যার সামনের অংশ খোলা। লেকমুখী এসব তাঁবুর সামনের পাটাতনে বসে রাতের আকাশে তারা দেখা যাবে। উপভোগ করা যাবে রাতে হ্রদের রাতের সৌন্দর্য্য।
বেইস ক্যাম্পের প্রশিক্ষক সাকিবুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেফটি ইস্যু পুরোপুরি নিশ্চিত করা হয়। ক্যাম্প গ্রাউন্ড যাতে নিরাপদ থাকে তার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি অ্যাক্টিটিভিটির আগেও সচেতনতার বিষয় নিশ্চিত করি, যাতে কেউ আঘাত না পান।”
বেইস ক্যাম্পের মাঝামাঝি লেকের পাড়ে রয়েছে ‘লোটাস পন্ড’, সামনেই গ্যালারি। এখানে বসে অথবা সামনের ছোট লেকভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে বর্ষায় লেকের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে।
বন্ধুদের সঙ্গে বেইস ক্যাম্পে ঈদের ছুটিতে ঘুরতে আসা ইমন কল্যাণ ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শহরের ভেতরেই এই আয়োজন আছে, আগে জানতাম না। পাহাড়, লেক আর সবুজে ঘেরা এক অন্য জগত। বর্ষায় বেশ উপভোগ্য।”
ফয়’স লেক অ্যামিউজমেন্ট পার্ক পরিচালনাকারী সংস্থা কনকর্ডের উপব্যবস্থাপক (মার্কেটিং) বিশ্বজিৎ ষোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শহরের মানুষ এখন বড় বড় দালানের বাসিন্দা। তারা সবুজ দেখতে পায় না। প্রকৃতির ছোঁয়া বঞ্চিত জীবনযাপন করে।
“এখানে প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানোর সুযোগ আছে। এখানে যে অ্যাক্টিভিটিস আছে তা যে কোনো বয়সের মানুষকে চাঙা করবে। নতুন উদ্যোম পাবেন তারা।”
বর্ষায় ফয়’স লেক বেসক্যাম্পে কাঠের বেঞ্চে বসে লেকের পানিতে অবিরাম বর্ষণ দেখে যেন নগর জীবনের সমস্ত ক্লান্তি কাটে ভ্রমণপিপাসুদের।