Published : 25 Jun 2025, 03:34 PM
বৃক্ষরোপণ অভিযানের উদ্বোধনে এসে দেশের নাগরিকদের 'ওয়ান টাইম প্লাস্টিক' ব্যবহার বন্ধের আহ্বান জানালেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে তিনি প্লাস্টিকের ভয়াবহ পরিবেশগত প্রভাব তুলে ধরেন। পরে একটি সোনালু গাছ রোপণ করে তিনি জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা ২০২৫ এর উদ্বোধন করেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ''আজকে পৃথিবী নানা রকমের সংকটে জর্জরিত, যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, অপব্যবহার আমাদের সামনে নানান রকম চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সে চ্যালেঞ্জ কী তা আমরা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারছি না, তা হল প্রকৃতির বিধ্বংসী রূপ। এটা প্রকৃতির দোষ না, আমাদের দোষ।
“আমরা এখানে যারা বসবাস করি, প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার কথা, তাল মিলিয়ে না চলে উল্টো দিকে চলি। দোষটা প্রকৃতির না। দোষটা হল, প্রকৃতি বিধ্বংসী এক জীবের, যার নাম মানুষ।''
তিনি বলেন, ''আমাদের সামনে দৈত্যাকারে হাজির হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জলবায়ু সংকট। প্লাস্টিকের ব্যবহার পৃথিবীতে তীব্র ধরনের সংকটকে বাড়িয়ে দিয়েছে। জলবায়ুগত সংকট, প্রকৃতিগত সংকট, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি। এ শুধু প্লাস্টিকের জন্য না। আরো বহু জিনিস আছে।
“প্লাস্টিক এমন জিনিসে দাঁড়িয়ে গেছে যে ক্রমাগত হুংকার দিচ্ছে। ‘হয় আমরা থাকব, না হয় তোমরা থাকবে। দুজন একসঙ্গে থাকতে পারবে না।’ এবং তাদের জয়যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসে আমাদের অসহায়ত্ব দেখে। আমাদের উদ্যোগের অভাব দেখে। ‘আমরা সব জয় করে নিলাম, তোমরা কিছুই করতে পারছ না।’।”
ইউনূস বলেন, “সেই অসহায় অবস্থায় থেকে আজকে আমরা ২০২৫ সালের এই দিবস উদযাপন করছি। প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক না থাকায় পৃথিবীর জলাশয়গুলো পলিথিন আর প্লাস্টিকে ছেয়ে গেছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়ছে।''
'বিশ্বে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অবস্থান যে নবম, সেই তথ্য তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এতে খুশি হব না কি নারাজ হবো বুঝতে পারছি না। মানে কারো কোনো অবস্থান থাকবেই কে এটার মধ্যে। এই জিনিসের জন্য আমরা কেন আত্মাহুতি দেব? পরিষ্কার, আমরা সুইসাইডাল পথে আছি, আত্মাহুতির পথে আছি। এবং সেটা শুধু একদিনে বসে আনুষ্ঠানিকভাবে সবাই বসে আলাপ করে বাড়ি ফিরে যাব, আবার যথারীতি আমাদের জীবন চলতে থাকবে ধ্বংসের পথে।''
দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, কৃষি জমি, গ্রাম ও নগরের আনাচে-কানাচে পলিথিন আর প্লাস্টিক যেভাবে ছড়িয়েছে, তা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “আমরা সবাই জানি। কোন কোন নদীর নিচে তলদেশে সাত-আট ফুট প্লাস্টিকের আস্তরণ পড়ে গেছে ইতোমধ্যে। এটা শুধু উদ্বেগজনক নয়, এটা ভয়ঙ্কর।
“এর চেয়েও ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, যেটা খালি চোখে দেখা যায় না। একটু আগে রিজওয়ানা আমাদেরকে বোঝাল, মায়ের দুধের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক, আর তার যাবার জায়গা কী বাকি রইল! শিশু জন্ম থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। কয়েকদিন আগে দেশের ইলিশ মাছের ভেতর মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, সেটা তো একটা মাছ, আরো বহু মাছ আছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের আর দেরি করার সময় নেই, আমাদের এখনই জেগে উঠতে হবে, যে এই সমস্যার সমাধান না হলে আমাদের অস্তিত্ব নাই।''
'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েই যে পলিথিন শপিং ব্যাগের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে, সে কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, “প্লাস্টিকের বহুরূপ, তার মধ্যে একটা রূপ হল পানির বোতল। আমাদের মন্ত্রণালয় এটাকে একটা সিম্বল হিসেবে, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিম্বল হিসেবে এই আন্দোলনটা শুরু করেছে।
“হাসাহাসি হয়েছে, কিন্তু মানুষ অন্তত আলোচনায় আনতে বাধ্য হয়েছে। কী হবে এটা দিয়ে? ভালো বিষয় হচ্ছে, আমার কাছে যেটা আশ্বাস দিতে পারে আমাকে। যারা বয়সে যত তরুণ, তারা তত সিরিয়াস বিষয়টাকে দেখে। আমরা যারা বয়স্ক হয়ে গেছি, আমাদের কোনো গ্রাহ্য হয় না। তরুণরা চিন্তা করছে, আমরা আশা করি, আরো বেশি চিন্তা করবেন—এই পৃথিবীতে তাদের বেঁচে থাকতে হলে। এই হল তাদের এক নম্বর শত্রু। দ্বিতীয় শত্রু কোথায়, কীভাবে আসবে জানি না। এটার থেকে মুক্তি না পেলে আর বাকিগুলোর প্রশ্ন ওঠে না।''
ইউনূস বলেন, 'প্লাস্টিক দূষণ কমিয়ে আনার বড় উপায় হল যতটা সম্ভব এর ব্যবহার বাদ দেওয়া।
“বর্জনটা তখন লাগবে জন্ম লাভ করার পরে। আমার তো ধারণা গোড়াতে যেতে হবে—উৎপাদন বন্ধ করা। একজন উৎপাদন করে ফেলেছে, তারপর বর্জন দুজনের লেগে গেল। গোড়াতে যদি আমরা উৎপাদনটাই বন্ধ করতে পারি, তাহলে আর বর্জনের প্রশ্ন আমাদের থাকে না। আমাদের সমস্যার মধ্যে আমরা পড়ি না।
“উৎপাদন বন্ধ করলে যে দুনিয়া অচল হয়ে যাবে, তাও না। কষ্ট হবে। এটা সহজ জিনিস মনে হচ্ছিল, এটা সহজ দেখা—কঠিন হবে। পলিথিন বেশিদিন আগের জিনিস না, মাত্র সেদিনের জিনিস। আমাদের বয়সে পলিথিনের জন্ম। এর আগে ছিল না। পলিথিন ছাড়া পৃথিবী অচল—এ কথা বলার কোনো সাধ্য নাই।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবী চলেছে, মানুষের পরিবর্তন হয়েছে, ইতিহাসের পরিবর্তন হয়েছে, অর্থনীতির পরিবর্তন হয়েছে। প্লাস্টিক দরকার হয়নি।
“হঠাৎ এসে সে বিশ্বজয় করে বসে গেল এবং আমরাও এরকম অ্যাডিক্টেড হয়ে গেলাম, চোখ খুলে তাকাতে পারছি না আর। সেটাই হলো ব্যাপার। আমি দেশের সকল নাগরিকের প্রতি ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আবেদন করছি।''
ইউনূস বলেন, “আমরা একটা পদ্ধতি তরুণদের জন্য শুরু করেছিলাম। সেটা বলতে পারি। জিরো ওয়েস্ট এর পদ্ধতি হিসেবে। সপ্তাহে যদি এই সাত দিনের মধ্যে সাত দিনে প্লাস্টিক ব্যবহার করি। আমার প্রথম কমিটমেন্ট হল নিজের কাছে—আজকে থেকে আমি একদিন কমিয়ে ফেলব। ছয়দিন করব, একদিন করব না। ওইদিন আমার প্লাস্টিক ফ্রি।
“তরুণরা এটা সহজে বোঝে যে একটা দিন আমি পারি তো না। একটা দিনে যদি তুমি পার, এস্টাবলিশ করতে পার যে একটা দিন—শনিবার আমি প্লাস্টিক ব্যবহার করি না। কোনো রকমের ব্যবহার না করে, তাহলে চেষ্টা করো শনি আর রবি দুইদিন করতে পার কিনা। ক্রমে ক্রমে সাত দিনে যাওয়া—স্টেপ বাই স্টেপ যদি অভ্যস্ত হও, সতর্ক হও, তাহলে হয়তো হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা লাগবে। সিদ্ধান্ত ছাড়া ওই পথ—কঠিন পথ। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমি ইতোমধ্যে সরকারি সকল কার্যালয়কে একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছি। ”
তিনি বলেন, “জাতিসংঘ প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নের কাজ প্রায় চূড়ান্ত করেছে। বন পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে জোরালো ভূমিকা রাখবে—এটা আমি নিশ্চিত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই উদ্যোগগুলো সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে শালবন, সোনাদিয়া বন আর চুনতি বন তার হারানো রূপ ফিরে পাবে।
“বন্য প্রাণীরা আবার তাদের আবাসে ফিরে আসবে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নদীকে দখল-দূষণমুক্ত করার কাজ মন্ত্রণালয় শুরু করে যেতে পারবে বলে আশা করি। আমরা আশা করি, নতুন প্রজন্ম এই শহরেই দূষণমুক্ত নদী দেখতে পাবে। ঢাকা শহরের পাশেই দেখবে পূর্বাচল বন।''
ইউনূস তার বক্তব্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তরুণ প্রজন্মের শক্তির কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “এদেশের তরুণ প্রজন্মের কী অসীম শক্তি আমরা গত জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেখেছি। আমি আজ আবারও বাংলাদেশের তরুণ সমাজের প্রতি আমার আস্থা ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। একই সাথে স্মরণ করছি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সকল শহীদদের এবং যারা আহত হয়েছেন, তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।
“তরুণরাই আমাদের নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি বরাবরের মত আবারও বলছি, এই তরুণ প্রজন্মই ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী। সবচেয়ে চেয়ে সৃজনশীল তরুণ প্রজন্ম। আমি এদেশের তরুণ সমাজের প্রতি আহ্বান জানাই, জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় এবং পরিবেশ দূষণ রোধে, তোমরা তোমাদের কার্যকর ভূমিকা অবশ্যই রাখবে। নিজের মধ্যে এমন সংকল্প করতে হবে যে আজ থেকে আমি আমার দৈনন্দিন জীবনে কার্বন নিঃসরণ শূন্যতে নিয়ে আসবো। আমি এখন প্রতিদিন এটা পদক্ষেপে এগিয়ে যাব।''
তিনি বলেন, “দেশের সকল নাগরিকের প্রতি আমি আহ্বান জানাই—আমাদের অবশ্যই আত্মবিধ্বংসী চিন্তাভাবনা থেকে মুক্ত হতে হবে। অর্থনৈতিক লাভের জন্য পরিবেশের ক্ষতি করে যাব—এটা আমি কিছুতেই নিজেকে মানতে দেব না। বন্যা, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস—এ ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় আমরা বুঝতে পারি যে প্রকৃতি কত শক্তিধর।
“আমরা যদি পরিবেশ ও জলবায়ু বিপর্যয়কে বাড়াতে না চাই, অবশ্যই আমাদের পরিবেশ উন্নয়নে নজর দিতে হবে। নদী ধ্বংস করে, বন জঙ্গল উজাড় করে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে যা হয়, অন্য যাই কিছু হোক, অবশ্যই এটা উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন সম্বন্ধে আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে দিতে হবে।''