Published : 07 Oct 2022, 11:48 PM
‘যে ক্লাসের একটি দরজা খুলে দেয়, সে একটি জেলখানা বন্ধ করে দেয়’, বিদ্যালয় সম্পর্কে এমনই একটি কথা বলেছিলেন ফরাসি লেখক ও কবি ভিক্টর হুগো। বিদ্যালয় সব শিক্ষার্থীর কাছেই একটি আদর্শ, ভরসা, শিক্ষা ও আবেগের জায়গা।
কিন্তু আমার কাছে এর চেয়েও বেশি কিছু। আমি যখন প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যাই তখন মনে হয় প্রত্যেকবারই একটা অজানা ভুবনে ভ্রমণ করছি এবং নতুন নতুন জিনিস শিখছি। বিদ্যালয়ের প্রতিটি পরতে পরতে আমি খুঁজে পাই আনন্দ, আবেগ এবং এক সৌন্দর্যের আভা। আমার কাছে আমার বিদ্যালয়ই পৃথিবীর সেরা বিদ্যালয়।
আমার বিদ্যালয়ের নাম ‘সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়টি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তথা এই এলাকার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক অম্লান ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে।
এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকাপাকিভাবে যখন স্কুল খুলল তখন যেন আমরা আবার প্রাণ ফিরে পেলাম। নতুন করে সব শুরু করলাম; স্কুল আর স্কুলের মানুষগুলোকে আবার চিনতে শুরু করলাম। নতুন উদ্যমে শিক্ষকদের সহায়তায় কাজ শুরু করলাম স্কুলটাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দীর্ঘ পাঁচ বছর একটি পরিবেশে কাটানোর পর যখন প্রথম ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমি সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যলয়ে আসি তখন মনে মনে যে শিহরণ অনুভব করি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে যখন একটু একটু করে মানিয়ে নিচ্ছি তখন আস্তে আস্তে পরিচিত হতে লাগলাম স্কুলের নতুন বন্ধু ও শিক্ষকদের সাথে।
এই স্কুলে দীর্ঘ দুই বছরের জীবনে আমি শিক্ষকদের কাছ থেকে যা শিখতে পেরেছি, তাদের কাছ থেকে যে স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছি তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু রৌদ্রজ্জ্বল আকাশে হঠাৎই ২০২০ সালে কালো মেঘের মতো ঘনিয়ে আসে করোনাভাইরাস। ওই বছরের ১৭ মার্চ বন্ধ হয়ে যায় স্কুল। তখন যে কী দুঃখ হয়েছিল! বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো খুনসুটি মাখানো অমূল্য কিছু মুহূর্ত, শিক্ষকদের ভালোবাসা মাখানো বকুনি, পরিচিত ক্লাসরুমের চেনা গন্ধ, টিফিন ভাগ করে খাওয়ার আনন্দ সবকিছু থেকেই আমরা বঞ্চিত হই। জীবনটা যেন ক্ষণিকের জন্য থমকে গিয়েছিল।
সপ্তাহ শেষে যখন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে একদিনের জন্য আমরা স্কুলে আসতাম তখন আমাদের খুশি আর দেখে কে! কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমরা তো বন্ধু ও শিক্ষকদের সাথে আবার দেখা করতে পারব!
অবশেষে যখন ২০২২ সালে অর্থাৎ এই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকাপাকিভাবে স্কুল খুলল তখন যেন আমরা আবার প্রাণ ফিরে পেলাম। নতুন করে সব শুরু করলাম; স্কুল আর স্কুলের মানুষগুলোকে আবার চিনতে শুরু করলাম। নতুন উদ্যমে শিক্ষকদের সহায়তায় কাজ শুরু করলাম স্কুলটাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে। সব জাতীয় দিবস ও বিশেষ দিনে স্কুলে শুরু করলাম বিভিন্ন কার্যক্রম। নবরূপে সাজিয়ে তুললাম স্কুলটাকে। অংশগ্রহণ করতে লাগলাম বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়।
এবছর বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় আমি ‘ভাষা ও সাহিত্য’ বিষয়ে উপজেলা পর্যায়ে ‘ক’ গ্রুপে প্রথম ও জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহের প্রতিযোগিতায় ‘বাংলা কবিতা’ বিষয়ে ‘ক’ গ্রুপে উপজেলা পর্যায়ে প্রথম হই। শিক্ষকদের সহায়তায় স্কুলে গঠন করি বিজ্ঞান ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কমিটি। বিদ্যালয়ের এ কাজগুলো করতে করতে কখন যে কিছু বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব আরও ঘনিষ্ঠ হলো তা বুঝতেই পারিনি। আমার সুখ-দুঃখের নিঃস্বার্থ সঙ্গী তারা।
আমার কাছে তিনি একজন অল-রাউন্ডার। স্যার খুব চমৎকার কবিতা লিখতে, গান গাইতে ও আবৃত্তি করতে পারেন। আমার তো কখনও কখনও মনে হয় কী পারেন না তিনি!
এই যে আমি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছি, বিজয়ী হচ্ছি তার পেছনে যে বিশেষ মানুষটির অবদান রয়েছে তিনি হলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক শ্রদ্ধেয় আব্দুর রহিম স্যার। আমার এগিয়ে চলার পথে তার অবদান অনস্বীকার্য। আবৃত্তি বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার সুবাদে যদিও আমি তাকে বহু আগে থেকেই চিনতাম; কিন্তু হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর স্যারকে আরও ভালোভাবে চিনতে পারি। স্যারের সান্নিধ্যে থেকে কাজ করাটা যে কতটা সৌভাগ্যের ও আনন্দের তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
স্যার যখন ক্লাস নিতে আসেন তখন যেন ক্লাসের ৪৫ মিনিট খুব তাড়াতাড়ি চলে যায়। ক্লাসের কোন শিক্ষার্থীকে শাসন না করে, বকা না দিয়ে ক্লাসের পড়ার প্রতি তাদের মনোযোগী করে তোলার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে তার। আমার কাছে তিনি একজন অল-রাউন্ডার। স্যার খুব চমৎকার কবিতা লিখতে, গান গাইতে ও আবৃত্তি করতে পারেন। আমার তো কখনও কখনও মনে হয় কী পারেন না তিনি! স্কুলের বিভিন্ন কাজে অংশ নেওয়া, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রাখা, সবকিছুতেই তো আমার প্রিয় রহিম স্যারের উৎসাহ রয়েছে।
আমার স্কুলের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো আমার স্কুলের লাইব্রেরি। প্রথম যেদিন লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিল আমি যেন এক অজানা বইয়ের রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছি।
স্কুল সম্পর্কে যখন লিখছি তখন তো আমার স্কুলের সবচেয়ে পছন্দের জায়গাটা সম্পর্কে লিখতেই হয়। আমার স্কুলের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো আমার স্কুলের লাইব্রেরি। প্রথম যেদিন লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিল আমি যেন এক অজানা বইয়ের রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছি। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, কমিক্স, সায়েন্স ফিকশন, কী বই নেই সেখানে! লাইব্রেরিটা যেহেতু আমার ক্লাস রুমের পাশেই তাই সেটাকে আমার একরকম প্রতিবেশীই বলা চলে।
স্কুলে যখন পড়ছি, প্রতিদিন ক্লাস করছি, তখন তো স্কুলের বিভিন্ন ঘটনা চিরদিনের স্মৃতি হিসেবে থেকেই যায়। তেমনই একটি স্মৃতি হলো আমাদের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও তার প্রস্তুতির দিনটি। খেলাধুলা যেহেতু খুব একটা করতে ভালোবাসি না, এমনকি পারিও না, স্বাভাবিকভাবেই এই দিনটির জন্য আমার বিশেষ কোন কাজ নেই। কিন্তু প্রতিযোগিতার একদিন আগে রহিম স্যার ডেকে নিয়ে আমাকে ক্রীড়া শপথ করার দায়িত্ব দিলেন। দিনটি ছিল এই বছরেরই ৩১ মার্চ। ওই দিনই ক্লাস শেষে আমাদের চারুকলা শিক্ষক অনুপম স্যার আমাদের স্কুলের সামনের জায়গাটিতে আলপনা আঁকার জন্য বললেন। আমিসহ আরও কিছু বন্ধু রাজি হয়ে গেলাম।
ছোটবেলা থেকে আমি ছবি আঁকা শিখলেও আলপনা দেওয়া এই প্রথম। কিছুটা দ্বিধা থাকলেও সাহস নিয়ে কাজে নেমে পড়লাম। সবকিছুই অনুপম স্যার দেখিয়ে দিলেন। সবাই মিলে হৈ চৈ করতে করতে আলপনা দিলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। যদিও পরদিনই ক্রীড়া অনুষ্ঠানটি ছিল, স্কুলের জন্য কিছু করতে পারবো ভেবেই সব ক্লান্তি যেন মুছে গিয়েছিল। যাই হোক, অবশেষে আমরা কিন্তু খুব সুন্দর আলপনা আঁকলাম। পরদিন অনুষ্ঠানটিও খুব ভালভাবে হলো।
এইতো হাসি-আনন্দ, দুষ্টুমি সবকিছু মিলেই আমার স্কুল জীবন। জীবনের স্বর্ণ মুহূর্তটা, প্রধান সময়টা এই স্কুলে কাটাতে পেরে আমি সত্যিই আনন্দিত। স্কুল জীবনের এই সময়টাকে, স্কুলের সব শিক্ষককে কখনও আমি ভুলব না। আজীবন আমার প্রিয় স্কুলটাকে আমি মনে রাখব।
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!