Published : 11 Aug 2016, 02:14 PM
রেলগাড়িতে করে ভ্রমণ করার কথা মনে পড়তেই যেন চমৎকার এক শিহরণ জাগে হৃদয়জুড়ে। টিকেট করে রেলগাড়িতে উঠে বসা; এরপর রেলগাড়ির ইঞ্জিন জোরে হুইসেল দিয়ে ঝপাঝপ শব্দ করে দ্রুতগতিতে অনেক যাত্রী নিয়ে ছুটে চলা আর একে একে সবুজ মাঠঘাট, নদীনালা, গ্রামগঞ্জ পেছনে ফেলে যাওয়া– এসবের আনন্দই আলাদা।
এছাড়া রেলগাড়ির ভেতরে আবার নানা জিনিসপত্রের ফেরিওয়ালাদের চমৎকারভাবে যাত্রীদের ভুলিয়েভালিয়ে এটা-ওটা বিক্রি করা; সব মিলেমিশে রেলভ্রমণের আনন্দ সম্পূর্ণ এক আলাদা অনুভুতি! সত্যিই রোমাঞ্চকর!
ছাত্র থাকাকালীন সময়ে A Journey by train একটি রচনা কতবার যে মুখস্থ করেছি তার সীমা-পরিসীমা নেই। যতবার মুখস্থ করেছি ততবারই মনে হত, রেলে করে চলে যাচ্ছি মামার বাড়ি বা অন্য কোথাও– দূরদূরান্তে।
একবার রেলে ভ্রমণ করলে, তার টিকেটটি অনেকদিন যত্ন করে রেখে দিয়েছি বন্ধুদের দেখাব বলে। রেলে করে একস্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করা এবং তার অভিজ্ঞতা অন্যকে বলা ছিল সত্যিই অহংকারের বিষয়! বন্ধুরা যারা কোনোদিন রেলে চড়েনি, তারা শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত আর রাতে স্বপ্ন দেখত তারা কবে রেলে চড়বে!
তবে বাংলাদেশে বরিশাল, পটুয়াখালী বা ওই অঞ্চলের অনেক লোকজন সারা জীবনে কোনোদিন রেলগাড়ি দেখেনি। রেলগাড়ি চড়ার বর্ণনা তারা কালেভদ্রে শুনেছে। সময় এসেছে সে অবস্থা পরিবর্তনের। এবার হয়তো তারাও দেখতে পাবে রেলগাড়ি, শুনতে পাবে রেলগাড়ির শব্দ।
অপু ও দুর্গার রেলগাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা এবং তার যে অসামান্য আনন্দ; সত্যজিৎ রায় প্রকাশ করেছেন তাঁর 'পথের পাঁচালি' চলচ্চিত্রে নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে। সেই দৃশ্যপট চিরকাল মনে রাখার মতো, যখন কাশবনের পাশ দিয়ে প্রবল শব্দ করে রেল নামক এক দৈত্য চলে গেল অপু-দুর্গার পাশ দিয়ে।
বাংলাদেশে রেল চলাচল শুরু হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর; এখন থেকে প্রায় ১৫৪ বছর আগে। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে অগ্রগতি হয়েছে, বিশেষ করে সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে। কিন্তু রেলওয়ের ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি।
অথচ রেলপথে চলাচল করতে অনেকে আগ্রহী, বিশেষ করে শিশুরা, মহিলা, বয়স্ক ও অসুস্থ লোকজন। এছাড়া রেল যেমন গরিব মানুষের পরিবহন, তেমনি সেখানে তাপানুকুল ব্যবস্থাও থাকে পয়সাওয়ালা যাত্রীদের জন্য। ব্যবস্থা থাকে ভোজনবিলাসিদের রসনাতৃপ্তির সুযোগ, আবার গরিবের আছে পেট ভরে খাওয়ার সুবিধা। আছে প্রস্রাব-পায়খানার সুব্যবস্থাও।
রেলভাড়া যা-ই হোক না কেন, সব যাত্রী একই সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে, আর হুলুস্থুল করে গাড়ি থেকে নামবে; তার আনন্দই আলাদা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সম্প্রসারণ হচ্ছে– এমন একটি খবর আনন্দের এবং অহংকারের বিষয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে চীনের 'চায়না রেল গ্রুপ লিমিটেড'এর গত ৮ আগস্ট একটি চুক্তি হয়েছে। রেলওয়ে খাতে এটি হচ্ছে সবচেয়ে বৃহৎ চুক্তি। এর মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর অবধি পদ্মাসেতুর ওপর দিয়ে রেললাইন চলে যাবে। ঢাকায় টিকেট কিনে বসলে যাত্রী সাধারণ চলে যাবে যশোর– কোনো ভাবনা নেই, দুধারে দেখবে পদ্মা নদীর ঢেউ আর অসামান্য প্রাকৃতিক বাংলার অপূর্ব দৃশ্য।
এই চুক্তির অধীনে মোট ২১৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন বসবে। চুক্তি করেছেন রেলওয়ের মহাপরিচালক জনাব আমজাদ হোসেন এবং চীনা কোম্পানিটির ডিজিএম ঝাং সুইচি। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে চীনের ঋণ হচ্ছে ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। বাকি ১০ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা জোগান দেবে বাংলাদেশ।
এক হিসাবে দেখা যায়, পদ্মা সেতুর জন্য ব্যয় হতে পারে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। অথচ পদ্মা সেতুর ওপর রেল চলাচলের খরচ হবে তারও বেশি। যতটুকু জানা যায়, ৬৬টি ব্রিজ হবে এই পুরো রেলপথে, ২৪৪টি ছোট বড় কালভার্ট হবে, থাকবে ৩০টি লেভেল ক্রসিং, ১৪টি নতুন স্টেশন স্থাপন এবং ৬টি পুরনো স্টেশনের নবায়ণ। এছাড়া ব্রডগেজে চলার মতো ১৯৬টি যাত্রীবাহী কোচ দেবে চীন এই চুক্তির অধীনে।
বিশাল কর্মযজ্ঞ, বিশাল প্রকল্প। তবে বড় কথা হচ্ছে, এমন একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন বা তদারকির দক্ষতা বাংলাদেশে রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের আছে কি না?
বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের জনবলের সংখ্যা ২৫ হাজারের কিছু বেশি। মোট দুই হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথ আছে দেশে, যার মধ্যে ৬৫৯ কিলোমিটার ব্রডগেজ। ইন্টারসিটি ট্রেনের সংখ্যা ৮৬টি, মেইল ট্রেনের সংখ্যা ৫২টি এবং কমিউটারের সংখ্যা ৬৪। সব মিলিয়ে ৩৩৯টি ট্রেন চলাচল করে সারা দেশে।
এ সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল, জনগণের চাহিদা পূরণে নিতান্ত অপর্যাপ্ত যা অনুধাবন করা যায় ঈদের ছুটির প্রাক্কালে। যখন মানুষ এক দিন আগে রাতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে একটি টিকেট পাবে বলে। তখন বোঝা যায় রেলওয়ের টিকেট যেন সোনার হরিণ।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে রেললাইন আছে– অনেক ক্ষেত্রে তার অবস্থা ভালো নয়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই উন্নত করার বিশেষ প্রয়োজন আছে। যশোর থেকে বেনাপোল অবধি রেললাইনের অবস্থা খারাপ। যশোর থেকে খুলনা যেতে পাঁচবার রেললাইন ক্রস করতে হয়। অথচ সম্ভবত ঢাকা থেকে মাওয়া অবধি হচ্ছে ব্যয়বহুল উড়াল রেলওয়ে।
রেল পরিবহনের যেমন অনেক সুযোগ আছে, তেমনি আছে ব্যাপক চাহিদা; সংস্কার এবং সম্প্রসারণের বিশাল ক্ষেত্র। যে কয়টি স্থলবন্দর আছে, তার প্রত্যেকটির সঙ্গে রেল যোগাযোগ উন্নত হলে বাণিজ্যিকভাবে রেল কর্তৃপক্ষ অনেক লাভবান হতে পারে। একটি সমীক্ষা অবশ্যই হতে হবে; কোথায় এবং কোন এলাকায় রেলের সম্প্রসারণ প্রয়োজন জাতির বৃহত্তর স্বার্থে।
এমন একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণের আগে অনেক ক্ষেত্রে ভালোভাবে এর ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয় না। যেমন ভারতে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ রেলওয়ের নেটওয়ার্ক আছে সত্য, কিন্তু কোথাও ২০০ কিলোমিটারের অধিক বেগে রেলগাড়ি চলার সুযোগ নেই।
তাই এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাপানের সঙ্গে ৫০০ কিলোমিটার বেগে মুম্বাই ও আহমেদাবাদের মধ্যে চলার উপযোগী বুলেট ট্রেনের জন্যে চুক্তি করেছেন। তবে রেলের অবকাঠামো মজবুত না করে এভাবে জাপানি সাহায্য গ্রহণের বিষয়টি ব্যাপকভাবে সমালোচনা করছে অনেক ভারতীয়।
তাই যাত্রী চলাচলের সুযোগ, মালামাল পরিবহনের সুবিধা এবং অর্থনৈতিক ফলাফল ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতে রেলের আরও সম্প্রসারণ করা হবে।
রেলভ্রমণ আনন্দদায়ক হবে– এটাই জনগণের প্রত্যাশা।