Published : 03 Jul 2025, 08:32 AM
বর্তমান বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বেশিরভাগ মানুষই এই মাধ্যমকে বেছে নেন তাদের মতামত প্রকাশের জন্য। একদিকে যেমন অ্যাকটিভিজম বা সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে কণ্ঠ উঠছে, অন্যদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ট্রোলিং নামক এক বিষ। এই দুইয়ের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে এক গভীর দ্বন্দ্ব।
ট্রোলিং বলতে বোঝায় কাউকে উসকানো, অপমান করা বা বিদ্রূপের মাধ্যমে মানসিক আঘাত দেওয়া। অনলাইনে ট্রোলিং এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাংলাদেশে ট্রোলিংয়ের কয়েকটি ধরন প্রচলিত, যেমন: টেক্সট-ভিত্তিক, ভিডিও এবং ছবি বা মিম ব্যবহার করে ট্রোলিং। ট্রোলিংয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো—গুজব ছড়ানো, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে গোপনীয়তা লঙ্ঘন এবং সাইবার বুলিংয়ের মাধ্যমে অপমান ও মানসিক চাপ সৃষ্টি।
অনলাইনে ট্রোলিংয়ের পেছনে কিছু মানসিক বৈশিষ্ট্য কাজ করে, যা ‘ডার্ক টেট্রাড’ নামে পরিচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলো—নার্সিসিজম, সাইকোপ্যাথি, মেকিয়াভেলিয়ানিজম এবং স্যাডিজম। নার্সিসিস্টরা মনে করেন, তারাই সবার সেরা এবং অন্যকে অপমান করে নিজের গুরুত্ব বাড়াতে চান। সাইকোপ্যাথরা অন্যের কষ্টে সহানুভূতি দেখান না, নির্দ্বিধায় অপমানজনক মন্তব্য করেন। মেকিয়াভেলিয়ানরা কৌশলে অন্যকে ঠকিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করেন। আর স্যাডিস্টরা অন্যের কষ্ট দেখে আনন্দ পান। এই মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে অনেকে ট্রোলিং করে, যা শুধু বিনোদন নয়, বরং একটি মানসিক ও সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।
অ্যাকটিভিজম: গণতন্ত্রের নতুন কণ্ঠস্বর
অ্যাকটিভিজম হলো একটি সংগঠিত প্রচেষ্টা, যা সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য পরিচালিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণসচেতনতা বাড়ানো। বর্তমানে অ্যাকটিভিজম শুধু রাস্তার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নয়, এটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত বিষয়ে মানুষ সোচ্চার হচ্ছে এবং বিভিন্নভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করছেন।
সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে অ্যাকটিভিজম বিভিন্ন ধাপে কাজ করে। কোনো একক ব্যক্তির মাধ্যমে নয়, দলগতভাবে পরিচালিত হয় এটি। অ্যাকটিভিস্টরা প্রথমে সমাজের সমস্যা চিহ্নিত করেন, তারপর সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এই কর্মসূচিগুলোর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যাম্পেইন অন্যতম। বিশেষ করে হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে অনেক অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া যাচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। যেমন, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নতুন আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
এছাড়া নারী অধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে #MeToo হ্যাশট্যাগটি নারীর নিরাপত্তা ও সম্মানজনিত বিষয়গুলোকে সামাজিক আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। ফেইসবুক, টুইটার, টিকটক ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো অ্যাকটিভিজমের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সুতরাং, ট্রোলিং যেখানে সস্তা বিনোদন, সেখানে অ্যাকটিভিজম একটি দায়িত্বশীল আচরণ।
ট্রোলিংয়ের ভয়: ডিজিটাল হুমকির নতুন অধ্যায়
ট্রোলিংয়ের ভয় ও চাপ অ্যাকটিভিজমের গতি কমিয়ে দিচ্ছে। অনেকের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর মুক্ত মতপ্রকাশের জায়গা নয়; বরং এটি ভয় ও হুমকির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রোলিংয়ের মাধ্যমে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানকে হেয় করা হচ্ছে, ফলে অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ট্রোলিংয়ের শিকারদের মধ্যে অধিকাংশই ১৮-৩০ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী, বিশেষ করে নারী ও ধর্মীয়-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তরুণ অ্যাকটিভিস্টরাও এর শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশে নারী হয়রানি ও ট্রোলিংয়ের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ফেইসবুক, টিকটক, ইউটিউব বা ইনস্টাগ্রামে নারীদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, অপমানজনক মিম, এডিটেড ভিডিও ও ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এখন নিত্যদিনের ঘটনা। এই ট্রোলিং ও ডিজিটাল হয়রানি শুধু মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে না, নারীদের সামাজিক অংশগ্রহণেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব হয়রানিকারীর পরিচয় অজ্ঞাত থাকে, যা তাদের আরও বেপরোয়া করে তোলে।
নারী সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্টরা প্রায়ই যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য, মিম ও মেসেজের কারণে হেনস্তার শিকার হন, এমনকি জীবন হুমকিরও মুখোমুখি হন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি শুধু অনলাইন সমস্যা নয়, একটি সাংস্কৃতিক চর্চার রূপ নিচ্ছে। দ্রুত প্রতিরোধ না করলে নারীর নিরাপত্তা ও ডিজিটাল সহিংসতা আরও ভয়াবহ হতে পারে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরাও ট্রোলিংয়ের সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা রাজনৈতিক মেরুকরণের সময়।
তরুণ অ্যাকটিভিস্টরা যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ বা সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করেন, তখন তা ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর জন্য অস্বস্তিকর হয়। ফলে তাদের কণ্ঠরোধ করতেও ট্রোলিং ব্যবহৃত হয়। প্রায়ই দেখা যায়, কোনো ভিডিও বা মতামতমূলক কনটেন্ট প্রথমে প্রশংসা পেলেও, কিছুক্ষণের মধ্যে তা ভাইরাল হয়ে ট্রোলিংয়ের শিকার হয়। প্রশংসিত ব্যক্তি কিছুদিন পরই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের লক্ষ্যবস্তু হন। একদল প্রশংসা করেন, অন্যদল কুৎসিতভাবে ট্রোল করেন। ট্রোলাররা এটিকে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ বলে দাবি করলেও, তারা উপলব্ধি করেন না যে, শিকার ব্যক্তিরা কী মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যান।
ট্রোলিং ও অ্যাকটিভিজম পরস্পর বিপরীতভাবে কাজ করে। ট্রোলিংয়ের কারণে অনেক অ্যাকটিভিস্ট তাদের কাজ গুটিয়ে নিচ্ছেন। তরুণরা সামাজিক বিষয়ে মতপ্রকাশে ভয় পাচ্ছেন। অনেকে পরিবারের চাপে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। যেখানে জনগণই ক্ষমতার উৎস, সেখানে মতপ্রকাশে সংশয় কতটা যুক্তিসঙ্গত? কিছু মানুষ তথ্য যাচাই না করেই ট্রোলিং শুরু করেন, মিথ্যা রটনার মাধ্যমে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করেন। অনেকে যাচাই না করেই মিম, ভিডিও বা পোস্টে বিশ্বাস করে আক্রমণাত্মক আচরণ করেন। ফলে অনেকে ভিন্নমত প্রকাশে ভয় পান। আইনি সহায়তা নেওয়া গেলেও, বাস্তবে তা প্রায়ই জটিল বা সময়সাপেক্ষ হয়, ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন।
ট্রোলিং বনাম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মতপ্রকাশ ও অনলাইন নিরাপত্তা রক্ষার জন্য তৈরি হলেও, অনেকে দাবি করেন এটি ট্রোলিং রোধে ব্যর্থ। এই আইনের সহায়তা নিতে গিয়ে অনেকে উল্টো হয়রানির শিকার হয়েছেন। আইনি জটিলতা ও প্রশাসনিক উদাসীনতায় তারা আরও বিপদে পড়েছেন। বিজ্ঞজনেরা প্রশ্ন করেন, এই আইন কি সুরক্ষা না নিঃশব্দ করার হাতিয়ার? তবে, ২০২৪-২০২৫ সালে এই আইনে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এসেছে। ৯টি কঠোর ধারা বাতিল হয়েছে, যার মধ্যে মতপ্রকাশের অধিকারে বাধা দেওয়ার ধারাও রয়েছে। তবে, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক কৌশল নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, দ্রুত আইন প্রণয়নের কারণে যথাযথ জনসভার সুযোগ পাওয়া যায়নি, এবং অনেক ধারা এখনও অস্পষ্ট ও অদূরদর্শী।
ডিজিটাল প্রেক্ষাপটে এক জটিল দ্বন্দ্ব চলছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কখনো মতবিরোধ তৈরি করছে, আবার কখনো এই স্বাধীনতার পথই সংকুচিত হচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব তখনই শেষ হবে, যখন মানুষ সহনশীল মতপ্রকাশের সংস্কৃতি গড়ে তুলবে। শেয়ার করার আগে তথ্য যাচাই করা জরুরি। তরুণদের মধ্যে ডিজিটাল এথিকস, দায়িত্বশীলতা ও সাইবার সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। রিপোর্টিং, ফ্যাক্ট-চেকিং ও কনটেন্ট ফিল্টারিং আরও কার্যকর করতে হবে।
ভয়, অপবাদ ও প্রতিহিংসার আশঙ্কায় মানুষ যদি নিজেকে দমিয়ে রাখে, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কীভাবে একটি সচেতন, মানবিক ও উন্নত রাষ্ট্র গঠন করবে? সরকার, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত দায়িত্ব হলো এই ভয়ের পরিবেশ দূর করা এবং এমন সমাজ গড়ে তোলা—যেখানে ভিন্নমত ও যুক্তিভিত্তিক তর্ক থাকবে, কিন্তু অপমান ও দমনের প্রবণতা থাকবে না। তবেই ট্রোলিং বন্ধ হবে এবং অ্যাকটিভিজম সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে উঠবে, গণতন্ত্র শুধু ভোটাধিকারে সীমাবদ্ধ থাকবে না।