Published : 24 Jun 2025, 08:48 PM
আগে সিনেমা হলের টয়লেটের দরজায় লেখা থাকত—‘প্রক্ষালন কক্ষ’। একদিন সেটা বদলে গিয়ে হলো ‘ওয়াশরুম’। এক হল মালিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম—“এত দিন পর বদলটা কেন?” তিনি মুচকি হেসে বললেন, “সাউন্ডস গুড!” মানে, ‘ওয়াশরুম’ শুনতে ভালো লাগে। তাই বদল।
ঠিক সেভাবেই, একসময় রাজনীতিতে প্রচলিত ছিল ‘মার্কা’ শব্দটি। এখন সেখানে এসেছে ‘প্রতীক’। কারণ? সম্ভবত প্রতীক হিসেবে শুনতেও সাউন্ডস গুড!
রাজনীতি হোক বা ব্যবসা—মার্কা এখন শুধু প্রতীক নয়, একেকটা শক্তিশালী ব্র্যান্ড! উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞা বলছে, ‘ব্র্যান্ড’ হলো এমন এক নাম, শব্দগুচ্ছ, চিহ্ন বা নকশা যা বিক্রেতা বা প্রতিষ্ঠানের পণ্যের স্বকীয়তা ফুটিয়ে তোলে এবং প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা করে। ভালো ব্র্যান্ড মানে—গুণগত মানের প্রতিশ্রুতি। ব্যবসায়, বিপণনে তো বটেই, হিসাববিজ্ঞানে পর্যন্ত ব্র্যান্ডকে ধরা হয় অলীক সম্পদ হিসেবে!
অনেকে রাজনীতি ও ব্যবসাকে আলাদা রাখতে চান। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় দুই জগৎই কর্পোরেট পুঁজির তাবেদার! রাজনীতি এখন ব্র্যান্ড-বাজারের খেলার মাঠ। তবে বাস্তব সত্য হচ্ছে, যে কোনো বিচারেই আমাদের দেশের তো বটেই, বিদেশেরও, খোদ বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিও ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে বহুকাল ধরে! আপনি কোন ব্র্যান্ডের শার্ট পরেন, কোন ব্র্যান্ডের দলকে ভোট দেন—সবই আপনার ব্যক্তিগত রুচির বিষয়। তবে, একবার ব্র্যান্ডেড হলে একটা বিপদ আছে। ক্ষমতা গেলে পাশে কাউকে পাওয়া যায় না! তাই অনেকে ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই খোঁজেন ‘বিক্রয়যোগ্য’ প্রতীক—সোজা কথায়, ব্র্যান্ডেড মার্কা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মার্কা কালচার বহু পুরনো—নৌকা, ধানের শীষ, দাড়িপাল্লা, কাস্তে, মশাল—সবই ঐতিহাসিক প্রতীক, আবার প্রতারণার প্রতীকও হতে পারে! যেমন একটি দেয়াললিখন বলছে— ‘নৌকা লাঙ্গল পাল্লা শীষ / সব সাপেরই এক বিষ’। সত্যি বলতে, প্রতীক কি কখনো সাপ হয়ে দংশন করে?
মার্কা নিয়ে কারা এমন উল্টাপাল্টা লেখালেখি করে জানা না গেলেও মার্কা বিষয়ক একটা গল্প তো বলেই নেওয়া যায়ই। এলাকার কমিশনার হিসেবে দাঁড়িয়েছেন চারজন–যার ভেতর দুজনের মধ্যে লড়াই হবে সবাই বুঝতে পারছে। কিন্তু তৃতীয়জন যার জেতার কোনো সম্ভাবনাই নেই, তিনি প্রতীক পেলেন কাঁঠাল। যার জেতাটা শতভাগ নিশ্চিত বলে মনে করে নেওয়া হয়েছিল তিনি প্রতীক পেলেন হাতি। কিন্তু নির্বাচনের পর দেখা গেল কাঁঠাল জিতে গেছে। কারণ কী? নির্বাচনের দিন সকালে বাড়ি বাড়ি ওই লোক কাঁঠাল ও মুড়ি বিতরণ করেছিলেন। কাঁঠাল মুড়ি দিয়ে নাস্তা করে মানুষ যেন ভোট দিতে যায় এবং ভোট যেন কাঁঠাল মার্কায় দেয়–এটাই ছিল কাঁঠাল মার্কা প্রার্থীর ইচ্ছে। বিপরীতে হাতি মার্কার প্রতিদ্বন্দ্বী তো বাড়ি বাড়ি হাতি পাঠাতে পারেননি, লোকজনদের হাতির পিঠে চড়িয়ে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারেননি।
বিয়ের সময় অভিভাবকরা পাত্রপাত্রীর বংশ-ঠিকুজি জানতে চান। রক্ত নাকি কথা বলে। ব্যবসা বা রাজনীতিতেও নাকি টাকা কথা বলে। মার্কা বা প্রতীকও অনেকটা তাই। মার্কা এখন কথা বলে ম্যাটার করে। নতুন করে মার্কা তাই আলোচনায় এবং শাপলা আলোচনার শীর্ষে।
বিশ্বরাজনীতির মার্কা নিয়ে অনেক জমজমাট কাহিনি আছে। যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানদের প্রতীক হাতি, আর ডেমোক্র্যাটদের গাধা। ইতিহাস বলছে, ডেমোক্র্যাট নেতা অ্যান্ড্রু জ্যাকসনকে ব্যঙ্গ করে ‘জ্যাক অ্যাস’ ডাকা হতো। এক ব্যঙ্গচিত্রে তার মুখে গাধার শরীর আঁকা হয়। সেটাই ক্রমে ডেমোক্র্যাটদের প্রতীক। অন্যদিকে, রিপাবলিকানদের প্রশাসনিক ভারকেও চিত্রিত করা হয় হাতি দিয়ে—ভারী ও অলস। তবু গাধা-হাতি মার্কা এখন শান্তির প্রতীক! কারণ দুইটাই বোঝা বইতে পারে, আবার ভোটও টানতে পারে!
ভোটের আগে আমেরিকানরা বিভাজিত হয়ে যতই ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াক, ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিপরীতে হাতি ও গাধা এই দুই প্রতীক যেন শান্তির প্রতীক, বাকি বিশ্বের কাছে না হলেও আমেরিকানদের জন্য। হাতি ও গাধা ভারবাহী। গাধা অবশ্য হাস্যরস ও বোকামির প্রতীক। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কাঁঠাল যতটা কার্যকর হাতি ও গাধা ততটা নয়। কাঁঠালের আমস্বত্ব তো প্রবাদ-প্রবচন হিসেবে প্রচলিত, কাঁঠালের বার্গার কিন্তু মিথ্যে নয়। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া শেখ হাসিনা নিজে বানাতেন কিনা জানা নেই, তবে কাঁঠাল দিয়ে বার্গার বানাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন জাতিকে।
আমরা বরং গাধা আর হাতির আলাপটা শেষ করে নিই আগে। বাংলাদেশে অবশ্য ভোটে গাধা বা হাতির বাজার নেই। এখানে মানুষ গর্ব করে বলে—‘আমি সিংহের ভক্ত’, ভালোবাসে গাধাকে, আর পোষে কুকুর—শুধু টাকা থাকলেই।
জাতীয় ফল কাঁঠাল প্রতীক হিসেবে যতটা ঝামেলামুক্ত, দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা এখনও ততটা ঝামেলাহীন নয়। শাপলা ঝুলে আছে লটারির মতো।
এত আলোচনার কারণ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে শাপলা মার্কা চেয়ে। সঙ্গে চেয়েছে কলম অথবা মোবাইল। কিন্তু জনদৃষ্টি পড়েছে একমাত্র শাপলার ওপর। এনসিপিরও প্রতীক হিসেবে শাপলা সবচেয়ে পছন্দ।
আগেই বলেছি জাতীয় ফল কাঁঠাল বা জাতীয় পাখি দোয়েল মার্কা হিসেবে যতটা নির্ভেজাল শাপলা আর তেমনটি নয় এখন। প্রতীক নিয়ে এমন বিতর্ক এই উপমহাদেশে নতুন নয়।
পাকিস্তানে যতটা হয়েছে, ভারতে তেমনটা নয়। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে যে নির্বাচন হয়েছিল সে সময়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রতীক ছিল দাড়িপাল্লা, যা বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীরও মার্কা! সত্তরের নির্বাচনে বিচার বিভাগের প্রতীককে মার্কা হিসেবে দেওয়ার কারণে বিতর্ক ওঠেছিল। পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীকে পরে আর এই মার্কা ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি বলেই জানি। সেই ১৯৭০-এর নির্বাচনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির মার্কা ছিল তরবারি। ভুট্টো হত্যাকারী বলে অভিযুক্ত প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সময় সেটা কেড়ে নেওয়া হয়। এখন পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতীক হচ্ছে তীর। ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের প্রতীক ছিল ব্যাট। ইমরান খান সেদেশের বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেটার ছিলেন। সেটা বদলের চেষ্টা হয়েছিল। আদালত অনুমতি দেয়নি বলেই জানি। পাকিস্তান মুসলিম লীগের মার্কা ছিল বাঘ।
ভারতে মার্কা নিয়ে বিতর্ক নেই বললেই চলে। ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির প্রতীক হচ্ছে পদ্মফুল, জাতীয় কংগ্রেসের প্রতীক পাঞ্জা, তৃণমূল কংগ্রেসের জোড়াফুল, কমিউনিস্ট পার্টির কাস্তে আর কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদীর প্রতীক হচ্ছে কাস্তে ও হাতুড়ি। সারা পৃথিবীতে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর বেশিরভাগের প্রতীক কাস্তে ও হাতুড়ি। এনসিপি শাপলা প্রতীক চাইবার পর বেসরকরি এক টেলিভিশনের টকশোতে বিএনপির এক নেতা বলছিলেন, “এনসিপির শাপলা চাওয়াটা ভারতের বিজেপির অনুকরণ। বিজেপির মার্কা পদ্মফুল, তাই এনসিপি চায় শাপলা!”
অবশ্য মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য তাদের দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা চেয়ে বিমুখ হয়েছে। তাদের দল প্রতীক হিসেবে শাপলা পায়নি। এখন যদি এনসিপিকে এই প্রতীক দেওয়া হয় তবে মাহমুদুর রহমান মান্নার দলসহ অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন। প্রশ্ন তোলাটাই নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্যতম নিয়ামক। সুতরাং প্রশ্ন শুনি।
এক লোক নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। তার মার্কা বন্দুক। এক সাংবাদিক ওই প্রার্থীকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার মার্কা তো ‘বন্দুক’—এটা একনলা না দোনলা?” প্রার্থী থতমত খেয়ে জানালেন, ভেবে দেখেননি তিনি। সাংবাদিক তাকে সহজ করে দেওয়ার জন্য বললেন, “যদি বন্দুক একনলা হয় তাহলে প্রশ্ন একটা–শাপলা তো জাতীয় প্রতীক। এটা কেন রাজনৈতিক দলের মার্কা হবে? সমান্তরাল প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় ফল কাঁঠাল বা জাতীয় পাখি দোয়েল বা জাতীয় পশু বাঘ যদি মার্কা হতে পারে, তবে শাপলা মার্কা হলে অসুবিধে কোথায়? “
বন্দুক মার্কা মজা পেয়ে গেলেন–“বন্দুকটা যদি দোনলা হয়?”
“তাহলে প্রশ্ন দুটো। প্রথমটি নাগরিক ঐক্য যখন শাপলা চেয়েছিল, দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। এখন এনসিপি চাওয়াতে আলোচনা হচ্ছে। কার আবদার রাখা হবে? প্রবীণ না নবাগতদের?”
প্রশ্নটা সহজ হলে উত্তর দেওয়া কঠিন।তাই বন্দুকওয়ালা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য দ্বিতীয় প্রশ্নটাও করে ফেলতে বললেন।
সাংবাদিক বললেন, “এই প্রশ্নটি আপনার জন্যও প্রযোজ্য। ধরুন নির্বাচন কমিশন থেকে শর্ত দেওয়া হলো যে মার্কা ভোটে জামানত হারাবে তাকে তারই মার্কা দিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে। আপনি কি বন্দুক মার্কাটা বদলাবেন?”
বন্দুক মার্কা এবার স্তম্ভিত। কারো মার্কা লিচু, কারো আম, কারো ডাব, কারো আবার কাঁঠাল। সেই সব তো আর পাওয়া যাবে না। পেলে ভালো হতো, শাস্তিস্বরূপ খেয়ে ফেলতে পারতেন। শাপলা মার্কাটা তো কাউকে দেওয়া হয়নি; ভাবলেন দাবি করে রাখবেন কিনা? পেয়ে গেলে বন্দুকের চেয়ে শাপলা হাজার গুণ ভালো। চিংড়ি দিয়ে শাপলার তরকারি রান্না করা যায়। শুটকি হলেও মন্দ নয়। আবার শাপলা ফুলের মালা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোও যায়। নিদেনপক্ষে বান্ধবীর খোঁপায় গুঁজে দেওয়া যাবে।
শাপলা কোনো রাজনৈতিক দলের মার্কা হতে পারে?
বিধিমালায় যুক্ত হচ্ছে দাঁড়িপাল্লা, নৌকাও থাকছে, শাপলার কী হবে