Published : 25 Jul 2023, 01:24 AM
ঢাকার সাভারের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগে কাজ করছে ঠিকাদার পরিচয়ের আড়ালে একটি চক্র।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তিতাস গ্যাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তাও এর সঙ্গে জড়িত।
সম্প্রতি সাভারের হেমায়েতপুর, আশুলিয়ার বাংলাবাজারের ইটাখোলা, নিউ মার্কেট, গোরাট ধনাইদ এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিনের বেলায় তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও রাতের বেলায় টাকার বিনিময়ে আবার গ্যাস চলে আসে সেই চুলায়।
এরপর তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ আবার অভিযান চালিয়ে গ্যাসের রাইজার খুলে নিয়ে গেলে সেই চক্র সেখানে নিম্নমানের রাইজার লাগিয়ে মালিকদের কাছ থেকে টাকা ওঠায়। এ ধরনের অভিযোগে ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্তও করেছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ।
অনেকে আবার আবাসিক হিসেবে গ্যাসের সংযোগ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে গ্যাসের ব্যবহার করছেন এমন অভিযোগও উঠে এসেছে। কোনো কোনো ভবনে হয়ত আটটি আবাসিক চুলার অনুমোদন রয়েছে; কিন্তু সেখানে ২৩টি চুলাও জ্বলতে দেখা গেছে।
তবে সাভারে বৈধ গ্রাহক কত আর অবৈধ সংযোগ কী পরিমাণ রয়েছে- এ ব্যাপারে তথ্য চেয়েও পাওয়া যায়নি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সাভার কার্যালয়ের কাছ থেকে।
অবৈধ সংযোগের ব্যাপারে অনেকে জানলেও ওই চক্রের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না বলেও জানালেন।
এসব বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড সাভার জোনাল অফিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী অজিত চন্দ্র দেব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত ২৫ জুন আশুলিয়ার গোরাট ও ধনাইদ এলাকার প্রায় ৪০০ অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
দুষ্কৃতকারীরা রাতের আঁধারে অবৈধ সংযোগগুলো দিচ্ছে জানিয়ে এই প্রকৌশলী আরও বলেন, “আমরা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে দেখি, উচ্চচাপ বিশিষ্ট গ্যাস সংযোগ থেকে অতন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে অসংখ্য বাসা–বাড়িতে অবৈধ সংযোগ নেওয়া হয়েছে। দুই ইঞ্চি, এক ইঞ্চি পাইপ দিয়ে এ সংযোগগুলো নেওয়া হয়েছিল যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ; এবং যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপদ ঘটতে পারে।”
তবে উপজেলায় কত অবৈধ সংযোগ আছে তা জানেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “অবৈধ সংযোগের খবর পেলেই তা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।”
অনুমোদন আটটির, চলছে ২৩টি
আশুলিয়া বাজার এলাকার নিউ মার্কেট সংলগ্ন হাবিব ভিলার ছয়তলা ভবনে তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগ রয়েছে। এটা জেনে কয়েকদিন আগে সাভার তিতাস গ্যাস কার্যালয়ের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে সেই বাড়িতে অভিযানে যায়।
অনুমোদন ব্যতিত অতিরিক্ত চুলা ব্যবহার করার কারণে বাড়ির মালিক হাজী নুরুল ইসলামকে ৪৭ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তিনি সেই টাকা পরিশোধ করেন। পরে তিতাস গ্যাস কার্যালয়ে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তাদের কেউ সেদিন অভিযানে যায়নি।
হাজী নূরুল ইসলামের দাবি, সাভার তিতাস গ্যাস ঠিকাদার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাউসার আলীর নেতৃত্বে সেদিন এই অভিযান চালানো হয়। তারা নিজেদের গ্যাস অফিসের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্নের ভয় দেখিয়ে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। পরবর্তীতে দেনদরবার করে ৪৭ হাজার টাকায় রফা হয়।
ভবন মালিক স্বীকার করেন, তার ভবনে আটটি চুলার বৈধ অনুমোদন রয়েছে; তবে তিনি ২৩টি চুলা ব্যবহার করছেন।
সাভারের জয়নাবাড়ী এলাকার বাগবাড়ীর মোড়ে পাশাপাশি তিনটি পাঁচতলা ভবনের মালিক সাবেক এক জনপ্রতিনিধি। তার বাড়িতে গত দুই বছর ধরে চলছে অর্ধ শতাধিক অবৈধ চুলা। এই সংযোগ দেওয়ার পেছনে নাম বেরিয়ে এসেছে ঠিকাদার কাউসার আলীর।
একটি ভবনের বাসিন্দা জানান, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ একাধিকবার অভিযান চালিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। কিন্তু সকালে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও রাতের আঁধারে পুনরায় দেওয়া হয় সংযোগ।
প্রতি মাসে তিন ভবন থেকে বিল হিসাবে কাউসার অন্তত ৫০ হাজার টাকা করে নিচ্ছে বলে দাবি করেন ওই বাসিন্দা।
সাভারের গেণ্ডা আল-মুসলিমের পিছনে একটি পাঁচতলা বাড়িতে অবৈধভাবে ২০টি চুলা ব্যবহার করা হচ্ছিল। এ ব্যাপারে তিতাস গ্যাস কার্যালয়ে অভিযোগ করার পর দুইবার ওই বাড়িটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কয়েকদিন পরেই তারা পুনরায় আবার অবৈধ সংযোগ ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তবে ওই বাড়ির কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
আশুলিয়া ও সাভারের গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরকম আরও অনেক ভবন আছে। সবাই জানলেও এ নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি না।
তাদের ভাষ্য, এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ সংযোগ প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে ঘুরে ঘুরে বিল বই চেক করে থাকে। এ সময় অতিরিক্ত চুলা পেলেই প্রতি চুলার জন্য এক বছরের জরিমানা করে সংযোগ বিচ্ছিন্নের হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে থাকে।
আশুলিয়ার নিউমার্কেট এলাকার লোকজনের দাবি, গত এক বছরে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে যতগুলো রাইজার কেটে নিয়েছে তার বেশিরভাগই পুনরায় অবৈধভাবে সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
কাউসার আলী এক যুগ ধরে তিতাস গ্যাসের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছেন। আশুলিয়ার বাড়ইপাড়া, জিরানী, জয়নাবাড়ী, যাদুরচর ও ট্যানারি এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগের পিছনে তার ভূমিকা রয়েছে বলে স্থানীয়রা বলছেন।
তবে কোনো ধরনের সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন ঠিকাদার কাউসার আলী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি কোনো অবৈধ সংযোগ দিইনি। একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।”
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সাভার জোনাল অফিসের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আবু সাদাৎ মো. সায়েম বলেন, “ঠিকাদার কাউসারের বিরুদ্ধে এর আগেও এ ধরনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তার লাইসেন্সটি কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।”
এক ইঞ্চির পাইপে ২ কিলোমিটার দূরে অবৈধ সংযোগ
অবৈধ সংযোগের সঙ্গে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশের কথা অনেকে বললেও প্রতিষ্ঠানটি সাভার ও আশুলিয়া অঞ্চলে নিয়মিতই অভিযান পরিচালনা করে থাকে।
সংযোগ বিচ্ছিন্নের কাজে অংশ নেওয়া কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, সাভারের হেমায়েতপুর দিয়ে তিতাসের মূল লাইন গেছে। রাতের আঁধারে সেই মূল পাইপ থেকে প্রায় দুই কিলোমিটারের ভেতরে লাইন টেনে নিয়ে সাড়ে ৫০০ অবৈধ সংযোগ দিয়েছে একটি চক্র। খুবই নিম্নমানের পাইপে গলির ভেতর দিয়ে এই লাইন টানা হয়েছে। প্রতিটি চুলার জন্য এককালীন টাকা নেওয়া হয় আবার চুলাপ্রতি প্রতি মাসে ১ হাজার করে টাকাও নেওয়া হয়।
আশুলিয়ার বাংলাবাজারের ইটখোলা এলাকায় প্রায় এক হাজার বাসা-বাড়িতে এবং কাঠগড়া এলাকায় প্রায় ৬০০ বাসা বাড়িতে একই কায়দায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে বলে তিতাস গ্যাস কার্যালয়ের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মচারী বলেন, “সংযোগ বিচ্ছিন্নকালে দুই কিলোমিটার পাইপ তুলতে গিয়ে দেখতে পাই নিম্নমানের দুই ইঞ্চি অথবা এক ইঞ্চি পাইপ দিয়ে সংযোগ নিয়েছে। এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।”
রোববার হেমায়েতপুর ও বাংলাবাজারের ইটখোলা এলাকায় পুনরায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যেসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল, তার অধিকাংশই আবার চালু হয়েছে। ওইসব বাসাবাড়িতেই গ্যাসের চুলা জ্বলছে।
এই অবৈধ কাজের সঙ্গে ঠিকাদার গোলাম মোস্তফা জড়িত বলে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তিনি প্রায় এক যুগ ধরে সাভারে গ্যাস সংযোগের ঠিকাদারি করছেন।
এক দশকের বেশি সময় ধরেই দেশে নতুন আবাসিক সংযোগ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। নতুন ভবনের মালিকদের এখন সিলিন্ডারের এলপি গ্যাসই ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু এই সময়েও টাকার বিনিময়ে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ আছে গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে।
আশুলিয়ার যাদুরচর এলাকার একজন গ্রাহক বলেন, “তিন লাখ টাকা নিয়ে গোলাম মোস্তফা গ্যাস সংযোগ দিয়েছে। প্রতিমাসে চুলাপ্রতি ১ হাজার করে টাকা নিয়ে যায়।”
সাভার তিতাস গ্যাসের কয়েকজন ঠিকাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে ঠিকাদার গোলাম মোস্তফা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। সাভার ও পাবনা ঈশ্বরদীতে রয়েছে বিঘা বিঘা জমি, প্লট ও বাড়ি। তিনি একাধিক গাড়িতে চলেন।
তবে ঠিকাদার গোলাম মোস্তফা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আগে কিছু সংযোগ ছিল। এখন কোনো কাজকর্ম নেই। আমার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ তুলেছে, সব মিথ্যা। আমি এখন আর কোনো অবৈধ গ্যাস সংযোগের সঙ্গে জড়িত নই।”
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সাভার জোনাল অফিসের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আবু সাদাৎ মো. সায়েম বলেন, “আমাদের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। যেখানে অবৈধ সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে আমরা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে অভিযান চালাচ্ছি।
“এমনও এলাকা পেয়েছি, মোটা পাইপ দিয়ে মূল লাইন থেকে গ্যাস সংযোগ নিয়েছে। সেসব পাইপ আমরা খুলে নিয়ে আসি। যারা লাইন নিয়েছে তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হচ্ছে। আবার অনেক সময় আমরা মামলাও করে থাকি।”
তিনি আরও বলেন, “অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে অনেকসময় আমাদের ঠিকাদার ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের নামও উঠে আসে। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করে থাকি।”
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহ্ বলেন, “অবৈধভাবে সংযোগ গ্রহণকারীদের সংযোগ বিচ্ছিন্নসহ প্রাথমিকভাবে সতর্ক করা হচ্ছে। এ ছাড়া যদি কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”