Published : 21 Feb 2024, 12:45 AM
গারো পাহাড়ের লাগোয়া নেত্রকোণার দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী তীরের গ্রাম খুজিগড়া। এক দুপুরে গ্রামের টিলার পাশে সবুজেঘেরা উঠানে বসে মাতৃভাষায় কথা বলছিলেন হাজং নারী-পুরুষ আর শিশুরা। প্রতিটা শব্দ কীভাবে উচ্চারণ করতে হবে, কোন শব্দটার কী মানে, সেটা সামনে দাঁড়িয়ে শিক্ষকের মত সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন ২৫ বছরের যুবক অন্তর হাজং।
দূর থেকে দেখলে মনে হবে, বাড়ির উঠানে বোধহয় পাঠশালা বসেছে। পাঠশালাই বটে; তবে হাজং ভাষাশিক্ষার পাঠশালা। শুধু কথা বলাই নয়, বয়স্কদের কেউ কেউ হাজং ভাষায় গানও গাইছেন।
অন্তর হাজং বলছিলেন, “এভাবে দুটো কাজ হয়। এক, আমি তাদের হাজং ভাষায় কথা বলতে উৎসাহিত করি। যে শব্দগুলো নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা জানে না; তাদের সেই শব্দটা শিখিয়ে দিই।
“আর আমি নিজেও তো অনেক শব্দ জানি না। বয়স্করা যখন হাজং ভাষায় কথা বলেন, গান করেন তখন সেখান থেকে যে শব্দটা জানি না, সেটা লিখে রাখি, শিখে নিই।”
অন্তর নিজের মাতৃভাষাকে নৃগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এভাবেই প্রতিটি হাজং গ্রাম, প্রতিটি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ‘পাঠশালা’ বসাচ্ছেন। আর পরিচিত-অপরিচিত শব্দ জমা করে গড়ে তুলছেন শব্দভাণ্ডার।
অন্তর বলছিলেন, “ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতির প্রাণ, সেটা হারিয়ে গেলে একটা জাতিসত্তার প্রাণভ্রমরা হারিয়ে যায়। সে কারণেই হাজং জনগোষ্ঠী, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য ছুটছি নেত্রকোণা, শেরপুর ও সুনামগঞ্জের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।”
দেশের উত্তর-পূর্বের গারো পাহাড়ের পাদদেশে নেত্রকোণা ও শেরপুর জেলায় যে নৃগোষ্ঠীর বাস সবচেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে গারো ও হাজং অন্যতম। পরিবারে বা নিজেদের লোকসমাজে গারোরা আচিক ভাষায় আর হাজংরা হাজং ভাষায় কথা বলেন।
‘দেশভাগের’ আগ পর্যন্ত এ দুই জেলায় হাজংদেরই প্রাধান্য ছিল। কিন্তু কালে কালে ‘বিদ্রোহী-সংগ্রামী’ এ নৃগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকেছে। এ দুই জেলার বাইরে সুনামগঞ্জেও কিছু হাজং জনবসতি রয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পল্টন হাজং বলছিলেন, “ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, হাতিখেদা আন্দোলন, টংক আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন প্রতিটি সংগ্রামে অংশ নিয়েই নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন হাজংরা। টিকতে না পেরে অনেক হাজং দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।
“দেশভাগের পর ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এখানে লক্ষাধিক হাজং ছিল; এখন সেটা কমতে কমতে ২০ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে।”
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বাংলা ছাড়াও ৪০টি নৃগোষ্ঠীর ভাষা আছে। এর মধ্যে ১৪টি ভাষাকে বিপন্নপ্রায় বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এ তালিকায় হাজংদের ভাষা নেই।
নৃগোষ্ঠীর ৪০টি ভাষার মধ্যে মাত্র আটটির নিজস্ব বর্ণমালা আছে; বাকিদের কোনো বর্ণমালা নেই। হাজং ভাষারও নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই।
যে আটটি ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে, তার মধ্যে পাঁচটি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই রচনা করে বিতরণ করছে সরকার। এই ভাষাগুলো হচ্ছে- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদ্রি।
সাঁওতালি ভাষারও বর্ণমালা আছে; কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে সেই ভাষার প্রাক-প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা যায়নি।
অন্তর হাজংয়ের দাবি, যেহেতু হাজং ভাষার কোনো বর্ণমালা নেই। তাই বাংলা বর্ণমালায় হাজং ভাষার শব্দাবলিকে লিপিবদ্ধ করে প্রাক-প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তক তৈরি করে শিক্ষার্থীদের দেওয়া হোক। এতে এই ভাষাকে বাঁচানো সহজ হবে।
দুর্গাপুরের কুল্লাগড়া ইউনিয়নের খুজিগড়া গ্রামের দিনমজুর রহিন্দ্র হাজং ও হিন্দুবালা হাজংয়ের ছেলে অন্তর হাজং। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তরে পড়ছেন।
এলাকার আরেক নৃগোষ্ঠী গারোরা নিজেদের ভাষায় লেখাপড়া করছে, তারা তাদের মাতৃভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হাজং জনজাতির সবাই বাংলা ভাষায় নির্ভরশীল হতে হতে মায়ের মুখের ভাষাকেই ভুলতে বসেছে।
পাঁচ বছর আগে বিষয়টি অন্তর হাজংকে খুব আলোড়িত করে। তারপর তিনি প্রতিজ্ঞা করে হাজং ভাষা রক্ষা, চর্চা ও প্রসারে কাজে নেমে পড়েন।
প্রথমে দুর্গাপুরের বগাউড়া, গোপালপুর, ছনগড়া, আড়াপাড়া, বিজয়পুর, লক্ষ্মীপুর, ভবানীপুরসহ সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলোতে হাজং ভাষার চর্চা শুরু করেন। কখনও বাড়ির উঠানে, কখনও গাছের নিচে, যখন যেখানে সুবিধা পেয়েছেন সেখানেই গ্রামের মানুষকে নিয়ে পাঠশালা বসিয়েছেন অন্তর হাজং।
এভাবে তিনি নেত্রকোণা, শেরপুর ও সুনামগঞ্জের ১০১টি গ্রামের ২০ হাজার হাজং মানুষের কাছে পৌঁছেছেন।
গত শনিবার দুর্গম খুঁজিগড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, হাজং জনজাতির ছেলে, মেয়ে, গৃহিনী থেকে সব বয়সী ২০-২২ জন বাড়ির উঠানে বসে ভাষা চর্চা করছেন। কখনও গল্পচ্ছলে, কখনও গীত-গানে আবার কেউ কেউ হাজং ভাষায় কবিতাও পড়ছেন। বাকিরা শুনছেন। শেষে হাজং ভাষার শব্দগুলো নিয়ে আলোচনা করেন অন্তর হাজং। এভাবেই নিজের ভাষা রপ্ত করছেন সবাই।
সেখানেই কথা হয় গৃহিনী নিত্যমনি হাজংয়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, “আমরার মায়েরা নিজেরা নিজেরা হাজং ভাষাতেই কথা কইত। দাদীরার কাছেও হুনছি। আমরাও কিচু কিচু কইতাম। কিন্তু এখন তো বাংলায় কথা কই।
“আমারার সন্তানেরাও বাংলাতেই সব সময় কথা কয়। নিজেরাও বাড়িতে হাজং কয় না; জানেও না বেশি। বেশিরভাগ তো হাজং ভাষার কিচুই জানে না। আসলে কইবোই কেমনে আমরা ভাষাটা তো মুখে মুখে চলে আসতাছে।”
৫ বছর ধরে এভাবে ভাষার চর্চা করছেন জানিয়ে নিত্যমনি হাজং বলছিলেন, “আমরাও শিখতাছি। গ্রামের বাচ্চারাও শিখতাছে। এভাবেই যতটুকু টিকাইয়া রাহন যায়। সরকার যদি উদ্যোগ নিয়া আমরার ভাষাডারে টিহাইতো। বর্ণ তৈরির উদ্যোগ নিলে ভবিষ্যতে ভাষাটা সহজে আর হারাইতো না।”
একই গ্রামের দিনমজুর রত্না হাজং বলেন, “আমরা তো মনের কথা কইতে গেলে নিজের হাজং ভাষাতেই বুঝায়া কওন যায়। অন্য ভাষাতে ততটা দরদ দিয়া বুঝানি যায় না। অন্তর ভালা কাজ করতাছে। আমরা শিখতাছি। শিশুরাও শিখতাছে।”
বেসরকারি চাকরিজীবী বেনতা হাজং ভাষা চর্চায় যোগ দিয়েছিলেন কলেজ শিক্ষার্থী মেয়ে পুষ্পাঞ্জলি হাজংকে নিয়ে।
বেনতা হাজং বলেন, “মা ও মেয়ে একসঙ্গে শিখছি। অন্তর এলাকার মুরুব্বিদের কাছ থেকে হাজং ভাষার বিভিন্ন শব্দ সংগ্রহ করেছে। সে আমাদের এই শব্দগুলো গল্প কইতে কইতে শিখাইতাছে। সবাই শিখতাছি। তবে এইভাবে কতদিন চলবে। আমরার ভাষার বর্ণ দরকার। নাইলে টিকানি যাইব না। সরকারকে আগায়া আইতে অইব।”
কলেজ শিক্ষার্থী সুস্মিতা হাজং বলেন, “অনেক পাখি, নানান খাবার, খেলা, পশুসহ আমাদের জীবন চলার সংস্কৃতিগত ভাষার অনেক শব্দ শিখতাছি। অন্তর হাজং আমাদের গ্রামে সপ্তাহে দুদিন চর্চা করান। ভালোই লাগে। সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে শিখি। নিজের মায়ের ভাষাতে কথা বলার আনন্দই আলাদা।”
ভবানীপুরের অনিতা হাজং বলেন, “নৃগোষ্ঠীর অন্য জনজাতির মানুষের ভাষা সংরক্ষণে সরকার যেমন উদ্যোগ নিয়ে পাঠ্যপুস্তক করে প্রাক-প্রাথমিকে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছে, তেমনি আমাদের ভাষার জন্যও উদ্যোগ নিতে হবে।”
অন্তর হাজংয়ের নিজের কোনো চাকরি নেই। আয়-উপার্জন বলতে তিনি কয়েকটি ছেলেমেয়েকে প্রাইভেট পড়ান। সেখানকার আয় দিয়েই তিনি নিজের খরচ বহন করেন।
অন্তর হাজং বলেন, “মানুষের কাছে বারবার যাওয়া প্রয়োজন। তাদের নিয়ে বারবার বসা প্রয়োজন। কিন্তু টাকার অভাবে সবসময় পারি না। তারপরেও চেষ্টা করছি। গবেষণার মাধ্যমে বর্ণ তৈরি করে হাজং ভাষা রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন।”
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, “অন্তর হাজং যে তাদের ভাষাটা ধরে রাখতে কাজ করছে এটা প্রশংসনীয়। আশা করছি, তার মাধ্যমে হাজং ভাষাটা একটা পর্যায়ে আসবে এবং সরকারও উদ্যোগ নেবে।
“কয়েকটি ভাষার স্বরলিপির আলোকে বইও তৈরি করা হয়েছে। তা পাঠ্যবই হিসেবে নৃগোষ্ঠীর এলাকায় পাঠদানে ব্যবহৃত হচ্ছে। নৃগোষ্ঠী এলাকায় তাদেরই জনজাতির শিক্ষক থাকে। তাদের মাধ্যমেই আপাতত পাঠদান কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। আগামীতে আরও বড় আকারে বেশি ভাষা নিয়ে কাজ হবে।”