Published : 26 May 2025, 10:02 PM
যশোরের অভয়নগর উপজেলার বিএনপি নেতাকে খুনের পর এলাকার ১৩টি হিন্দু পরিবারের অন্তত ২০টি ঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পাঁচ দিন পরও ডহর মশিহাটী গ্রামের বাড়েদা পাড়ার মানুষদের মধ্যে ভয় আর আতঙ্কে বিরাজ করছে।
সোমবার দুপুরে গ্রামটিতে গিয়ে এমন অবস্থা দেখা গেছে। গ্রামে পুরুষ লোকজনের সংখ্যাও তুলনামূলক কম। নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকেই একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কারও কারও পরনের কাপড়টুকু ছাড়া আর কিছু নেই।
অভয়নগর থানার ওসি আব্দুল আলীম বলেন, “বাড়েদা পাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তরিকুল হত্যাকাণ্ড ও তার পরিপ্রেক্ষিতে যে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে দুটি ঘটনায় মামলার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।”
ঘটনার বিষয়ে এলাকাবাসী বলছেন, বৃহস্পতিবার রাতে ওই গ্রামে মিন্টু বিশ্বাসের বাড়িতে মাছের ঘের ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম (৫০) গুলিতে খুন হন।
তরিকুল একই ইউনিয়নের ধোপাদী গ্রামের বাসিন্দা এবং উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর বিএনপির সভাপতি ছিলেন।
তার পরিবারের দাবি, সেদিন মাছের ঘের ইজারা দেওয়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
তারপরই তার শতাধিক অনুসারী হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামটিতে এসে তাণ্ডব চালায়। গ্রামটিতে মূলত মতুয়া সম্প্রদায়ের বাস। সেদিন মতুয়া সম্প্রদায়ের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। এজন্য পাঁচ শতাধিক লোকের খাবার-দাবারের আয়োজনও করা হয়েছিল।
হত্যার পেছনে কারণ
স্থানীয়রা বলেন, বাড়েদা পাড়া ভবদহ বিলের মধ্যে। সেখানে একটি মাছের ঘের রয়েছে। মূলত ৫ অগাস্টের পর এই মাছের ঘেরকে কেন্দ্র করেই তরিকুলের প্রতিপক্ষ তৈরি হয়।
তার ভাই উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর বিএনপির সহসভাপতি এবং সাবেক পৌর কাউন্সিলর জাকির হোসেনের দাবি, “ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঘের লিজ দেওয়ার নামে ডেকে নিয়ে তাকে খুন করা হয়েছে।”
তরিকুল খুন হয়েছেন মিন্টু বিশ্বাসের বাড়িতে। তিনি একজন ঘের ব্যবসায়ী। ঘটনার পর থেকে তিনি ও তার পরিবার পলাতক রয়েছেন।
ওই দিন যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নুর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের ডহর মশিয়াহাটী গ্রামে তরিকুল ইসলামের ঘের রয়েছে। সন্ধ্যায় তিনি ঘের নিয়ে কথা বলতে ডহর মশিহাটী গ্রামে মিন্টু বিশ্বাসের বাড়ি যান। সেখানে যাওয়ার পর হত্যার শিকার হন তিনি। তাকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
ঘটনার পর পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও কোনো মামলা হয়নি বলে পুলিশ জানিয়েছে।
‘আমরা ভিখারি হয়ে গেছি’
গ্রামের কয়েকজন ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলছিলেন, বৃহস্পতিবার বিকালে বাড়েদা পাড়ার মহিতোষ বিশ্বাসের বাড়িতে চলছিল মতুয়া সম্প্রদায়ের নামযজ্ঞের তোড়জোড়। আশপাশের গ্রাম থেকে সম্প্রদায়ের মানুষরা আসছিলেন এতে অংশ নিতে। গ্রামে উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল। কেউ কেউ অনুষ্ঠানের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কেউ ছিলেন রান্নাবান্নার কাজে।
তার মধ্যেই এই খুনের ঘটনা ঘটলেও প্রথমে কেউ কিছু বুঝতে পারেনি, বলেন গৃহবধূ পবিত্রা বিশ্বাস।
তিনি বলেন, “হঠাৎ একদল মানুষ বাড়ির মধ্যে ঢুকে শুরু করে তাণ্ডব। খাবারের ডেকচি উল্টে দিয়ে, মারপিট করতে শুরু করে। তারপর আগুন দেওয়া শুরু করে।
“তখন সবাই পালাতে শুরু করেন। এ সময় জানা যায়, মহিতোষ বিশ্বাসের বাড়ির পিছনে মিন্টু বিশ্বাসের বাড়িতে তরিকুল খুন হয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে এই তাণ্ডব চলেছে।”
একই গ্রামের গৃহবধূ পিয়া বিশ্বাস বলছিলেন, “কিচ্ছু নেই। স্বামীর আয়ের মাধ্যম ভ্যানগাড়ি, গরুর খাবার, মানুষের খাবার, পরনের পোশাক সব পুড়েছে। জমির দলিল, পাসপোর্টসহ সন্তানের পড়ালেখার বই পুড়ে গেছে। বাক্সে টাকা ছিল, তিন ভরি সোনার গহনা ছিল, পাচ্ছি না। বাক্স পুড়ে ছাই হয়েছে।”
ঘটনার সময় গোয়াল ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন পিয়া বিশ্বাসের শাশুড়ি চন্দ্রিকা বিশ্বাস। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “আমরা ভিখারি হয়ে গেছি।”
মনিতোষ বিশ্বাস বলেন, “আমাদের গ্রাম ভবদহ জলাবদ্ধ কবলিত। জলাবদ্ধতার কারণে এ বছর বোরো আবাদ করা যায়নি। গত বছরের ধান ছিল ঘরে, আগুনে সব পুড়ে গেছে। তার তিনটি শ্যালো মেশিন পুড়ে খাক হয়ে আছে।”
বনানী বিশ্বাসের পুড়েছে ঘরে থাকা গত বছরের সেদ্ধ করা ৪০ মণ ধান। তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, “এ বছর তো ধান হয়নি। এখন আর ঘরে ধান নেই, চাল নেই।”
নারী উদ্যোক্তা পান্না বিশ্বাস বলেন, “একটু একটু করে সংসারটা গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু সব ধ্বংস গয়ে গেল। বাবার বাড়িতে অভাবে গান শিখতে পারিনি। সন্তান গান শেখবে এই আশায় হারমোনিয়াম, তবলা কিনে দিয়েছিলাম। এখন কিছুই নেই।”
পান্না আরও জানান, দুই বেসরকারি সংস্থা থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন গোয়াল ঘর তৈরির জন্য। টাকা রাখা ছিল আলমারির মধ্যে। সেটিই পুড়ে গেছে। আট ভরি সোনার গহনা ছিল ছাই হাতড়েও পাইনি। দুটি মোটরসাইকেলও পুড়েছে।
হত্যা ও অগ্নিকাণ্ডের বিচার দাবি
সোমবার বাড়েদা পাড়া পরিদর্শন করেন জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের যুগ্ম সম্পাদক টি এস আইয়ুব। এ সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীর সঙ্গেও কথা বলেন।
পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এটি খুবই অমানবিক ঘটনা। বাড়িঘরে আগুন দিয়ে মানুষকে নিঃস্ব করা মেনে নেওয়া যায় না।
“আমাদের নেতাকে হত্যা করা যেমন নিন্দনীয়; তেমনি আগুন ধরানোর ঘটনাটিও নিন্দনীয়।”
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সহসভাপতি জে এল ভৌমিকও সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
এ সময় তিনি বলেন, “এ ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। মানুষগুলো একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। ওই হত্যাকাণ্ডের যেমন বিচার দাবি করি, তেমনি এতগুলো বাড়িতে আগুন ধরানো ঘটনার বিচারও দাবি করি। সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান জে এল ভৌমিক।
নিহত তরিকুল ইসলামের ভাই জাকির হোসেন বলেন, “মৃত ভাইকে নিয়ে যখন সবাই ব্যস্ত তখন কোনো একটি চক্র ওই গ্রামে কয়েক বাড়িতে আগুন ধরিয়েছে।
“আমার ধারণা, এ হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য আগুনের ঘটনা ঘটিয়েছে কোনো পক্ষ।”
আরও পড়ুন: