Published : 15 Dec 2023, 10:30 AM
অনুকূল আবহাওয়ায় ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালীতে এ বছর উৎপাদন ভালো হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে কেনাবেচাও ভালো। তবে চলমান ‘রাজনৈতিক অস্থিরতায়’ দ্বিগুণ হয়েছে পরিবহন ব্যয়। সামনের দিনে এই অস্থিরতা বাড়লে আশানুরূপ লাভ না পাওয়ার শঙ্কায় আছেন তারা।
সারাবছর কমবেশি বিক্রি হলেও মূলত ডিসেম্বর থেকে মার্চ এই চার মাসকে ফুল বিক্রির মূল মৌসুম মনে করেন চাষিরা। এই সময়ে ৭-৮টি উৎসবে সারা বছরের ৭৫ শতাংশ ফুল বিক্রি হয়।
গত মৌসুমে ফুল বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৫০০ কোটি টাকার। এবার ৬০০ কোটি টাকা বিক্রির প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা । তার মধ্যে জাতীয় নির্বাচন ও তার পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভাবনা তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
গদখালি ফুলচাষি কল্যাণ সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক রনি আহম্মদ বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়, করোনাভাইরাস মহামারী কয়েক বছর ধরে চাষিদের স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছিল। এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা তাদেরকে আবারও ভাবিয়ে তুলেছে।
ফুলচাষি সাইফুল ইসলাম বলেন, “এ বছর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ফুল চাষিদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এখন ফুলের ভালো দাম পেলেও ভবিষ্যতের জন্য শঙ্কায় ভুগছি।”
এ বছর এক বিঘা জমিতে জারবেরা ও রজনীগন্ধার চাষ করা এই চাষি আরও বলেন, “দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকলে অনুষ্ঠান বা জাতীয় দিবসগুলো জাঁকজমকপূর্ণভাবে হয় না। তাই আমাদের ফুলের চাহিদা ও বিক্রি কমে যায়।
“তারপরও বাজার ধরার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করি দিবসগুলোতে ফুলের দাম আরও বাড়বে।”
যশোর ফুল উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মীর ফারুক আহমেদ বলেন, হরতাল অবরোধের কারণে ফুল সরবরাহ ও পরিবহনে খরচ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তারপরেও রাজনীতিতে এখন যে অবস্থা চলছে তাতে ফুল সেক্টরে খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। তবে অস্থিরতা বাড়লে ক্ষতির মুখে পড়বে ফুল চাষিরা।
যশোর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশে গদখালীর ছোট্ট এ বাজারটি প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই চাষি, পাইকার ও মজুরের হাঁকডাকে মুখর হয়ে উঠে।
বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকাররা সকাল সকালই তাজা ফুল কিনে নিয়ে ফিরতে শুরু করেন।
এই বাজারে গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদা, জারবেরা, গ্ল্যাডিওলাস ছাড়াও জিপসি, ক্যালেন্ডুলা, ডালিয়া, লিলিয়াম, চন্দ্র মল্লিকাসহ নানা জাতের ফুল বিক্রি হয়।
যশোর ফুল উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, দেশে বিভিন্ন উৎসবে যে পরিমাণ ফুল বেচাকেনা হয়, তার ৭৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় যশোরে। এবার চাহিদা বেশি, চাষিরাও আগাম প্রস্তুতি রেখেছেন।
মেসৈুমের শুরুতে এই বাজারে এখন প্রতিদিন গড়ে অর্ধকোটি টাকার উপর ফুল বিকিকিনি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এবার দাম ও বেচাকেনা দুটোই ভালো হওয়ায় আমরা খুশি। ফুলের উৎপাদন, চাহিদা ও দাম- সবই বেশ ভালো। এ অঞ্চলের ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা সবাই খুশি।”
রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব ফুল সেক্টরে এখনও তেমনটা পড়েনি দাবি করে তিনি বলেন, “অস্থিতিশীলতার কারণে ফুল বাইরের জেলাগুলোতে বিপণনে আমাদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর মধ্যেও বিজয় দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিন কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। গত বছর বিক্রি হয়েছিল দুই কোটি টাকা।
“বুধবার শুধুমাত্র গোলাপ বিক্রি হয়েছে ২৫ লাখ টাকার। তাই দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে চলতি বছর মৌসুমের চার মাসে গদখালি থেকে ৬০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আমরা আশাবাদী। ”
ফুল চাষ ও বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, ২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাস ডে, পহেলা জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষ, ১৩ ফেব্রুয়ারি বসন্তবরণ উৎসব, পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অনুষ্ঠানকে টার্গেট করে ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
ফুলচাষি মিজানুর রহমান বলেন, হরতাল অবরোধে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফুল সরবরাহ ও পরিবহনে দ্বিগুণ অর্থ গুনতে হচ্ছে তাদের।
গদখালির ‘ফুল চাষের জনক’ নামে পরিচিতি এলাকার প্রথম ফুল চাষি শের আলি সরদার বলেন, “আগে দেশের বিভিন্ন জেলায় পরিবহন ও বাসের ছাদে করে ফুল পাঠাতাম। এখন সেটার পরিবর্তন হয়েছে, ট্রাক ও পিক-আপ ভরে ফুল যাচ্ছে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফুল উৎপাদন ভালো হয়েছে। দামও রয়েছে বেশ। চাঙ্গা হয়ে উঠছে ফুলের কেনাবেচা। এবার চাহিদা বেশি, চাষিরাও আগাম প্রস্তুতি রেখেছেন। তবে হরতাল-অবরোধে যানবাহন চলাচল না করলে ফুল পাঠানো যাবে না, এতে এ সেক্টর বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।”
তবে বাজারে ফুলের সংকট না থাকলেও দাম বেশ চড়া বলে অভিযোগ করছেন ক্রেতারা।
ফুল ব্যবসায়ী শাহাদৎ হোসেন বলেন, “ফুলের বাজার খুব চড়া। তারপরও ৬০ হাজার টাকা ফুল কিনেছি, আরও কিনব।”
আরেক ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন বলেন, অন্য সময় এক হাজার গাঁদা ফুল ৩০০/৩৫০ টাকায় কেনা গেলেও এখন লাগছে ৫৫০ টাকা।
বৃহস্পতিবার গদখালি ফুলের বাজারদর প্রসঙ্গে ‘ফুলের বাজার ডটকম’ নামক অনলাইনের তরুণ ফুল উদ্যোক্তা মো. আল আমিন বলেন, গদখালী ফুল বাজারে গোলাপ ফুল প্রতি পিস ১০ টাকা, চায়না গোলাপ লংস্টিক রোজ ১৫ টাকা, রজনীগন্ধা স্টিক ৮-১০ টাকা, গ্লাডিওলাস ফুল কালার ভেদে ২৫-৩০ টাকা, জারবেরা ফুল ১৫-২০ টাকা, চন্দ্রমল্লিকা ৫-৬ টাকা, গাঁদা ফুল প্রতিহাজার ৮০০-১২০০ টাকা, জিপসি ফুল প্রতি আঁটি ৩০ টাকা ও কামিনী পাতা প্রতি আঁটি ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ বলেন, “উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের প্রায় ৬৩০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে। এখানকার প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কৃষক এবং প্রায় এক লাখ শ্রমিক এই চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন।”
তিনি জানান, এ বছর ২৭২ হেক্টর জমিতে গ্লাডিওলাস, ১৬৫ হেক্টর জমিতে রজনীগন্ধা, ১০৫ হেক্টর জমিতে গোলাপ, ৫৫ হেক্টর জমিতে গাঁদা, ২২ হেক্টর জমিতে জারবেরা এবং প্রায় ৬ হেক্টর জমিতে অন্যান্য ফুলের চাষ করেছেন চাষিরা।