Published : 29 May 2025, 05:07 PM
পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন স্টেডিয়াম এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল সুইমিংপুলের নাম পরিবর্তন করার পর প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে এক সপ্তাহের মাথায় পুনর্বহাল করা হয়েছে।
তবে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের সুচিত্রা সেনের নামে করা ছাত্রীনিবাসের নাম পরিবর্তন করা হলেও সেটি এখনও বহাল আছে।
সম্প্রতি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নির্মিত পাবনা শহীদ আমিনউদ্দিন স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে ‘পাবনা জেলা স্টেডিয়াম’ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল সুইমিংপুলের নাম পরিবর্তন করে ‘পাবনা জেলা সুইমিংপুল’ করা হয়।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেয়ে ২২ মে জেলা প্রশাসন দুটি স্থাপনার নাম পরিবর্তন করে নতুন সাইন বোর্ড টাঙ্গিয়ে দেয়।
দুটি স্থাপনা থেকে দুজন মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে জেলার মানুষের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেকে এ নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য রাখেন।
এর মধ্যেই বুধবার যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে দুটি স্থাপনাই আগের নামে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
বুধবার নাম পরিবর্তনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও স্থানীয়ভাবে বিষয়টি বৃহস্পতিবার বিকালে সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গোচরে আসে।
কিন্তু তার আগে বৃহস্পতিবার সকালে পাবনায় জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল সুইমিংপুলের নাম পরিবর্তন করার প্রতিবাদে মানববন্ধন হয়। দুপুরে পাবনা সচেতন নাগরিকবৃন্দ আয়োজনে পাবনা প্রেসক্লাবের সামনে ঘণ্টাব্যাপী এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তসলিম হাসান সুইটের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য দেন পাবনা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আনিসুল হক বাবু, জেলা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল গফুর, জেলা কৃষকদলের সিনিয়র সহসভাপতি হাবিবুর রহমান বাচ্চু, জেলা বিএনপির সদস্য মমতাজ উদ্দিন খান মমতাজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুলের বড় ছেলে নূর ইসলাম, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আহসান হাবিব আকাশ, পাবনা রাইফেল ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. খোকন ইসলাম, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা, পাবনা সদর উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাশেদ রানা, পাবনা সদর পৌর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজওয়ান হোসেন হৃদয়।
স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, অ্যাডভোকেট আমিনউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে দেশের প্রথম শহীদ সংসদ সদস্য। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।
বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল ছিলেন পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনিই প্রথম পাবনায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
স্টেডিয়াম ও সুইমিংপুলের নাম পরিবর্তনের দুদিন আগে ২০ মে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ‘সুচিত্রা সেন ছাত্রীনিবাস’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘জুলাই-৩৬’ নামকরণ করে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের বাড়ি পাবনায়। সেখানকার মানুষ তাকে নিয়ে গর্ব করেন। তার স্মৃতি ও শিল্পকর্মকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে স্থানীয়ভাবে কাজ করছে সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্র সংসদের সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান।
এ দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সুচিত্রা সেনের নাম পরিবর্তনের বিষয়টিতে তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানানো হয়। ঢাকার অনেক শিল্পীও এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
এ ঘটনায় খেদ প্রকাশ করেছেন গীতিকার সুরকার প্রিন্স মাহমুদ তার ফেইসবুকে লিখেছেন, “সুচিত্রা সেন ছাত্রীনিবাসের নাম না কি এখন ‘জুলাই-৩৬ ছাত্রীনিবাস’। বোঝেন অবস্থা! সুচিত্রা সেন শুধু পাবনার না বাংলাদেশের ব্র্যান্ড। তিনি কোনোদিন আওয়ামী লীগ করেছেন বলে খবর পাওয়া যায় নাই। লজ্জা...।”
শতবর্ষ পেরুনো এই বিদ্যাপিঠে ওই ছাত্রীনিবাসের নাম পরিবর্তন করার খবর তুলে ধরে সমালোচনা করা হয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি গণমাধ্যমেও।
একই সঙ্গে ৫ অগাস্ট তীব্র ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের নামে রাখা দুটি হলেরও নাম পরিবর্তন করে কর্তৃপক্ষ।
এর মধ্যে শেখ রাসেল ছাত্রাবাসের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বিজয়-২৪’ ছাত্রবাস এবং বেগম ফজিলাতুন্নেছা ছাত্রীনিবাসের নাম দেওয়া হয় আয়শা সিদ্দিকা (রা.) ছাত্রীনিবাস।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৩১ সালে পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে করুনাময় দাশগুপ্ত আর ইন্দিরা দাশগুপ্তের পরিবারে জন্ম হয় রমা দাশগুপ্তের। শৈশব-কৈশোরের অনেকটা সময় পাবনার আলো-হাওয়াতেই কেটেছে রমার। রমা পাবনার মহাখালী পাঠশালার পাঠ শেষ করে পা দেন পাবনা গার্লস স্কুলে; দশম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই।
এরপর দেশভাগ আর দাঙ্গার শিকার হয়ে আরো অনেক হিন্দু পরিবারের মতো রমার পরিবারও পাড়ি জমায় কলকাতায়। সেটা ১৯৪৭ সালের কথা। ওই বছরেই কলকাতায় থিতু হওয়া ঢাকার আরেক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় রমার।
শ্বশুরের আগ্রহ আর স্বামীর উৎসাহে রূপালী জগতে নাম লেখানো রমা হয়ে যান সুচিত্রা সেন।
দেশভাগের পর সুচিত্রার পরিবার পাবনা ছাড়ার পর সে সময় জেলা প্রশাসন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনের জন্য বাড়িটি রিক্যুইজিশন করেন। এরপর বাড়িটি দখল হয়ে যায়।
১৯৮৭ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সাইদুর রহমান বাড়িটি বাৎসরিক চুক্তি ভিত্তিতে ইমাম গাজ্জালী ট্রাস্টকে ইজারা দেন। এ ট্রাস্টের সঙ্গে জড়িত ছিলেন জামায়াত নেতা ও যুদ্ধাপরাধী আব্দুস সুবহান।
পাবনাবাসী বাড়িটি দখলমুক্ত করতে আন্দোলনে নামেন ২০০৯ সালে। ২০১৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাড়িটি দখলমুক্ত হয়।
বর্তমানে পাবনা জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে বাড়িটিতে সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
'সুচিত্রা সেন' ছাত্রীনিবাসের নাম বদল, প্রিন্স মাহমুদ বললেন 'লজ্জা