Published : 19 May 2025, 04:01 PM
যখনই কবর খোঁড়ার ডাক আসত মনু মিয়া নিজের চলার সঙ্গী ঘোড়াটি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন মৃতের বাড়ির দিকে। অর্ধ শতাব্দী ধরে কিশোরগঞ্জের ইটনার হাওরাঞ্চলের এই বৃদ্ধ তিন হাজারের বেশি কবর খুঁড়েছেন বিনা পারিশ্রমিকে।
৬৭ বছরের সেই মনু মিয়াই এখন অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই সুযোগে তার গ্রামের বাড়ি জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়ার বাড়ি থেকে ঘোড়াটিকে নিয়ে হত্যা করে ফেলে গেছে কিছু লোক।
বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই পুলিশ প্রশাসন তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। কারা এই সরলপ্রাণ পরোপকারী মানুষটির চলার সঙ্গী ঘোড়াটিকে হত্যা করেছে সেটা বের করার চেষ্টা চলছেও বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এলাকাবাসী ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনু মিয়া কিশোর বয়স থেকেই নিজের ভালোলাগা থেকে এলাকায় ও আশপাশে কবর খোঁড়ার কাজ শুরু করেন। কেউ মারা গেছে জানতে পারলে তিনি খুন্তি, কোদাল, ছুরি, করাত, দা, ছেনাসহ সহায়ক সব যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে চলে যান।
ফলে শুধু নিজের উপজেলা নয়, আশপাশের মিঠামইন, শাল্লা, আজমিরীগঞ্জেও তার সুনাম রয়েছে। রাজধানীর বনানী কবরস্থানে তিনি গোরখোদকের কাজ করেছেন। এর জন্য তিনি কোনোদিন কারও কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেননি। শুধু কবর খনন করেই ক্ষান্ত হন না মনু মিয়া। এ পর্যন্ত যাদের কবর খুঁড়েছেন তিনি, তাদের মৃত্যুর দিন-তারিখ সব লিখে রাখেন নিজের ডায়েরিতে।
সম্প্রতি মনু মিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী রহিমা বেগম। এর মধ্যেই শুক্রবার মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের হাসিমপুর এলাকায় রাস্তার পাশে ডোবায় মনু মিয়ার ঘোড়াটির মরদেহ দেখতে পায় স্থানীয় লোকজন।
ধারণা করা হয়, বৃহস্পতিবার রাতের কোনো এক সময় ঘোড়াটিকে বাড়ি থেকে নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। প্রচুর রক্তক্ষরণে মারা যায় ঘোড়াটি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মনু মিয়ার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে স্ত্রী ও স্বজনরা তার কাছে বিষয়টি গোপন রাখেন।
মনু মিয়ার স্ত্রী রহিমা বেগম মোবাইল ফোনে সাংবাদিকদের বলেন, “আমার স্বামীর অবস্থা খুব বেশি ভালো না। একমাত্র আল্লাহ পাকের রহমতেই উনি সুস্থ হতে পারেন। উনি জীবনে কারও কোনো ক্ষতি করেননি।
“এতোদিন জানতাম, উনাকে মানুষ ভালোবাসে। উনার এমন খারাপ অবস্থায় কী করে এমনভাবে উনার প্রিয় ঘোড়াটিকে মানুষ মেরে ফেলতে পারল? এই খবরটা আমরা উনাকে দিলে উনি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারবেন না।”
মনু মিয়ার প্রতিবেশী খাইরুল ইসলাম বলেন, “মনু মিয়া সারাজীবন নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তার অনুপস্থিতিতে তার প্রিয় ঘোড়াটিকে এভাবে কিছু লোক মেরে ফেলল। এটা খুবই নিন্দনীয় কাজ হয়েছে। এ অপরাধের কঠিন বিচার হওয়া উচিত।”
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ পুলিশ সুপারের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মুকিত সরকার বলেন, “বিষয়টি নিয়ে লেখালেখির পর মিঠামইনের ওসিকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ পাওয়ামাত্রই প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
মিঠামইন থানার ওসি আলমগীর কবির বলেন, “তদন্ত চলছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”