Published : 17 May 2025, 01:18 PM
বিষাক্ত বর্জ্য ও রাসায়নিকের কারণে পানি দূষণ বেড়ে যাওয়ায় চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে আবারো মরে ভেসে উঠছে দেশীয় মাছ।
শুক্রবার ভোরে নদীতে নেমে জাটকা, চেউয়া, বাইলা, টেংরা, পুটি, চাপিলাসহ অসংখ্য ছোট-বড় দেশীয় মাছ মরা মাছ ভেসে থাকতে দেখতে পান স্থানীয় জেলেরা।
বিশেষ করে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে দশানি থেকে মেঘনা পাড়ের বিভিন্ন স্থানে এমন চিত্র দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন মতলব উত্তর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস।
তার দাবি, “শীতলক্ষ্যা নদীতে কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও কেমিক্যালযুক্ত দূষিত পানি প্রবাহিত হয়ে পার্শ্ববর্তী মেঘনা নদীতে গিয়ে মিশছে। এতে মেঘনার পানি দূষণ হওয়ায় নদীতে থাকা বিভিন্ন ধরনের দেশীয় মাছ মরে ভেসে উঠছে।
এদিকে ইলিশের জাটকা মরে ভেসে উঠায় শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন মেঘনা পাড়ের জেলেরা। এভাবে ছোট আকারের পোনা মারা পড়লে সামনে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়েছে তাদের কপালে।
এছাড়া পঁচা মাছের দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ নদীপাড়ের বাসিন্দারা। পাশাপাশি দূষণের কারণে নদীর পানি খাওয়া ও ব্যবহার করতে পারছে না তারা। তাই কী কারণে বার বার নদীতে মাছ মারা যাচ্ছে এবং পানি দূষণ হচ্ছে, তার সমাধান চান তারা।
ষাটনল এলাকার জেলে পলাশ বর্মন বলেন, “এই নদীই আমাদের জীবন। কিন্তু এখন এই পানিতে মাছ তো নেই, বরং বিষ ছড়িয়ে গেছে। কয়েক বছর ধরেই এমন হচ্ছে। কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
“জাটকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মাছ শূন্য হয়ে যাবে নদী।”
স্থানীয় বাসিন্দা সেলিনা বেগম বলেন, “বাচ্চারা নদীতে গোসল করে, খেলতে যায়। এখন তো মনে হচ্ছে পানিতে হাত দিলেও অসুস্থ হয়ে যাবে। আমরা নদীর পানি সব সময় ব্যবহার করি কিন্তু এখন পারছি না “
মাছ মরে যাওয়ার এই ঘটনায় শুধু পরিবেশ নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শত শত জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীরাও। নদীর ওপর নির্ভরশীল হাজারো মানুষের জীবিকাও এখন হুমকির মুখে।
দশানী এলাকার মাছ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, “যা দেখলাম, তাতে আগামী কয়েক মাস নদী থেকে মাছ পাওয়া কঠিন হবে। বাজারে মাছের দাম বেড়ে যাবে, মানুষ কষ্ট পাবে।”
কলাকান্দা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. শামসুদ্দিন বলেন, “যেসব এলাকায় মাছ মরে যাচ্ছে, ওই এলাকা পরিদর্শন করেছি। নদীর এই অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক। মাছ মরার এই ঘটনা শুধু পরিবেশের ক্ষতি নয়, মানুষের জীবিকার উপরও সরাসরি আঘাত।
তিনি বলেন, “প্রতিদিন শত শত মানুষ এই নদীর উপর নির্ভরশীল। বারবার অভিযোগ করলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আমি উপজেলা পরিষদে বিষয়টি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছি এবং জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠাব।”
“নদী বাঁচলে আমরা বাঁচবো, এটাই এখন সবার মূল দাবি হওয়া উচিত”, বলেন এই ইউপি সদস্য।
মতলব উত্তর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস বলেন, “এটি নিছক মাছ মরার ঘটনা নয়, এটি একটি জলজ পরিবেশগত দুর্যোগ। শীতলক্ষ্যা থেকে আসা দূষিত পানির প্রবাহ একাধিকবার এ এলাকায় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এটি প্রথম নয়, একাধিকবার এমন ঘটনা ঘটেছে।”
তিনি বলেন, “২০২৩ সালের মার্চ ও ২০২৪ সালের অগাস্ট মাসেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। তখনও মেঘনার পানি দূষিত হয়ে মাছের গণমৃত্যু হয়। তবে এবার পরিমাণ আরও বেশি দেখা যাচ্ছে। ”
পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠন ‘মতলবের মাটি ও মানুষের’ সভাপতি শামীম খান বলেন, “নদীকে কেন্দ্র করে হাজারো পরিবার জীবন নির্বাহ করে। বারবার দূষণে নদী মৃতপ্রায়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
নদী দূষণ ঠেকাতে দ্রুত আন্তঃজেলা পরিবেশ কমিশন গঠন এবং কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবিও জানান এই পরিবেশকর্মী।
চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, “মেঘনা নদীতে মাছ মরে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে গত ৩০ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
“সেখানকার রিপোর্ট অনুযায়ী নদীর পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায়, পিএইচ ও অক্সিজেনের হার কমে গিয়েছিল। এছাড়া নদীর তলদেশ দিয়ে কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও কেমিক্যালযুক্ত পানি বয়ে যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “নতুন করে আবার কেনো মাছ মারা যাচ্ছে, সেটি তদন্ত করে দেখতে হবে। তবে আবারো মাছ মারা যাওয়ার খবর এখনো কেউ জানায়নি। ঘটনাস্থলে গেলে পুরো বিষয়টি জানতে পারব।”