Published : 26 May 2025, 10:13 AM
বাঁশ দিয়ে তৈরি একেকটি চাঁইয়ের উচ্চতা সাত থেকে আট ফুট, প্রশস্ত ১৫ ফুট। নদীর গভীরে এ মাছ ধরার ফাঁদে একবারে ধরা পড়ে ২০০ থেকে ৩০০ কেজি পাঙাস মাছের পোনা। এতে চরম হুমকির মুখে পড়ছে নদীর পাঙাসের বংশবৃদ্ধি।
দৈত্যাকারের চাইয়ে এভাবে পোনা ধরা চলতে থাকলে এক সময় নদীতে আর সুস্বাদু পাঙাস মাছ পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করছেন মৎস্য কর্মকর্তা, জেলেসহ সংশ্লিষ্টরা।
বরিশালের হিজলা উপজেলার ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সভাপতি মো. বাশার বলেন, “একেকটি চাঁইয়ের মধ্যে দুই তিনজন মানুষ ঢুকতে পারে। সেগুলো নদীতে ফেলার পর আড়াই থেকে তিন মণ পাঙাস মাছ পাওয়া যায়।
“তাই অতিরিক্ত মুনাফার আশায় এসব চাঁই তৈরি করে বরিশালের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে ফেলছেন অসাধু ব্যক্তিরা।”
মৎস্যজীবী সমিতির এ নেতা আরও বলেন, “এভাবে মাছ ধরতে নিষেধ করলেও তারা শোনে না। এর মধ্যে প্রশাসন কয়েকটি চাঁই আটক করে পুড়িয়ে ফেলছে। তবুও তাদের থামানো যাচ্ছে না, ধ্বংসের মুখে পড়েছে নদীর পাঙাসের ভবিষ্যৎ।”
তবে এখন হিজলায় এই চাঁই নেই। তবে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার অংশে কিছু রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সভাপতি মো. পলাশ বলেন, “মেঘনা নদীর হিজলা সংলগ্ন এলাকায় কিছু জেলেরা এ চাঁই দিয়ে মাছ ধরে। তারা পাঙাস-টেংরাসহ ভালো মাছ পায় বলে শুনেছি। এসব মাছ ঢাকা ও বরিশালে নিয়ে বিক্রি করা হয়।”
বরিশালের মৎস্য দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, মার্চ থেকে মে এই দুই মাস জাটকা ইলিশ রক্ষায় মেঘনা নদীর অভয়াশ্রমে সব ধরনের মাছ শিকার নিষিদ্ধ থাকে। এ সময়ে পাঙাস মাছও নদীতে নিরাপদ প্রজনন করে।
পাঙাসের ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার পর মেঘনা নদীর গভীর পানিতে বিচরণ করে খাবার খেয়ে বড় হয়। অগাস্টের মধ্যেই দ্রুত বর্ধনশীল এ মাছ একেকটি পাঁচ-ছয় কেজি ওজনের হয়। কিন্তু কিছু অসাধু জেলের কারণে সেসব পোনার সিংহভাগই ধরা পড়ছে।
একাধিক জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জ, ভোলার চরফ্যাশন ও মনপুরা এলাকায় এসব চাঁই তৈরি করার কারিগর আছে। তাদের কাছ থেকে একটি চাঁই ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় কিনে আনেন তারা।
পরে নদীর ৪০-৫০ ফুট গভীরে চাঁইগুলো ফেলা হয়। এর আগে বাঁশের কাঠি দিয়ে তৈরি এ ফাঁদের মধ্যে শুঁটকি, খৈল, কুড়াসহ বিভিন্ন খাবার দিয়ে তৈরি মিশ্রনের মণ্ড দেওয়া হয়।
সে খাবারের ঘ্রাণ পেয়ে চাঁইয়ের কাছে আসে পাঙাস মাছের পোনা। ঘুরতে ঘুরতে চাঁইয়ের মধ্যে ঢুকলে আটকা পড়ে যায় তারা। এভাবে একেকটি চাঁইয়ে ২০০ থেকে ৩০০ কেজি পাঙাস মাছের পোনা ধরা পড়ে। বাজারে ওই মাছ টেংরা বলে বিক্রি করা হয়।
হিজলা মান্দ্রা চর কুশরিয়া গ্রামের বাসিন্দা মেঘনা নদীর জেলে রিয়াজ মোল্লা বলেন, “বড় পাঙাস জাল দিয়ে ধরা হয়। কিন্তু পাঙ্গাস মাছের পোনা শিকারের জন্য চাঁই ফেলা হয়।
“চাঁইগুলোকে নদীর গভীরে পাঠাতে ভেতরে এক থেকে দেড়মণ ওজনের সমপরিমাণ ইট দেওয়া হয়। নদীতে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা ফেলে রাখলেই মাছ পাওয়া যায়।”
তিনি বলেন, “সাধারণত ভাটার সময় এসব চাঁই ফেলা হয়। পরে জোয়ারের সময় চাঁইগুলো উঠানো হয়। জেলেরা প্রতি কেজি পাঙাস পোনা ৩০০-৪০০ টাকা দরে বিক্রি করে।”
পাঙাস মাছের পোনা বিক্রেতা বরিশাল নগরীর বেলতলা এলাকার বাসিন্দা মো. জাকির হোসেন বলেন, তারা পাইকারদের কাছ থেকে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে মাছ কিনেন। পরে বাজারে ৪০০-৫০০ টাকা দরে বিক্রি করেন।
খেতে সুস্বাদু বলে বাজারে এসব পোনার বেশ চাহিদা আছে বলেও জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলম বলেন, “পাঙাস গভীর পানির মাছ। নদীর সাধারণত ৪০-৫০ ফুট নিচে তারা চলাচল করে। এসব মাছের পোনাও গভীর পানিতে থাকে। সাধারণত জাল নদীর তেমন গভীরে পৌঁছায় না। তাই পাঙাসের পোনা ধরার জন্য অসাধু জেলেরা বাঁশ দিয়ে তৈরি চাঁই কিনে এনে নদীতে ফেলে।”
তাই এসব চাঁইয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান করা হয় দাবি করে তিনি বলেন, “গত এক মাসে মেঘনা নদীতে ফেলার জন্য আনা ছয়টি চাঁই জব্দ করে পোড়ানো হয়েছে। তারপরও মেহেন্দিগঞ্জ ও শ্রীপুর এলাকায় কয়েকটি চাঁই রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। সেগুলোও জব্দ ও ধ্বংস করা হবে।”
তিনি বলেন, রাজশাহীর পদ্মা নদীর কিছু এলাকায়ও এ ধরনের বাঁশোর চাঁই ব্যবহারের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব যদি বন্ধ করা না যায়, এক সময় নদ-নদী থেকে পাঙাস মাছ বিলুপ্ত হবে।