Published : 14 Feb 2023, 10:47 AM
ন্যাড়ামাথার গাছগুলোতে ঘর বেঁধেছে শিমুল ফুল। এক ঝলকে মনে হবে যেন আগুন লাল দ্যুতি ছড়াছে। থেকে থেকে দোল খাচ্ছে বসন্তের পাগলা হাওয়ায়। বিস্মৃত বাগানজুড়ে যেন রঙের আগুন।
শিমুলের সেই রঙে মন রাঙিয়ে ভালোবাসা দিবস আর ফাল্গুন উদযাপন করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় জমিয়েছে সুনামগঞ্জের হাজি জয়নাল আবেদিন শিমুল বাগানে।
প্রায় দুই হাজার গাছের শিমুল বাগানটি তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তগ্রাম মানিগাঁওয়ে ঘন সবুজ পাহাড়, ঝলমলে যাদুকাটা নদী আর মরুময় বিস্তীর্ণ বালুপ্রান্তর ঘেরা প্রকৃতিসুন্দর স্থানে। বাগানটি এখন দেশ বিদেশের সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের অন্যতম আকর্ষণের স্থান হয়ে উঠেছে।
কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, দেশের ‘সর্ববৃহৎ’ এই শিমুল বাগানে প্রতিবছর ফুল ফোটার সময়ে, বিশেষ করে ভ্যালেন্টাইনস ডেতে দলে দলে এসে লাল শিমুলের রঙে মন রাঙান প্রকৃতি প্রেমিকেরা।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই শিমুল বাগানে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি দেখা গেছে। ঠোঁটে বসন্ত ও ভালোবাসার গান ফেরি করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছেন লোকজন। সারি সারি বাগানের দুর্বাছাওয়া ঘাসপথ স্বাগত জানাচ্ছে তাদের।
প্রাণ খুলে গাইছেন এই অঞ্চলেরই বাউল মহাজন শাহ আবদুল করিমের গান ‘বসন্ত বাতাসে সইগো...’।
জয়নাল আবেদীনের মেয়ে সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সেলিনা আবেদীন জানান, দুই যুগ আগে তাহিরপুর উপজেলার সোহালা গ্রামের শিক্ষানুরাগী ও বৃক্ষপ্রেমী জয়নাল আবেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে মানিগাঁওয়ের যাদুকাটা নদীর দক্ষিণে বিস্তীর্ণ বালুময় প্রান্তরে দুটি শিমুল গাছ দেখতে পান।
বালু ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসা সেই নয়নাভিরাম ‘স্বর্গীয় বৃক্ষ’ দোল খাচ্ছিল বসন্তের পাগলা হাওয়ায়। ন্যাড়া ডালে লেজ নাড়ছিল হরেক পাখি।
এই দৃশ্য দেখে এই বৃক্ষপ্রেমীর মনটা ভালো হয়ে ওঠে। ঠিক করেন পুরোটা জায়গা কিনে শিমুল বাগান করবেন। যেই ভাবনা, সেই কাজ। তিনি শিমুল বাগান করতে প্রায় ৩৩ একর জায়গা ক্রয় করে নেন। পরিচিত উদ্ভিদ বিশারদ কয়েজনের পরামর্শ নিয়ে সংগ্রহ করেন শিমুল গাছের চারা।
সারি সারি গর্ত খুঁড়ে শুরু হয় তার শিমুল গাছ লাগানোর কাজ। বালুময় প্রান্তরে লাগিয়ে দেন দুর্বাঘাস। নাওয়া খাওয়া ভুলে বাগানের তদারকি শুরু করেন। গাছ লাগানো শেষে সারি সারি শিমুল গাছ দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায় তার। দুর্গম মরুময় প্রান্তরে পানি, গোবর দিয়ে বৃক্ষগুলোতে বাঁচিয়ে রাখতে নিজেই শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করেন।
এক বছর যাওবার পরই গাছের ডালপালা ছাতার মতো ছায়াময় হয়ে ওঠে বলে জানান সেলিনা। বলেন, “এভাবে ধিরে ধিরে বড় হতে থাকে বৃক্ষগুলো। আর তা দেখে প্রাণ জুড়ায় বাবার; অদ্ভুদ ভালো লাগায় ভরে ওঠে তার মন।”
জয়নাল আবেদীন ২০০৬ সালে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ততদিনে শিমুল গাছগুলো বড় হয়ে গেলেও ফুল ফোটা দেখে যেতে পারেননি তিনি। ২০১১-২০১২ সালের দিকে শিমুল বাগানে ফুল ফুটতে শুরু করে।
দুর্গম যোগাযোগহীন অজপাড়া গায়ে বসন্তে রঙে আগুন হয়ে ওঠে বাগানটি; ন্যাড়ামাথার ডালগুলোতে আবার লাল শিমুল ফুটতে শুরু করে।
সেলিনা বলেন, প্রথমে প্রকৃতিপ্রেমী বা ভ্রমণার্থীরা এ বাগানের কথা জানতেন না। ২০১৩-২০১৪ সালে দিকে জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিমুল বাগান নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সবাই জানতে পারে। দেশ বিদেশের প্রকৃতি প্রেমীদেরও নজর কাড়ে।
তারা সপরিবারে ছুটে আসেন বসন্তকালে, ভালোবাসার দিনে হাত ধরে হাঁটাহাটি করেন। আনমনে কন্ঠে তোলেন বসন্তের গান-‘বসন্ত বাতাসে সইগো, ‘আহা আজি এই বসন্তে’, অথবা ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়..’ ।
খোঁপা, হাতে শিমুল ফুলের মালা পরে রঙিন হয়ে ওঠেন নারী ও শিশুরা। প্রেমিক-প্রেমিকারা ছুটে বেড়ান বিশাল বাগানের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
ভ্রমণার্থীদের আনন্দ দিতে বাগানে ঘোড়া ও সাইকেলে চড়ার ব্যবস্থা রয়েছে; আছে নাগরদোলাও। অনেকে ক্যাম্প করে রাতেও অবস্থান করেন বাগানে।
বসন্ত উৎসব পালন করতে জয়নাল আবেদিন শিমুল বাগানে এসেছেন সুনামগঞ্জ জেলার কালচারাল অফিসার আহমেদ মঞ্জরুল হক চৌধুরী পাভেল। এখানেই নাচ, কবিতা ও গানে গানে বসন্তকে স্বাগত জানাবেন বলে জানালেন।
তিনি বলেন, “শিমুল বাগানে আজ বসন্ত উৎসব করবো। ভ্রমণার্থীরা চাইলে এই উৎসবে শরিক হতে পারবেন। আমরা এই অঞ্চলের মহাজনদের সৃষ্টি পরিবেশন করবো।“
বাগানের স্বত্ত্বাধিকারী জয়নাল আবেদীনের ছেলে বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রাকাব উদ্দিন বলেন, “আমার বাবা ছিলেন একজন বৃক্ষ ও পরিবেশপ্রেমী। তিনি শিমুল বাগান করার আগে টাঙ্গুয়ার হাওরেও কয়েক হাজার হিজল-কড়চ বাগ লাগিয়েছিলেন।
“টাঙ্গুয়ায় সবুজ হিজল-করচের বাগে ভ্রমণ পিপাসুরা যেভাবে আনন্দ উদযাপন করছেন, একইভাবে বাবার লাগানো শিমুল বাগানে এসেও তারা মন রাঙাচ্ছেন।”
তিনি বলেন, “প্রকৃতিকে রাঙিয়ে, মানুষকে আনন্দ দিয়ে এভাবেই স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছেন বাবা। আমরা পরিবারের সবাই মিলে বাগানে ভ্রমণার্থীদের জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা ও তাদের রিফ্রেশমেন্টের উদ্যোগ নিয়েছি।”
তাহিরপুর উপজেলার সূর্যের গাও গ্রামের শিক্ষক পলি রায় বলেন, গত এক দশক ধরে শিমুল বাগান বসন্তকালে মানুষের নজর কেড়েছে। বাগানে আসা যাওয়া কষ্টকর হলেও যাদুকাটা নদী ও মেঘালয় পাহাড় ঘেঁষা পরিবেশ দেখে মানুষের মন ভালো হয়ে ওঠে।
“আমি প্রতি বছরই বাগানে এসে মন রাঙিয়ে যাই।”
বাগানের পার্শবর্তী মাঝেরটিলা গ্রামের ফ্লোরা সাংমা বলেন, “আমাদের বাড়ির পাশের এই শিমুল বাগানটি বসন্তে মানুষের আনাগোনায় আরও রঙিন হয়ে ওঠে। বিদেশে থেকেও অনেকে ছুটে আসেন এই বাগানের টানে।”