Published : 07 Aug 2023, 03:44 PM
বাগেরহাটে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন কবি মোহাম্মদ রফিক।
সোমবার বেলা এগারোটায় বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের চিতলী বৈটপুর গ্রামে নিজের গড়া উদ্দীপন বদর-সামছু বিদ্যানিকেতন মাঠে জানাজা শেষে তার দাফন হয়।
এর আগে সকালে ওই বিদ্যানিকতনে তার মরদেহ রাখা হয়। টানা বৃষ্টির মধ্যেও এলাকাবাসী, কবির ছাত্র, অনুজ, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা তাকে এক নজর দেখার জন্য ভিড় করতে থাকেন। তারা ফুল দিয়ে কবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানান।
কয়েকদিন আগে নিজের বাড়ি বাগেরহাটে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর ঢাকায় আনার পথে রোববার রাতে মোহাম্মদ রফিকের মৃত্যু হয়।
১৯৪৩ সালে বাগেরহাট জেলার বৈটপুরে জন্ম নেওয়া মোহাম্মদ রফিকের বাবা সামছুদ্দীন আহমদ এবং মা রেশাতুন নাহার। ভাই-বোনদের মধ্যে রফিক ছিলেন সবার বড়। তার ভাইদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ তারেক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসের।
মোহাম্মদ রফিকের শৈশব কাটে বাগেরহাটে; ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ঢাকায় আসেন, ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে। বিএ পাসের পর ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি নেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন মোহাম্মদ রফিক। স্বাধীন বাংলা বেতারেও তিনি কাজ করেন।
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে যোগ দেন রফিক। ২০০৯ সালে তিনি অবসরে যান।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই মোহাম্মদ রফিকের কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এসময় তিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন। তখন সামরিক আদালতে তাকে কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীন দেশেও পরে তিনি সামরিক শাসকের রোষের শিকার হয়েছিলেন।
মননশীল আধুনিক কবি হিসেবে পরিচিত রফিক আলোচিত হয়ে আছেন গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের বিরাগভাজন হয়ে।
এরশাদকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘খোলা কবিতা’ নামে আলোড়ন তোলা কবিতা, যার কয়েকটি পঙক্তি ছিল এমন- ‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই’।
এই কবিতা তখন কেউ ছাপাতে সাহস পায়নি। গোপনে তা ছাপানো হয় এক ছাপাখানায়। নিউজপ্রিন্টে এক ফর্মায় ছাপানো সেই কবিতা গোপনে বিলি করেন মোহাম্মদ রফিকের ছাত্র-ছাত্রীরা। এভাবে হাতে হাতে সেই কবিতা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কাব্যিক রসদ জুগিয়ে তোলা এই কবিতার জন্য মোহাম্মদ রফিককে সেনানিবাসে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। তার নামে হুলিয়া জারি হয়। তাকে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল।
মোহাম্মদ রফিকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বৈশাখী পূর্ণিমা প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ধুলোর সংসারে এই মাটি, কীর্তিনাশা, কপিলা, স্বদেশী নিশ্বাস তুমিময়, মৎস্যগন্ধা, বিষখালী সন্ধ্যা, কালাপানি, নোনাঝাউ, ত্রয়ী, চিরহরিতের উপবাস।
এছাড়া বেশ কিছু গদ্য ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও লিখেছেন তিনি।
মোহাম্মদ রফিক ২০১০ সালে ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদকে ভূষিত হন। তার আগে ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। এছাড়া নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত তিনি।
কবিকে খুব কাছ থেকে দেখা বৈটপুর গ্রামের প্রতিবেশী তৈয়বুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, “ইংরেজি ভাষা সাহিত্যে পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিল কবি রফিক। মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও কোনো দিন ভাতা গ্রহণ করেননি। তার জানাজায় অনেক মানুষ অংশ নিক তা তিনি চাননি। তার মায়ের কবর গ্রামে। তিনি প্রায়ই গ্রামে আসতেন। স্কুল ও চিকিৎসালয়সহ নানা সমাজকর্মে সব সময় মনোনিবেশ করতেন। তিনি সংগ্রামী ছিলেন। জেল খেটেছেন, রাজটিকিট পেয়েছেন। আইয়ুব খান তার ছাত্রত্ব বাতিল করে দেওয়ার পরও তিনি দমেননি। তিনি সৎ ও সাহসী ছিলেন যা আমার দেখা অতুলনীয়। তিনি সমাজের নানা অসংগতি তুলে ধরতেন।”
স্মৃতিচারণ করে অনুবাদক ও নাট্যসংগঠক বাগেরহাটের মোর্শেদুর রহমান সাগর এই প্রতিবেদক বলেন, “মোহাম্মদ রফিক একজন বাঙালি ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন এই ভেবে যে, আমরা আমাদের বাঙালিত্ব হারাচ্ছি। আমরা কেউ বাঙালি মুসলমান অথবা কেউ বাঙালি হিন্দু হতে চাচ্ছি। কিন্তু বাঙালির জায়গাটা শূন্য থেকে যাচ্ছে।
“তিনি বাগেরহাটে এসেছিলেন বৃষ্টি দেখবেন বলে। বৃষ্টি দেখেও তার মনঃপূত হচ্ছিল না। তিনি চাইছিলেন, টিনের চালের উপর বৃষ্টি পড়বে আর বৃষ্টি পতনের শব্দ শুনবেন। কিন্তু তার শরীর আর সায় দিল না। শারীরিক অবস্থার কথা কবিকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি রেগে গিয়ে বলতেন- ‘তুমি শরীরের কথা বলবা না। আমার মস্তিষ্ক সচল আছে কিনা সেটাই আসল। মস্তিষ্ক বেঁচে থাকলে মনে করবা আমি বেঁচে আছি।’
আরও পড়ুন: