Published : 14 Feb 2023, 10:01 PM
‘ফুলের রাজধানী’ খ্যাত যশোরের গদখালিতে গোলাপসহ অন্যান্য ফুলের দাম এবার রেকর্ড ভেঙেছে বলে চাষি ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
চাষিরা পাইকারদের কাছে প্রতিটি গোলাপ ২৫ টাকায় বিক্রি করছেন। আর গ্রাহক পর্যায়ে খুচরা বিক্রি হচ্ছে রংভেদে ৪০-৪৫ টাকা।
জানুয়ারির শেষে প্রতিটি গোলাপ বিক্রি হয়েছে ৩-৪ টাকায়।
সপ্তাহখানেক আগে প্রতিটি গোলাপ ৮-১০ টাকায় বিক্রি হলেও সোমবার তা বিক্রি হয়েছে ২০-২৫ টাকায়। রংভেদে প্রতিটি গোলাপের দাম ৩০ টাকা ছাড়াতে পারে।
গোলাপের দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে গদখালির পাইকারি ফুল ব্যবসায়ী সেলিম হোসেন বলেন, “এবার গোলাপ ফুলে রোগ দেখা দেওয়ায় উৎপাদন কম হচ্ছে। আবার এই সময় বাজারে চাহিদা বেশি। তাই দামও চড়া। ফুলের ব্যবসা করছি পনেরো বছর। এত বেশি দামে কখনও গোলাপ বেচাবিক্রি করিনি।”
এত কিছুর পরও চির আকাঙ্ক্ষিত দিনটিতে তরুণ-তরুণীদের হাতে পছন্দের ফুল তুলে দিতে ব্যস্ততার কমতি নেই ফুল ব্যবসায়ীদের।
সৈয়দপাড়া গ্রামের ফুল চাষি সোহেল রানা বলেন, এ বছর অন্যান্য ফুল খুব ভালো হলেও গোলাপে কুঁড়ি পচা রোগ দেখা যাচ্ছে। ৮২ শতক জমিতে দেশি গোলাপ ও চায়না গোলাপ চাষ করেছি। সোমবার বিক্রি করেছি। ২৭ হাজার টাকার গোলাপ। প্রতিটি দেশি গোলাপ বিক্রি করেছি ২১ টাকা; আর চায়না গোলাপ ২২ টাকা।
আশা করছি এবার আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার ফুল বিক্রি হবে।
গদখালি গ্রামের ফুল চাষি ইব্রাহিম হেসেন বলেন, “এবার গোলাপের উৎপাদনে ধস নেমেছে। কাঁচাপাতা ঝরা ও কুঁড়ি পচা রোগ চাষিদের শেষ করে দিয়েছে। এজন্য গোলাপের দাম রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ১০ বছর ধরে ফুলচাষ করছি, কখনও ১৮ টাকা পিস গোলাপ বিক্রি করতে পারিনি।”
এবার ফুলের দাম আরও বাড়বে এবং রেকর্ড পরিমাণ দামে গোলাপ বিক্রি হবে বলে তিনি মনে করেন।
'ফুলের বাজার ডটকম' নামের অনলাইনের তরুণ উদ্যোক্তা মো. আল আমিন বলেন, গত সপ্তায় প্রতিটি গোলাপ ফুল বিক্রি হয়েছে ৮-১০ টাকায়; সোমবার বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকায়। চায়না গোলাপ লংস্টিক রোজ গত সপ্তাহে ২৫-৩০ টাকা এবং এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০-৪০ টাকায়। রজনীগন্ধা স্টিক ৮-১০ টাকার প্রতিটি এখন বিক্রি হচ্ছে ১২-১৫ টাকায়। গ্লাডিওলাস রংভেদে ভেদে ৮-১৫ টাকার ফুল বিক্রি হচ্ছে ১২-১৫ টাকায়। প্রতিটি ১০ টাকার জারবেরা বিক্রি হচ্ছে ১২-১৫ টাকায়।
এ ছাড়া চন্দ্রমল্লিকা প্রতিটি ৩-৪ টাকা, গাঁদা প্রতিহাজার ৪০০-৫০০ টাকা, লিলিয়াম প্রতিটি ১০০ টাকা, রডস্টিক প্রতি বান্ডিল ১৫০ টাকা, জিপসি প্রতি আঁটি ৪০ টাকা ও কামিনী পাতা প্রতি আঁটি ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে তিনি জানান।
গত তিন দিনে ৫০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করেছেন বলে আল আমিন জানান।
গদখালি বাজার থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে পানিসারা 'হাড়িয়া মোড়'; যেখানে রয়েছে পর্যটন স্পট।
মঙ্গলবার এখানে দেখা যায় দর্শনার্থীদের প্রচণ্ড ভিড়। পহেলা ফাল্গুন বসন্তবরণ ও ভালবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে নবসাজে সাজানো হয়েছে এখানকার বিভিন্ন পর্যটন স্পট। দোকানিরা বিভিন্ন ধরনের ফুল, ফুলের ব্যান্ড, ফুলের তোড়া থরে থরে সাজিয়ে রেখেছেন। বেচাবিক্রিও ভালো।
এখানে ঘুরতে আসা নানা বয়সের তরুণী-কিশোরী খোঁপায় পরেছেন রক্তরাঙা লাল গোলাপ।
কথা হয় জান্নাতুল অবন্তীকা, শেফাত মেহজাবিন মেহত্রা, ইয়াসমিন ঐশি, সুরাইয়া সুলতানা কাকলি, লিজা আকতার পপি, আফরোজা শিরিন, সুরাইয়া ইয়াসমিন শিউলির সঙ্গে। তারা স্থানীয় একটি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী। সবাই সহপাঠী, বান্ধবী।
সুরাইয়া ইয়াসমিন শিউলি বলেন, “কয় বান্ধবী মিলে ফুলের রাজ্যে এসেছি ফাগুন ও ভালোবাসার দিনটি উপভোগ করতে। বান্ধবীরা সবাই ফুল কিনেছি। ফুলের বাগানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি। সবাই মিলে বেশ আনন্দ করছি, যা বলার মতো নয়।”
বেনাপোলের কামাল হোসেন সপরিবারে এসেছেন ফুলের রাজ্য ঘুরতে।
কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই প্রথম বেড়াতে এসে খুবই ভালো লাগছে এবং বেশ উপভোগ করছি ফাল্গুনের প্রথম দিনটি। দূরদূরান্তে গেছি বহুবার, অথচ বাড়ির পাশের এই জায়গা ঘুরে দেখা হয়নি কোনো দিন। মেয়েরা মাথায় ফুলের ব্যান্ড কিনেছে। ওরা খুব উপভোগ করছে।”
যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির বরাতে ‘গদখালির ফুলের জনক’ খ্যাত শের আলি বলেন, বসন্ত ও ভালবাসা দিবস উপলক্ষে গদখালি থেকে অন্তত ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। সোমবার ১৫০ জন ফুলচাষি অন্তত ২০ লাখ গাঁদা ফুল নিয়ে হাটে আসেন। শুধু গাঁদাই গড়ে আট লাখ টাকা বেচাবিক্রি হয়েছে।
আশির দশকে শের আলি সর্দারের হাত ধরে গদখালি এবং আশপাশের মানুষ ফুলের চাষ শুরু করে যা আজকে ফুলের রাজধানী গদখালি হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, “এবার ভালোবাসা দিবসের বড় আকর্ষণ ছিল নেদারল্যান্ডসের জাতীয় ফুল 'টিউলিপ' ও সুগন্ধি ফুল 'লিলিয়াম'। এছাড়া রঙিন গ্লাডিওলাস, জারবেরা, রজনীগন্ধা ও নানা রঙের গোলাপ তো রয়েছেই। গাঁদা ফুল বেশি বিক্রি হয় একুশে ফেব্রুয়ারি আর বসন্ত উৎসবে।”
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ বলেন, “উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের প্রায় ৬৩০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুলচাষের সঙ্গে এখানকার প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কৃষক এবং প্রায় এক লাখ শ্রমিক সম্পৃক্ত রয়েছেন।”
তিনি জানান, এ বছর ২৭২ হেক্টর জমিতে গ্লাডিওলাস, ১৬৫ হেক্টর জমিতে রজনীগন্ধা, ১০৫ হেক্টর জমিতে গোলাপ, ৫৫ হেক্টর জমিতে গাঁদা, ২২ হেক্টর জমিতে জারবেরা এবং প্রায় ৬ হেক্টর জমিতে অন্যান্য ফুল চাষ হয়।