Published : 02 Apr 2023, 09:04 AM
চৈত্র ও বৈশাখজুড়ে নেত্রকোণার গ্রামীণ জনপদ মেতে উঠে ‘বারণী মেলায়’। জেলার ৮৬টি ইউনিয়নে তিন শতাধিক হাট-বাজারে বসে এ মেলা।
এসব মেলাকে ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পিরা। তাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় মাটির তৈজষপত্রে ফুটে উঠেছে নানা বৈচিত্র্য। বিশেষ করে শিশুদের খেলনা সামগ্রীতে উঠে এসেছে গ্রামীণ ঐতিহ্য।
ধর্মীয় বিভিন্ন তিথি এবং হাটবারকে কেন্দ্র করে এসব মেলা বসে। আবার কোথাও কোথাও কয়েক দিনব্যাপী মহানাম কীর্তন হয়। সেখানেও মেলা বসে। এ ছাড়া চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি মেলা হয় গ্রামীণ জনপদে।
মনের টানে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করার কথা জানান নারী মৃৎশিল্পীরা। এদিকে মেলাকে ঘিরে কুমারপাড়ার নারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন স্থানীয় প্রশাসন।
মৃৎশিল্পীদের প্রশিক্ষণ ও অনুদানসহ নানাভাবে সহযোগিতা করার কথা জানিয়েছেন নেত্রকোণা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম।
তিনি জানান, প্লাস্টিক পণ্যের ভিড়ে মাটির তৈরি জিনিসপত্র আগের মত না চললেও পূজা-পার্বণ ও গ্রামীণ মেলা আসলেই এসবের কদর বাড়ে। বিশেষ করে চৈত্র ও বৈশাখ আসলেই চাহিদা বাড়ে মাটির জিনিসপত্রের।
এই দুই মাসজুড়ে জেলার তিন শতাধিক হাট-বাজারে গ্রামীণ মেলা বসে। এসব মেলায় মাটির তৈরি হাতি, মাছ, ঘোড়া, গরু ও পুতুলসহ শিশুদের খেলার নানা সামগ্রী বিক্রি হয়ে থাকে। এসব সামগ্রী শুধুমাত্র কুমারপাড়ার নারীরাই তৈরি করে থাকেন।
তিনি আরও জানান, প্রায় দেড় মাসব্যাপী এসব সামগ্রী বিক্রির আশায় সদর উপজেলার আমতলা, আটাপাড়া ও তেলীগাতিসহ অন্যান্য উপজেলায় বসবাসকারি কুমার পরিবারের নারীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
আমতলা গ্রামের কুমারপাড়ার মৃৎশিল্পী পরিতোষ পাল বলেন, “আমাদের গ্রামের নারীরাই শুধু বারণী মেলা উপলক্ষে মাটির জিনিসপত্র বানায়। যা আয় হয় তা দিয়া পোলাপানের পড়ালেখার খরচসহ হাতখরচ চালায় তারা।”
একই গ্রামের মৃৎশিল্পী নিশা রাণী পাল বলেন, “চৈত্রি মাস থেইক্যা মেলা শুরু অয়। অহন হাতি, ঘোড়া, পুতুল, ষাড়-গরুসহ অনেক জাতের জিনিস বানায়াম। পরে এইডা বিক্রি করি।
“এই থেইক্যা যা আয় হয় এইডা দিয়া আমরা সংসার চালাই। এইবায় আমরা সংসার চালাই। লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমরা সাথে পোলাপানও বানায়। রং করে।”
কুমারপাড়ার সরস্বতী রাণী পাল বলেন, “কামলা দিয়া হাওর থেইক্যা মাটি আনাই। এই মাটি তৈয়ার করি। মাটিডারে মোমের লাগান করণ লাগে। পরে এই মাটি দিয়া পালকি, নানান পুতুল, নৌকা, হাঁস অনেক কিছুই বানাই।
“এইতা আমরাই বানাই। পুরুষরা বানায় না। অহন দিন রাইতই কাজ করতাছি। সন্ধ্যা রাইত, মাঝ রাইত, শেষ রাইতেও কাজ কইর্যা শেষ করবাম। মেলা আইয়া পড়ছে। অহনই সব বানাইতে অইবো।”
তিনি আরও বলেন, “এসব বানাইতে বন লাগে, লাকড়ি লাগে। মাটি দিয়া বানায়া পরে পোড়াত দিয়াম। পরে রং দিয়াম। সময় লাগে। হাজার হাজার জিনিস বানায়াম।
“আমরা বানায়া দিলে পুরুষ লোকে বারণী মেলায় নিয়া বেচে। গাঁয়ের মেলা, কাটাখালি, বাংলা মেলায় বেচবো। নেত্রকোণা শহরেরও মেলা অয়। হেইখানেও বেচবো। তবে এইসব মেলা সারা বছর চললে আমরার আয় অইতো। সংসারও ভালা চলতো।”
কুমারপাড়ার ক্ষুদে মৃৎশিল্পী অর্পিতা পাল। সে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
অর্পিতা বলে, “মার কাছ থেকে কাম শিখছি। মা মাটির জিনিস বানায়। আমি রং করি পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে। টুকটাক বানাইতেও পারি। এইতা বেইচ্যা যা আয় হয় তা দিয়া খাতা-কলম কিনি।”
মৃৎশিল্পীদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মাটির তৈজষপত্র বানানোর কাজে জড়িত অর্ধশতাধিক পরিবারকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে প্রশিক্ষণ ও অনুদানের আওতায় আনা হবে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, বারণী মেলা ও বৈশাখি মেলা উপলক্ষে জেলার ১০ উপজেলায় ৬৩২ কুমার পরিবারের নারী ও শিশুরা মাটির উপকরণ তৈরি করছেন।
তাদের এই কাজে টিকিয়ে রাখতে বিভন্ন সময় সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রণোদনা দিয়ে আসছে। গ্রামীণ এ ঐতিহ্য যেন হারিয়ে না যায় সেজন্য কাজ করছেন বলে জানান রফিকুল।