Published : 16 Feb 2023, 08:54 AM
পাঁচবারের সংসদ সদস্য ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার অধ্যাপক আলী আশরাফের মৃত্যুর পর কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনের উপ-নির্বাচনে তার ছেলে মুনতাকিম আশরাফ টিটু মনোনয়ন চেয়েছিলেন; কিন্তু আওয়ামী লীগের টিকেট বাগিয়ে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন খ্যাতিমান চিকিৎসক প্রাণ গোপাল দত্ত।
চান্দিনায় আলী আশরাফ ও প্রাণ গোপালের সমর্থক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই দুই বলয়ে বিভক্ত ছিলেন। আশরাফের মৃত্যুর পর ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রাণ গোপাল সংসদ সদস্য হলেও সেই বিরোধ নিরসন হয়নি।
বরং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চান্দিনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি টিটু এবং সংসদ সদস্যের মধ্যে বিরোধ যে আরও জোরালো হয়েছে; সেটি নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতি, কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
গত ৩১ জানুয়ারি টিটু এক অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্যের সমালোচনা করে বলেন, “গতটা ছিল উপ-নির্বাচন (২০২১ সালের ৭ অক্টোবর), সামনে কঠিন নির্বাচন হবে। তৃণমূলের বাইরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনও সিদ্ধান্ত নেন না। ২০২৪ সালের নির্বাচনেও নেবেন না। সেই নির্বাচনে আমরাই মাঠে থাকব।”
আশরাফপুত্র চান্দিনা উপজেলার দোল্লাই নবাবপুর এলাকায় উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মো. গিয়াস উদ্দিনের শোক সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে এ কথা বলেন।
এর একদিন পর, ১ ফেব্রুয়ারি সংসদ সদস্যের অনুসারী হিসেবে পরিচিত চান্দিনা উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি মনির খন্দকার ফেইসবুক লাইভে এসে তার জবাব দেন।
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ভুল করবেন না। আমার মনে হয় না টিটুকে নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হবে। সংসদ সদস্য প্রাণ গোপালের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে তোমাকে দাঁত ভাঙা জবাব দেওয়া হবে।”
মনির খন্দকার লাইভে উপজেলার মাইজখার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম প্রধান, কুমিল্লা উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. মহিউদ্দিন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ টিটু, সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আলমকে নিয়েও নেতিবাচক মন্তব্য করেন। এমনকি তিনি প্রয়াত সংসদ সদস্য আলী আশরাফের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি।
পরে মনির সাংবাদিকদের বলেন, “আওয়ামী লীগের উপজেলা সভাপতি টিটু বর্তমান সংসদ সদস্য প্রাণ গোপাল দত্তের বিরুদ্ধে আপত্তিকর ও অসম্মানজনক বক্তব্যের জবাবে আমি এসব কথা বলেছি। টিটু আমাদের এমপি সাহেবকে অসম্মানজনক কথা বলে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন।”
এরপর দুই বলয়ের দ্বৈরথ তৃণমূলে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। সাধারণ নেতাকর্মীদের অভিমত, আগামী জাতীয় নির্বাচনে দুজনই মনোনয়ন চাইবেন। নিজেদের বলয় শক্তিশালী করার পাশাপাশি বিভেদ আরও বাড়বে।
চিকিৎসক হিসেবে জাতীয়ভাবে পরিচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাব্কে উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৪ সালের দশম নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে এলাকার তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় তার নিজস্ব একটি বলয় তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান।
সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কয়েকজন নেতা জানান, দীর্ঘদিন প্রাণ গোপাল দত্ত ও অধ্যাপক আলী আশরাফ একসঙ্গে চান্দিনা উপজেলায় কাজ করেছেন। কিন্তু নির্বাচনের সময় দলের মনোনয়ন পেয়েছেন আলী আশরাফ। প্রাণ গোপাল দত্ত সবসময় নৌকার পক্ষেই কাজ করেছেন। তিনি সবসময় দলকে শক্তিশালী করার কথা তার সমর্থকদের বলতেন।
প্রাণ গোপালের অনুসারীদের দাবি, ২০১৫ সালের একটি ঘটনা দুজনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। এরপরই প্রাণ গোপাল দত্ত মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেন। শেষ দিকে অধ্যাপক আলী আশরাফ বেশিরভাগ সময় ঢাকাতেই থাকতেন।
অপরদিকে মুনতাকিম আশরাফ টিটুর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতা বলেন, স্বাধীনতার পরবর্তীকালে বিশেষত পঁচাত্তরের পর চান্দিনায় আওয়ামী লীগ অনেক দুঃসময় পার করেছে। অধ্যাপক আলী আশরাফ সেই সময়টাতে এলাকায় থেকে দলকে ধরে রেখেছেন এবং সমর্থকদের পাশে থেকেছেন। তৃণমূলে তার জনপ্রিয়তার এটা ছিল সবচেয়ে বড় কারণ। সে কারণেই তিনি বারবার মনোনয়ন পেয়েছেন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
মুনতাকিম আশরাফ টিটু বাবার সেই সমর্থকদের ধরে রেখেই নিজের রাজনীতির ভিত গড়েছেন এখানে। ফলে চান্দিনায় তিনি আগামী নির্বাচনে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবেই রয়েছেন।
চান্দিনা উপজেলার আসনটি একসময় কুমিল্লা-৬ নামে পরিচিত ছিল। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত চান্দিনা উপজেলার সঙ্গে বরুড়া উপজেলার একটি অংশ যুক্ত ছিল। বর্তমানে বরুড়া উপজেলা নিয়ে আলাদা একটি আসন হয়েছে।
অধ্যাপক আলী আশরাফ কুমিল্লা-৬ আসন হিসেবে দুবার সংসদ সদস্য হয়েছেন আর কুমিল্লা-৭ হিসেবে তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কুমিল্লায় সাতটি সংসদীয় আসন ছিল। এরপর নতুন করে সীমানা নির্ধারণের কারণে বর্তমানে সেখানে আটটি আসন হয়েছে। কুমিল্লা আদর্শ সদর, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এবং কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকা নিয়ে গঠিত আসনটি কুমিল্লা-৬ হিসেবে পরিচিতি পায়। আর চান্দিনা উপজেলার আসনটি পরিচিত হয় কুমিল্লা-৭ নামে।
এদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ টিটু সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে দলের বিভক্তি সৃষ্টির অভিযোগ আনেন। তার দাবি, এ কারণে বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ও জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের মনোনীত ও সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, “সংসদ সদস্যের অনুসারীরা আমার বাবা প্রয়াত সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে বক্তব্য দিয়ে দলের মধ্যে বিরোধ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন। তাদের মামলা-হামলার ভয়ে সহস্রাধিক নেতাকর্মী ভয়ে বিদেশ চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি দলের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি করেছেন।”
তবে এ ধরনের অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ দাবি করে অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, “আমি সংসদ সদস্য হয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ নেই। তাদের এসব কথা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমি চান্দিনায় আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করতে কাজ করছি।”
দুই বলয়ের এই বিরোধের মধ্যেই সম্প্রতি সংসদ সদস্য প্রাণ গোপাল দত্তের বক্তব্যের একটি ভিডিও ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছে। যেটিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারে তৎপর হতে দেখা গেছে মুনতাকিম আশরাফ টিটু সমর্থকদের।
ওই ভিডিওর একটি অংশে সংসদ সদস্যকে বলতে শোনা যায়, চান্দিনা পৌরসভার সাবেক মেয়র মফিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছিল, সেটি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চান্দিনায় ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন শেষে গত ৪ জানুয়ারি বিকেলে উপজেলা সদরে সাবেক পৌর মেয়র মফিজুল ইসলামের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে যান প্রাণ গোপাল দত্ত। এ সময় তার সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, সেখানে এক আওয়ামী লীগ নেতা প্রাণ গোপালকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনি মেয়র সাহেবকে (মফিজুল ইসলাম) ওপেন করতে পারেন না?”
জবাবে সংসদ সদস্য বলেন, “এখানে ওপেন-ক্লোজ বড় কথা না, বড় কথা হচ্ছে, আমি বলতে পারি আমার দ্বারা তার কোনো ক্ষতি হবে না, বরং আরও অনেক উপকার করে ফেলেছি।”
সাবেক মেয়রের বিরুদ্ধে এডিবির কাজের অনিয়ম নিয়ে দুদকে অভিযোগের প্রসঙ্গে টেনে প্রাণ গোপাল বলেন, “এডিবির কাজের বিষয়ে তদন্ত গিয়েছিল, বহু লোকে লিখছে, তোমার (মফিজুল ইসলাম) ঘরের লোক লিখছে, সেই জিনিসপত্র (অভিযোগ) ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে।”
সংসদ সদস্যের এ ধরনের বক্তব্য ‘আওয়ামী লীগেরই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে’ বলে অভিযোগ করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ টিটু।
বিষয়টি নিয়ে সাবেক মেয়র মফিজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “দাদা (সংসদ সদস্য) যখন কথা বলেন অনেকেই ভিডিও করেছেন। আমরা তো বাধা দিতে পারিনি। রাজনৈতিক বিরোধে কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ করেছিল। দাদা এ বিষয়ে আমাকে সহযোগিতার কথা বলেছেন। এ কথাই পরে অনেকেই ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণ গোপাল দত্ত সাংবাদিকদের বলেন, “ওই ভিডিওটি এডিট করে এবং আমার কথা বিকৃত করে করা হয়েছে।”
এদিকে চান্দিনা উপজেলার আরেক শক্তিশালী প্রার্থী হচ্ছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ। তিনিও চান্দিনার তিনবারের সংসদ সদস্য। দুইবার স্বতন্ত্রভাবে এবং একবার বিএনপি থেকে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে রয়েছে এলডিপি; ফলে বিগত নির্বাচনে কুমিল্লা-৭ আসনে জোটের প্রার্থী ছিলেন রেদোয়ান আহমেদ।