Published : 26 Dec 2021, 04:09 PM
কারও কারও চোখে অতিরিক্ত ব্যবহারে এটি হয়ে উঠেছে ‘চোটের ফাঁদ।’ এবার ফেডারেশন কাপের উদ্বোধনী দিনে তো হয়ে গেল দেশের ফুটবলের জন্য বিব্রতকর ব্যাপার। টার্ফ নিয়ে আগেই আপত্তি তোলা বসুন্ধরা কিংস ও উত্তর বারিধারা মাঠেই আসেনি।
যে টার্ফ নিয়ে এত লঙ্কাকাণ্ড, সেটি নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায়ের অনেক খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তা তুলে ধরলেন নেতিবাচক-ইতিবাচক নানা দিক।
ঝড়-ঝঞ্ঝা-বৃষ্টির মতো প্রতিকূল আবহাওয়ায় ফুটবলকে নিয়মিত মাঠে রাখার লক্ষে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে কমলাপুরে বসেছিল ফিফার দেওয়া এই অ্যাস্ট্রো টার্ফ। কিন্তু শুরুতেই বাঁধে বিপত্তি। খেলোয়াড়, কোচদের অভিযোগে জেরবার বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) দারস্থ হয়েছিল ফিফার। পরে সংস্কার ও ছয় ধাপের পরীক্ষা করে এই টার্ফকে খেলার উপযোগী বলে ‘সার্টিফিকেট’ দেয় বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
সেসময়ই আবহাওয়া,পরিবেশ ও তাপমাত্রাভেদে টার্ফ রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছিল ফিফা। প্রতিদিন ৩-৪ ঘণ্টা ব্যবহারের সীমাও বেঁধে দিয়েছিল তারা। কিন্তু দেশের ফুটবলের মাঠের স্বল্পতায় ব্যবহারের সীমা ছাড়িয়েছে সীমাহীনভাবে। সর্বোচ্চ ১০ বছরের আয়ুষ্কাল তাই আগেভাগেই ফুরানোর পথে।
পাইওনিয়ার, তৃতীয়-দ্বিতীয়-প্রথম বিভাগ ফুটবল, চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ (বিসিএল), মেয়েদের নানা আন্তর্জাতিক ইভেন্টগুলো ও অনেক দলের অনুশীলন তো আছেই, এমনকি স্থানীয়রাও হরহামেশা ব্যবহার করেন এই টার্ফ। যেন গড়ের মাঠ!
অযত্ন আর অতিরিক্ত ব্যবহারের ধকল সইতে না পেরে টার্ফের কোথাও কোথাও উঠেছে ফুলে, সংস্কার করেও ফেরেনি আগের মান। কৃত্রিম ঘাসগুলো নেতিয়ে পড়ায় সবুজাভ চেহারা বদলে পেয়েছে মরুভূমির ধূসর রূপ।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সংস্কার চলায় এবার এ মাঠেই হয়েছে স্বাধীনতা কাপ। যে আসরে বসুন্ধরা কিংসের তপু বর্মন, কাজী তারিক রায়হান, জোনাথন ফের্নান্দেস চোট পেয়ে খেলতে পারেননি ফাইনাল। টার্ফে পিছলে ছুঁলে গেছে অনেকের হাত-পা।
তারপরও ফেডারেশন কাপের জন্য বাফুফে বেছে নিয়েছে কমলাপুর স্টেডিয়ামই।
ভুক্তভোগীদের কথা
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে টার্ফ নিয়ে মুখ খোলেননি বসু্ন্ধরা কিংস কোচ অস্কার ব্রুসন। হয়তো পরিস্থিতির উত্তাপে কুলুপ এঁটেছেন মুখে। তবে ক্লাবের সিদ্ধান্তে নিজের চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন যে পড়েছে, তা ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
উত্তর বারিধারার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের এন্তার অভিযোগ টার্ফ নিয়ে।
“আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি, দল গুছিয়েছি প্রিমিয়ার লিগে খেলার জন্য। লিগ ঘাসের মাঠে হবে। কিন্তু টার্ফে যেভাবে আমাদের খেলোয়াড়রা চোট পাচ্ছে, তাহলে দেখা যাবে ফেডারেশন কাপের পর লিগে খেলার জন্য আমরা খেলোয়াড়ই পাব না।”
“আমি সবসময় মনে করি, ইনজুরি প্রতিরোধের জন্য টার্ফের চেয়ে ঘাসের মাঠে খেলা সবসময় ভালো। টার্ফে চোট পেলে সেটি রিকভারের জন্য বেশি সময় লাগে। তবে ইনজুরি যে কোনো মাঠেই হতে পারে এবং বাফুফের বর্তমান পরিস্থিতিও বুঝতে পারছি। তাদের কাছে এ মুহূর্তে বিকল্প নেই।”
“এই ছেলেরা কিন্তু টার্ফে অভ্যস্ত নয়। আমাদের কেউই আর্টিফিশিয়াল মাঠে অনুশীলন করে না। অন্য দলগুলোও করে না। যেহেতু টার্ফ ঘাসের মাঠের তুলনায় শক্ত, ভারী এবং ঘাসের মাঠের তুলনায় বাউন্স কম, এখানে হাঁটু, কনুইয়ে চোট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং রিকভারির জন্য অনেকক্ষেত্রে বেশি সময় লাগে।”
ঘাসের মাঠ বনাম টার্ফ নিয়ে আলাপচারিতায় জাতীয় দলের সাবেক কোচ জেমি ডে, ও সাবেক সহকারী কোচ স্টুয়ার্ট ওয়াটকিস তুলে ধরেন ইতিবাচক-নেতিবাচক, দুটি দিকই।
সব আবহাওয়ায় খেলার সুবিধা এবং মানিয়ে নিতে পারলে টার্ফ খেলোয়াড়দের জন্য ভালো উল্লেখ করলেও ইংলিশ কোচ জেমি ডে বলেন চোট শঙ্কার কথা।
“ঘাসের মাঠ ও টার্ফে বলের ঘোরা ও বাউন্স সম্পূর্ণ ভিন্নরকমের। অ্যাস্ট্রো টার্ফে নিচে কংক্রিটের স্তর থাকায় দীর্ঘমেয়াদে এটা খেলোয়াড়দের হাঁটু ও গোড়ালির জন্য ভালো নয়।”
ওয়াটকিসের চোখে আধুনিক ‘ফোর-জি’ টার্ফ তুলনামূলকভাবে ভালো। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতে কাজ করার অভিজ্ঞতার উদাহরণ টেনে এই সাবেক ইংলিশ ডিফেন্ডারও দেখালেন ঝুঁকির দিকটি।
“দীর্ঘদিন ধরে অ্যাস্ট্রো টার্ফে খেললে হাড়ের সংযোগস্থলে টান পড়ে। সাধারণত টার্ফ শক্ত হয়। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, টার্ফে খেলার কারণে ভারতে অনেক খেলোয়াড়ের হাঁটু ও গোড়ালিতে সার্জারির দরকার পড়েছিল।”
ডে ও ওয়াটকিসের কথার সঙ্গে মিলে যায় একাধিক খেলোয়াড়ের কমলাপুরের টার্ফে খেলার অভিজ্ঞতা। যাদের অনেকে কাতার, বাহরাইন, তাজিকস্তান ও ভুটানের টার্ফেও খেলেছেন। বিশেষ করে কাতার ও বাহরাইনের টার্ফের সঙ্গে কমলাপুরের টার্ফের ব্যবধান তাদের কাছে পরিষ্কার।
২০১৫-১৬ মৌসুমের পাইওনিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং বর্তমানে বসুন্ধরা কিংসের তরুণ ফরোয়ার্ড রিমন হোসেন যেমন জানালেন নিজের ভোগান্তির কথা।
“কমলাপুরের টার্ফে পাইওনিয়ার ও তৃতীয় বিভাগ খেলেছি। টার্ফের জায়গায়-জায়গায় উঠে গেছে। পেশির বারোটা বেজে যায়। দৌড়াতে গেলে কাফ মাসলে বেশি চাপ পড়ে। ৯০ মিনিট খেলা খুবই কঠিন। দুপুরে খেলার সময় বুটের ভেতরটা এত গরম হয়ে যায় যে, একটু পর পর বুটের ভেতর পানি দিতে হতো আমাদের।”
২০১৫-১৬ মৌসুমে অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং বর্তমানে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলা তরুণ মিডফিল্ডার আমির হাকিম বাপ্পীর মতে, পেশির ওপর অনেক ধকল যায় টার্ফে।
“প্রচুর শক্তি লাগে। ঘাসের মাঠে থাই, কাফ মাসলগুলো ধরে যায় না, কিন্তু টার্ফে কষে আসে। বল যখন পায়ে থাকে, তখন তেমন কিছু মনে হয় না। কিন্তু বল ছাড়া দৌড়াতে গেলে কষ্ট হয়। পেশিতে ব্যথা হয়। জ্যাম হয়ে যায়। এখন বুঝতে পারি, পেশির ওপর কী পরিমাণ চাপ দিয়েছি।”
কমলাপুরের টার্ফ মূলত ‘ভয়ঙ্কর’ হয়ে ওঠে দুপুরের দিকে। ঘাসের মাঠের চেয়ে টার্ফের তাপ শোষণক্ষমতা কম বলে পায়ে ফোসকা পড়ে যায় বলে জানালেন ২০১৭ সালের সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপে সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং গত মৌসুমে সাইফ স্পোর্টিংয়ে খেলা ফরোয়ার্ড জাফর ইকবাল।
“তৃতীয় বিভাগে টার্ফে খেলেছি। যে খেলাগুলো ১২টা বা ২টার দিকে হয়, ওই সময় খেলা খুবই কঠিন। সূর্যের তাপ, নিচের তাপ মিলে এমন পরিস্থিতি হয় যে, মাঝেমধ্যে বুটের ভেতরে পায়েও ফোসকা পড়ে যেত।”
বাধাহীনভাবে খেলা চালাতে পারার সুবিধা মিলছে টার্ফ থেকে। তবে ইতিবাচক দিক উল্লেখ করলেও পাইওনিয়ার থেকে বিসিএল-এই পাঁচ ধাপের একাধিক কোচ শোনালেন টার্ফ নিয়ে নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা।
রেজাউল হক জামাল জানালেন ‘বুট ডিসপ্লেস হয়ে যাওয়ায় গোড়ালির চোট বেশি’ হওয়ার শঙ্কা। শহীদুল ইসলামের মতে, অতিরিক্ত ব্যবহারে এর মান ঠেকেছে ‘তলানিতে’। অসহনীয় গরমে খেলোয়াড়দের পায়ে ফোসকা পড়ার কথা জানালেন কোচ মনোয়ার হোসেন ময়না।
২০১৯ সালে বিবিসির ছাপানো প্রতিবেদনেও উঠে আসে টার্ফ নিয়ে কোচদের নানা সমালোচনা। টার্ফ ‘অভিজাত ফুটবলের অন্তর্ভুক্ত নয়’ বলে মন্তব্য করেন রেঞ্জার্সের সেসময়কার কোচ স্টিভেন জেরার্ড। টার্ফে এখনও ‘ভালো ম্যাচ’ না দেখার কথা বলেন লিভারপুলের সাবেক কোচ ব্রেন্ডন রজার্স। স্কটল্যান্ডে টার্ফ তুলে নেওয়ার জন্য ‘পিটিশন’ হওয়ার কথাও এসেছিল ওই প্রতিবেদনে। অবশ্য কোনো কোনো কোচের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কথাও ছিল প্রতিবেদনটিতে।
যা কিছু ইতিবাচক
ঘরোয়া লিগের কোচ সাইফুল বারী টিটু ও জুলফিকার আহমেদ মিন্টু এবং জাতীয় মহিলা দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন অবশ্য দেশের বাস্তবতায় ইতিবাচক দিকই বেশি দেখছেন। খেলোয়াড়দের প্রতি টিটুর পরামর্শ টার্ফে খেলার জন্য ফিটনেস বাড়ানোর প্রতি। আবাহনীর সাবেক কোচ মিন্টু ‘টার্ফ টার্ফই’ উল্লেখ করে বললেন প্রতিকূল আবহাওয়ায় নিয়মিত অনুশীলন এবং খেলা চালিয়ে যাওয়ার সুবিধার কথা।
“টার্ফে শতভাগ ফিটনেস নিয়ে না নামলে ইনজুরি হবেই। মেয়েরা সারাবছর অনুশীলন করে, তাদের পেশি তৈরি আছে। ফলে এখানে অনুশীলন করা বা খেলাতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না।”
“অনুশীলন হয় লো ইনটেনসিটির কিন্তু ম্যাচ হয় হাই ইনটেনসিটির। দুইটা তো আর এক নয়। প্রস্তুতি ঠিকঠাক না থাকলে, ফিজিক্যাল কন্ডিশনিং, ট্রেনিং ঠিকমতো না নিয়ে টার্ফে খেলতে নামলে পেশি সমর্থন করবে না। চোট হবেই।”
সাধারণত তুষারপাত হয় কিংবা পাহাড়ী অঞ্চল, অতিবৃষ্টির দেশগুলোর জন্য টার্ফ বেশি কার্যকরী। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-বিকেএসপিতে টার্ফ বসানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত জাতীয় ফুটবল ও হকি দলের সাবেক খেলোয়াড় কাওসার আলির মতে, মাঠের স্বল্পতা আর বৃষ্টি ছাড়া আর কোনো বিপত্তি নেই এদেশে। টার্ফ সমতল হওয়ায় বলের নিয়ন্ত্রণ, গতির ভারসাম্য-এসব সুবিধার কথা জানালেন তিনি। ঘাসের চেয়ে টার্ফ ‘ভারী’ হয় উল্লেখ করে ‘পেশি ও হাড়ের’ দৃঢ়তার দিকে খেলোয়াড়দের জোর দেওয়া এবং টার্ফে নিয়মিত পানি দেওয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পরামর্শও দিলেন।
বাফুফে যা বলছে
বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ ফিফার কথাতেই আস্থা রাখছেন। চোটের অভিযোগের অনেকটুকুও তিনি উড়িয়ে দিলেন। তবে অতি ব্যবহারে কমলাপুর এবং বাফুফে ভবন সংলগ্ন টার্ফের মেয়াদ কমে যাওয়ার কথা তিনিও মানছেন ।
“ফিফা আমাদেরকে সেসময়ই বলেছিল, টার্ফ নিয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে। এখানে খেললে গোড়ালি-হাঁটুর চোট হয়, শক্তি ব্যয় হয়, কিন্তু এগুলো বিজ্ঞানসম্মত কথা নয়। ঘাসের মাঠের মতো একই দম লাগে এখানে।”
“ফিফা এটাও বলে দিয়েছিল, প্রতিদিন তিন-চার ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করতে পারবে না। নানা বাস্তবতায় আমরা তা মানতে পারিনি। অনেক সময় এক দিনে পাঁচ-ছয়টা ম্যাচও হয়। কমলাপুরের এখন যে অবস্থা, ২০২৪-২৫ পর্যন্ত এটা চলবে না নিশ্চিতভাবেই। ভবনের পাশের টার্ফটা বদলাতে হবে দ্রুত। সে চেষ্টা চলছেও।”
ঘাসের মাঠে টানা ম্যাচ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বৃষ্টি-বাদলের ছোবল তো আছেই। এসব কারণে কৃত্রিম মাঠে আশ্রয় খোঁজার কথা জানালেন সোহাগ।
“ঘাসের মাঠে দুটির পর তিনটি ম্যাচ খেলা যায় না। বৃষ্টির মৌসুমেও অনেক সময় খেলা বাতিল করতে হতো। টার্ফে এটা করতে হয় না। কমলাপুরে এমনও দিন গেছে, পাঁচ-ছয়টা ম্যাচ হয়েছে। হাইলি ইউজড মাঠ। আসলে এত খেলা বডিলি শিফট করা যায় না। মাঠ স্বল্পতার কারণে আসলে আমরা টার্ফ নির্ভরই হতে চেয়েছি।”
কিন্তু সেসব বাস্তবতা মানার পরও প্রশ্নটা থাকছেই, এই বিকল্পকে আঁকড়ে ধরা কি ঝুঁকিতে ফেলছে না ফুটবলারদের? মানসম্পন্ন টার্ফ নিয়েই ফিফার রায়-‘ঘাসের মাঠের সেরা বিকল্প’, কমলাপুরের টার্ফ তো সেখানে মান হারিয়েছে সেই কবেই! বিকল্প পথ তাই ফুটবলের জন্য হয়ে উঠেছে যেন বিপদের পথ!