Published : 11 Dec 2022, 12:09 PM
কিলিয়ান এমবাপের গোল পাঁচটি, লিওনেল মেসির চারটি। কাতার বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুটের দৌড়ে প্রবলভাবে আলোচনায় যেন এই দুই জনই। সেভাবে কেউই বলছেন না অলিভিয়ে জিরুদের কথা। তিনিও তো করেছেন চারটি গোল। এসব নিয়ে হয়তো খুব একটা ভাবছেন না ফরাসি এই স্ট্র্রাইকার। নিয়তিই তো তাকে ‘দ্বিতীয়’ করে রেখেছে সেই শৈশব থেকে আজ অবদি!
কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মহারণে ২-১ গোলে জিতেছে ফ্রান্স। অহেলিয়া চুয়েমেনি দূরপাল্লার শটে শিরোপাধারীদের এগিয়ে নেওয়ার পর হ্যারি কেইনের সফল স্পট কিকে সমতায় ফিরে ইংলিশরা। ৭৮তম মিনিটে দারুণ হেডে ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেন জিরুদ।
রোমাঞ্চে ঠাসা ম্যাচ জিতে ফ্রান্সও আছে মুকুট ধরে রাখার পথে। কিন্তু জিরুদ যেন মুকুটহীন রাজার মতো পাদপ্রদীপের আলোর বাইরে থাকাদের দলে। আড়ালে থেকে যিনি রাজ দায়িত্ব অনুক্ষণ পালন করে যান নীরবে, নিভৃতে।
এই কাতার বিশ্বকাপ মাঠে গড়ানোর আগে করিম বেনজেমার ছিটকে যাওয়া নিয়ে গণমাধ্যমে যত প্রতিবেদন, এমবাপের মহাতারকা হয়ে ওঠার পথে সম্ভাব্য যাত্রা শুরু কিংবা চুয়েমেনির উদীয়মান তারকা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে যত আলোচনা, তার ছিটেফোঁটাও জিরুদকে নিয়ে হয়নি। কেউ বলেননি, বেনজেমা নেই, জিরুদ তো আছে।
কিংবা তার বয়সের কথা ধরুন; ৩৬ বছর। ৩৫ বছর বয়সী মেসি, ৩৭ বছর বয়সী ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর এটাই শেষ বিশ্বকাপ কিনা, তা নিয়ে আলোচনার নহর বয়ে গেছে, কিন্তু বয়সের পাল্লায় এই দুই জনের মাঝে থাকা জিরুদকে নিয়ে আলাপন কতটুকু? অথচ সেই গ্রুপ পর্ব থেকে আলো ছড়িয়ে চলেছেন তিনি।
গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪-১ ব্যবধানের জয়ে জোড়া গোল জিরুদের। শেষ ষোলোয় পোল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-১ জয়ে ফ্রান্সকে এগিয়ে নেওয়ার গোলটিও তার। সবশেষ ১৯৬৬ সালের পর আরেকটি বিশ্বকাপের জন্য ক্ষুধার্ত থাকা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে জয়সূচক গোলটিও তার নিখুঁত হেডের ফল। তারপরও তিনি শিরোনাহীন! আসলে শৈশব থেকেই ‘পাত্তা’ না পাওয়াদের দলে জিরুদ!
হাটিহাটি পা-পা বয়স থেকে বড় ভাই রোমাঁ জিরুদের ন্যাওটা ছিলেন। কিন্তু বয়সের ব্যবধান ১০ বছর বলেই হয়ত বড় ভাইয়ের কাছে পাত্তা পাননি। উল্টো বড় ভাইটি তার জীবন অতিষ্ঠ করে দিতেন নানা ভয় দেখিয়ে। ছোট্ট অলিভিয়ে ভয় পেয়ে কুঁকড়ে যেতেন, কিন্তু বল পায়ে পেলে ভুলে যেতেন সবকিছু, ফিরে পেতেন রাজ্যের খুশি।
আলফ নামের এক কার্টুন চরিত্রের কিম্ভূতাকৃতির মুখের উদাহরণ দিয়ে অলিভিয়েকে ভয় দেখাতেন রোমাঁ। ফরাসি ফরোয়ার্ড অনেক পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আলফের ওই ঘটনা অনেকদূর গড়িয়েছিল, প্রভাব ফেলেছিল তার মনোজগতে। আরেকটি বিষয়ও ছাপ ফেলেছিল তার মনে, সেটি ফুটবল ক্যারিয়ারে বড় ভাইয়ের ব্যর্থতা এবং পরে পুষ্টিবিদ হয়ে যাওয়া।
ফুটবলার হিসেবেও তার চলার পথটা ছিল না মসৃণ। গ্রেনঁবের হয়ে সিনিয়ার ক্যারিয়ার শুরুর সময় যখন তাকে তৃতীয় সারির দল ইস্ত্রেসে ধারে পাঠানো হয়, তখন বলে দেওয়া হয় ‘এলিটদের’ সঙ্গে খেলার মতো মান নেই তার। তা মেনেও নেন জিরুদ এবং এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “নিচের দিকের লিগে খেলার ঝুঁকি আমাকে বাধ্য হয়ে নিতে হয়েছিল, কিন্তু আমি কখনই হাল ছাড়িনি।”
ওই দুঃখকে শক্তিতে রূপ দিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিলেন জিরুদ। ২০০৮ সালে যোগ দেন তোরসে এবং দলটির হয়ে দ্বিতীয় মৌসুমে ২১ গোলের আলো ছড়িয়ে চোখে পড়েন মঁপেলিয়ের। এরপর আরেক দফা ‘ধার’-এর জীবন কাটিয়ে ২০১২ সালে নোঙর ফেলেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল আর্সেনালে। স্কোরিং সামর্থ্য, ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি লম্বা গড়নের কারণে হেডের দক্ষতা দিয়ে গানার সমর্থকদের মন জয় করে নেন। এরপর প্রিমিয়ার লিগের আরেক দল চেলসিতে বছর তিনেক কাটিয়ে বর্তমানে খেলছেন সেরি আয়, এসি মিলানের হয়ে।
২০১১ সালে ফ্রান্সের হয়ে অভিষিক্ত হওয়ার পর থেকে আক্রমণভাগে নিজের সামর্থ্যের ছাপ রেখে চলেছেন প্রতিনিয়ত। এই বিশ্বকাপেই তিনি থিয়েরি অঁরিকে (৫১টি) পেছনে ফেলে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ গোলদাতার কীর্তি গড়েন। ইংল্যান্ড ম্যাচে গোলের সংখ্যা নিয়ে গেলেন ৫৩তে। ফ্রান্স সেমি-ফাইনালে ওঠায় জিরুদের সামনেও সুযোগ আছে আরও গোল করার। কিন্তু কে জানে, তাতেও মেসি-এমবাপেদের মতো তার শিরোনামে আসা হবে কিনা!