Published : 24 Jun 2025, 02:04 AM
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান গত কয়েক দশক ধরে সচেতনভাবেই সরাসরি সামরিক লড়াই থেকে বিরত থেকেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বিপজ্জনক যুদ্ধের চোরাবালিতে যুক্তরাষ্ট্র ডুবে যেতে পারে–এই ভয়ে একের পর এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানে নিজেদের সামরিক শক্তি জাহির করা থেকে বিরত রেখেছেন।
কিন্তু নিজেকে ‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ দাবি করা ডনাল্ড ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে সেই বিপজ্জনক যুদ্ধের পথেই পা বাড়ালেন।
বিবিসির এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদন বলছে, ইরানে মার্কিন হামলা ছিল একটি নজিরবিহীন মুহূর্ত, যা পুরো বিশ্বে একটা সতর্ক ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে।
তবে ইরানের পরবর্তী পদক্ষেপ সেই অকল্পনীয় লগ্নকেও ছাপিয়ে যেতে পারে। দেশটির ৮৬ বছর বয়সী সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি তার দেশকে রক্ষায় প্রায় চার দশক ধরে খুব সাবধানের সঙ্গেই সবচেয়ে শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে আসছেন।
কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, এখন যদি তিনি শত্রুকে ‘নরম’ জবাব দেন, তাহলে ভাবমূর্তি হারাবেন; আবার যদি ‘বেশি কিছু’ করে ফেলেন, তাহলে সবই হারাতে পারেন।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘চ্যাথাম হাউসের’ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক কর্মসূচির পরিচালক সনম ভাকিল বলেন, “খামেনির পরবর্তী পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা কেবল তার নিজের টিকে থাকার জন্য নয়; ইতিহাসে তার নাম কীভাবে লেখা থাকবে, সেটাও তার পরবর্তী সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।“
১৯৮৮ সালে ইরান ও ইরাকের ভয়াবহ যুদ্ধের সময় শান্তিচুক্তি মেনে নেওয়ায় অনীহা ছিল খামেনির।
তার সেই মনোভাবের দিকে ইঙ্গিত করে ভাকিল বলেন, “১৯৮৮ সালে তার পান করার পাত্র যতটা বিষাক্ত ছিল, এখন সেটা সম্ভবত আরও বিষাক্ত।”
‘এমন যুদ্ধ ইরানের প্রত্যাশিত নয়’
বিবিসি বলছে, গত দশ দিনে ইসরায়েলের তীব্র হামলায় ইরানের সামরিক বাহিনীর চেইন অব কমান্ড এবং সামরিক সরঞ্জামের যতটা ক্ষতি হয়েছে, তা ইরাকের সঙ্গে আট বছরের যুদ্ধেও হয়নি।
ইসরায়েলি হামলায় ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে মার্কিন হামলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর গড়ে ওঠা ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, তারা এমন প্রতিশোধ নেবে, যা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আজীবন অনুশোচনায়’ ভোগাবে।
তবে এ ধরনের কঠোর বাকযুদ্ধের আড়ালে বিপর্যয়কর ভুল সিদ্ধান্ত এড়ানোর জটিল ও কৌশলগত নানা হিসাব চলছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
কাতারভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের’ হামিদরেজা আজিজ মনে করেন, “এমন যুদ্ধ ইরানের প্রত্যাশায় ছিল না।
“খামেনির সমর্থকদের একটা অংশ হয়ত বলছেন, শক্তিশালী দেশ ও আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ইরানের একটা ভাবমূর্তি রয়েছে। মার্কিন ও ইসরায়েলি হামলা সেই ভাবমূর্তি নাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে কঠোর জবাব দেওয়াটা জরুরি।"
কিন্তু যেকোনো জবাবই ঝুঁকিপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে ২০টি ঘাঁটি রয়েছে, সেগুলোয় হামলা হলে ওয়াশিংটন বড় ধরনের প্রতিশোধ নিতে পারে।
ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়, সেটার ফলও তাদের জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। বিশ্বের ২০ শতাংশ জ্বালানি তেল সরবরাহের পথটি বন্ধ হয়ে গেলে ইরানের আরব মিত্রদের পাশাপাশি চীনও নাখোশ হতে পারে, যারা তেহরানের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। ইরানের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারে পশ্চিমা দেশগুলোর নৌবাহিনীও।
আবার মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের যেসব অনুগত বাহিনী রয়েছে, তারাও ক্রমাগত ইসরায়েলি হামলায় দুর্বল কিংবা নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে।
ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে রাগাবে না–জবাব দেওয়ার এমন উপায় ইরানের হাতে আছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়।
এমন হিসাবে ইরান আগেও পড়েছে। সবশেষ পাঁচ বছর আগে যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাগদাদে ড্রোন হামলায় আইআরজিসির কমান্ডার কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। ওই সময় অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, সোলেমানিকে হত্যার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে চরম অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
তবে সেসময় দেখা গেল, ইরান পাল্টা হামলার বিষয়টি আগেই ইরাক সরকারকে জানিয়ে দিল। তারা মার্কিন ঘাঁটির এমন অংশে হামলা চালাল, যেখানে কোনো হতাহত কিংবা বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
যদিও তখনকার প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপটের মধ্যে বিস্তর ফারাক। এরই মধ্যে কাতার ও ইরাকে মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইরান।
‘কূটনীতি ধ্বংস করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইরান নয়’
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একাধিকবার বলেছেন, তিনি ইরানের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে চান; দেশটিকে ‘বোমা মেরে’ ধ্বংস করতে চান না।
কিন্তু সেই ট্রাম্প এখন ইসরায়েলের সুরেই কথা বলছেন। তিনি ইরানকে এখন ডাকছেন ‘মধ্যপ্রাচ্যের গুন্ডা’ নামে। সঙ্গে বলছেন, তারা পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজ করছে। যদিও তার এ অভিযোগ মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
পেন্টাগনের ভাষ্য, শনিবার রাতে তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে যে হামলা চালিয়েছে, সেটা ছিল মার্কিন ইতিহাসে ‘বি-টু’ বোমারু বিমানের ‘সবচেয়ে বড়’ অভিযান।
তাদের সেই ‘বড়’ হামলা কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে, সেই বিশ্লেষণ এরই মধ্যে মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শুরু করে দিয়েছে।
হামলার পর এখন এসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানকে ‘শান্তির পথে’ আসার আহ্বান জানাচ্ছেন।
কিন্তু ইরান এখন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রস্তাবকেও আত্মসমর্পণের প্রস্তাব হিসেবে দেখছে।
তেহরান মনে করছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, সেটা ছিল একটা প্রতারণা।
যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, মাস্কাটে ষষ্ঠ দফার আলোচনার ঠিক দুই দিন আগে (১৩ জুন) ইসরায়েল তাদের সামরিক অভিযান শুরু করে। অন্যদিকে সিদ্ধান্তের জন্য দুই সপ্তাহ সময় নিয়ে দুই দিনের মাথায় ইরানে হামলা করে বসেন ট্রাম্প।
এখন ইরান বলছে, যতক্ষণ ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র বোমা হামলা অব্যাহত রাখবে, ততক্ষণ তারা আলোচনার টেবিলে ফিরবে না।
সম্প্রতি তেহরানে এক সংবাদ সম্মেলনে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, “কূটনীতি ধ্বংস করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইরান নয়।”
ইরান বলছে, তাদের ভূখণ্ডে যেসব হামলা হয়েছে, তা জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন। তারা পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোকে আইএইএর নির্দেশনার পরিপন্থি বলেও দাবি করেছে।
আইএইএর নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘যেকোনো পরিস্থিতিতে’ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো যাবে না।
এদিকে ইউরোপের নেতারা অবিলম্বে উত্তেজনা দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তারা বলছেন, পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ে কূটনৈতিক মধ্যস্থতায় সমাধান আসুক; ‘ক্ষেপণাস্ত্রের’ মধ্য দিয়ে নয়।
ইউরোপের নেতারা মনে করেন, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সুযোগ দেওয়া যাবে না। তারা তেহরানের ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করার পদক্ষেপকে ভালো চোখে দেখছেন না।
ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির উপপ্রধান এলি গেরানমায়েহ বলছেন, "ইরান সম্ভবত তাদের স্থাপনাগুলোর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দেখাবে। বলবে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নজিরবিহীন হামলার মধ্যেও টিকে আছে।
"অন্যদিকে ট্রাম্প হয়ত চাইবেন ক্ষয়ক্ষতি অতিরঞ্জিত করে দেখাতে, যেন তিনি নিজেকে বিজয়ী দাবি করতে পারেন এবং আর যেন হামলার দিকে তাকে না যেতে হয়।"
বিবিসি তাদের বিশ্লেষণে বলছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর প্রভাবও ট্রাম্প এড়াতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে যেটা ঘটবে, ইরানে ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত থাকবে। আর হামলা হলে পাল্টা হামলা তো থাকবেই।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওপর অভ্যন্তরীণ চাপও আছে। আইনপ্রণেতারা বলছেন, তিনি কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ থেকে দূরে রাখার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
এ মুহূর্তে হয়ত তেহরানের মাথায় এটাই ঘুরপাক খাচ্ছে যে তারা কোন পথে গেলে হামলার শিকার না হয়ে প্রতিরোধ সক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
গেরানমায়েহ সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, “হিতে বিপরীত হতে পারে। ট্রাম্প ইরান থেকে পারমাণবিক হুমকি দূর করতে চেয়েছিলেন।
“কিন্তু এখন তিনি এমন প্রেক্ষাপট তৈরি করলেন, যেখানে ইরানের পারমাণবিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেল।”
আরও পড়ুন
কাতারে মার্কিন নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলল যুক্তরাষ্ট্র
ইরান ও ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি
ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলা
ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ১৩ শিশু নিহত: ইরানি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়
ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের কোনো ভিত্তি নেই: পুতিন
মার্কিন হামলার পর পুতিনের 'আরও সক্রিয় ভূমিকা চাইছেন' ইরানের খামেনি
'জুয়াড়ি' ট্রাম্পকে কড়া হুঁশিয়ারি ইরানের, 'যুদ্ধের ইতি আমরাই টানব'