Published : 08 Dec 2024, 12:55 PM
পনের দিনেরও কম সময়- এর মধ্যেই বিস্ময়করভাবেই দৃশ্যপটে সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনী। একে একে চারটি মূল শহর দখলের পর অনেকটা বিনাযুদ্ধেই রাজধানী দামেস্কের দখল নিয়েছে তারা। বিদ্রোহী বাহিনীর অগ্রগতির মধ্যেই দেশ ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে গেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ।
এর মধ্যে দিয়ে আসাদ পরিবারের দীর্ঘদিনের লৌহকঠিন শাসনের অবসান ঘটল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনী নভেম্বরের শেষ দিকে উত্তরাঞ্চলীয় শহর আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ নেয়, এরপর একে একে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হামা ও হোম বি্রেদাহীদের কব্জায় চলে আসে। তিনটি শহরই সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল।
অন্যদিকে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে জর্ডান সীমান্তের কাছে স্থানীয় বিদ্রোহীরা দেরা অঞ্চলের দখল নেয়। আসাদবিরোধী বিদ্রোহের জন্ম হয়েছিল এই অঞ্চল থেকেই।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, বিদ্রোহীদের অভিযানের মুখে বেশিরভাগ স্থানেই সরকারি বাহিনী তাদের অবস্থান ছেড়ে চলে গেছে নয়ত বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
বিদ্রোহীদের নতুন এই অভিযানের প্রাথমিক নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামি জঙ্গি সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস), যাদের সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে লড়াই করার লম্বা ইতিহাস রয়েছে।
এইচটিএসকে এর আগে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছিল জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক এবং আরো কয়েকটি দেশ।
হায়াত তাহরির আল-শাম কারা?
এইচটিএসের জন্ম ২০১১ সালে, জাবহাত আল-নুসরা নামে, যাদের সরাসরি সংযোগ ছিল আল কায়েদার সঙ্গে।
জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) স্বঘোষিত নেতা আবু বকর আল-বাগদাদি জড়িত ছিলেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠায়।
বাশাল আল-আসাদ বিরোধী সংঘাতে জাবহাত আল-নুসরাকে সবচেয়ে কার্যকর এবং ভয়ঙ্কর সংগঠন হিসেবে মনে করা হয়।
কিন্তু একটা সময় বিপ্লবী ভূমিকার চেয়ে এর জিহাদী মতাদর্শে পরিচালিত হতে থাকে সংগঠনটি। আর এটিই পরে ‘ফ্রি সিরিয়া’ ব্যানারে থাকা বিদ্রোহীদের সঙ্গে মতবিরোধের কারণ হয়ে উঠে।
২০১৬ সালে সংয়গঠনটির নেতা আবু মোহামেদ আল-জাওলানি প্রকাশে আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন এবং জাবহাত আল-নুসরা বিলুপ্ত করেন। পরে তিনি নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন, যেটি এক বছর সমমনা আরো কয়েকটি বিদ্রোহী দলে সঙ্গে একীভূত হয়। বিদ্রোহীদের এই জোটই হায়াত তাহরির আল-শাম নামে পরিচিত।
এইচটিএস কিছুদিনের জন্য সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ইদলিবে ঘাঁটি গেড়ে কার্যত নিজেদের শাসন চালু করেছিল। কিন্তু সেখানে তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠায় সেই শাসনের আইনি বৈধতা নিয়ে পরে প্রশ্ন দেখা দেয়।
তাছাড়া ইদলিবে এই বিদ্রোহী জোটের অন্য কয়েকটি দলের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর অভিযোগও রয়েছে।
আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর থেকে এইচটিএসের এর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সিরিয়ায় বৃহত্তর খিলাফতের পরিবর্তে মৌলবাদী ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। আইএসও একই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।
সিরিয়ার সংঘাতকে বড় রূপ দেওয়া এবং দেশের বেশিরভাগ অংশে আসাদের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করার মতো উদ্যোগ খুব কমই নতে দেখা গেছে এইচটিএসকে।
কেন এই যুদ্ধ?
প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের শাসকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের অনুপ্রেরণায় সিরিয়ায়তেও গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনের সূত্রপাত ২০১১ সালে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দেরায়। সেই বিক্ষোভ দমনে সরকারি বাহিনী কঠোর শক্তিপ্রয়োগ করলে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবি ছড়িয়ে পরে দেশজুড়ে।
তারপরও হাল ছাড়েনি আসাদ বাহিনী। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি বাহিনীর দমনও বাড়তে থাকে।
প্রথম আত্মরক্ষার বাধ্য হয়েই অস্ত্র হাতে তুলে নেন বিরোধী সমর্থকরা। পরে তাদের লক্ষ্য হয় সরকারি বাহিনীর হাত থেকে নিজেদের এলাকা মুক্ত করা।
প্রেসিডেন্ট আসাদ বিদ্রোহীদেরকে ‘বিদেশি-সমর্থিত সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যায়িত করেছেন তাদের কঠোর হাতে দমনের অঙ্গীকার করেন।
ধীরে ধীরে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে শত শত বিদ্রোহী উপদল গড়ে ওঠে। বিভিন্ন বিদেশী শক্তিও এসব উপদলের পক্ষ নিতে শুরু করে এবং আইএস ও আল-কায়েদার মতো চরমপন্থী জিহাদি সংগঠনগুলো সিরিয়ার সংঘাতে জড়িত পড়ে।
ধীরে সহিংসতা বাড়তে থাকলে একটা পর্যায়ে পুরোপুরি গৃহযুদ্ধের মধ্যে ঢুকে যায় দেশটি, যা আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক মনোযোগের কারণে হয়ে দাঁড়া্য়।
অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে এবং ১২ মিলিয়ন তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন শরণার্থী বা বিদেশে আশ্রয়প্রার্থী।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে এ পর্যন্ত ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং এক কোটি ২০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে। গৃহযুদ্ধের কারণে সিরিয়ার ৫০ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছে।
কীভাবে আক্রমণে বিদ্রোহীরা?
গত চার বছর ধরে মনে করা হচ্ছিল, সিরিয়ার যুদ্ধ হয়ত শেষ হয়ে গেছে।
দেশটির কয়েকটি শহরে তখনও প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের শাসন ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বি। যদিও সিরিয়ার কিছু কিছু অংশে তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল না, যার মধ্যে অন্যতম ছিল পূর্বের কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো। সংঘাতের শুরু থেকেই এসব এলাকা কম-বেশি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরেই ছিল।
২০১১ সালে সিরিয়ার দক্ষিণে যেখানে আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লব শুরু হয়েছিল, সেখানে তুলনামূলকভাবে নিঃশব্দ অস্থিরতা ছিল।
সিরিয়ার বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে ইসলামিক স্টেট হিসেবে অভিহিত গোষ্ঠীগুলোর অবস্থানও নিরাপত্তার জন্য হুমকি ছিল।
উত্তর-পশ্চিমে, জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা ইদলিব প্রদেশেও যুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল। ইদলিবের প্রভাবশালী শক্তি এইচটিএসই আলেপ্পোতে আচমকা হামলা শুরু করে।
কয়েক বছর ধরেই ইদলিব পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় সিরিয়ার সরকারী বাহিনীর অন্যতম যুদ্ধক্ষেত্র ছিল এই ইদলিব।
কিন্তু ২০২০ সালে আসাদের মিত্র হিসেবে পরিচিত রাশিয়া এবং বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়ে আসা তুরস্কের মধ্যস্থতায় সেখানে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের দখল থেকে সেখানকার অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছিল আসাদ বাহিনী। কিন্তু যুদ্ধের কারণে ইদলিবের প্রায় ৪০ লাখ মানুষের বেশিরভাগই বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
সিরিয়ায় সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্র ছিল আলেপ্পো এবং এখানেই বি্রেদাহীরা সবচেয়ে বড় পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছিল।
কিন্তু যুদ্ধে বিজয়ের জন্য প্রেসিডেন্ট আসাদ নিজের দুর্বল সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে পারেননি। তিনি রাশিয়ার বিমান শক্তি এবং স্থলভাগে ইরানের সামরিক সাহায্য, বিশেষ করে হিজবুল্লাহর মতো তেহরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন।
ফলে শিগগিরই দুর্বল সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করাটা প্রেসিডেন্টের জন্য বিপদ ডেকে আনে এবং নিয়মিতভাবে সরকারি বাহিনী বিদ্রোহীদের আক্রমণের বিরুদ্ধে অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হতে থাকে।
সম্প্রতি লেবাননে ইসরায়েলের আক্রমণে হিজবুল্লাহর শক্তিক্ষয়, সিরিয়ায় ইরানের সামরিক কমান্ডারদের ওপর ইসরায়েলি হামলা যে ইদলিবের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে আলেপ্পোতে আকস্মিক হামলা চালাতে উৎসাহ জুগিয়েছে, তাতে খুব একটা সন্দেহ নেই।
গত কয়েক মাসে ইসরায়েল ইরান সমর্থিত সশস্ত্র দলগুলো এবং তাদের সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর হামলা জোরদার করেছে। ইসরায়েলের এসব হামলায় সিরিয়ায় হিজবুল্লাহসহ মিলিশিয়াদের নেটওয়ার্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বলাই বাহুল্য, এতে প্রেসিডেন্ট আসাদের বাহিনীর দুর্বলতাও প্রকাশ হয়ে পড়েছে।