Published : 01 Dec 2024, 09:12 PM
প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) প্রধান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তার উত্তরসুরি মনোনীত করেছেন।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে আব্বাস দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়লে হাল ধরবেন তার মনোনীত উত্তরসূরি রাওহি ফাত্তুহ, যাকে কয়েকদিন আগেই বেছে নিয়েছেন তিনি।
ফিলিস্তিনের গাজায় এক বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের হামলা চলছে। এতে এখন পর্যন্ত ৪৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত ও অনাহারে আছে অসংখ্য মানুষ। এ পরিস্থিতে পিএ’র প্রধান হিসেবে আব্বাসের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা বাড়ছে।
ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর একবছর পর ২০০৫ সালে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ৮৯ বছর বয়সী মাহমুদ আব্বাস। তিনি এখনও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আর তাই প্রশ্ন এখনই কেন উত্তরসূরি বেছে নিলেন মাহমুদ আব্বাস? এই উত্তরসূরি ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রধানের দায়িত্বই বা নেবেন কীভাবে সেটিও প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে আল জাজিরা:
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ) কী?
পিএ ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির অধীনে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন এবং ইয়াসির আরাফাতের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি ছিল এটি।
পিএ গঠন করা হয়েছিল মূলত ইসরায়েলের দখলে থাকা পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর ও গাজায় বাস করা ফিলিস্তিনিদের জন্য শিক্ষা, নিরাপত্তা, পানি ও বিদ্যুতের মতো মৌলিক বিষয়গুলো দেখভালের জন্য।
অসলো চুক্তিতে পশ্চিম তীর ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’—তিনটি এলাকায় ভাগ হয়েছিল। এর মধ্যে পিএ পেয়েছিল ‘এ’ এলাকার নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এবং ‘বি’ এলাকার কেবল প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ। তবে ইসরায়েল গোটা পশ্চিম তীরে নিয়মিতই সহিংস অভিযান চালিয়ে আসছে।
সমালোচকরা বলে থাকেন, পিএ কার্যত ইসরায়েলি দখলদারিত্বের পক্ষে একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থার মতো কাজ করে।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ) এখনও কেন সক্রিয়
যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত অসলো চুক্তির লক্ষ্য ছিল ১৯৯৯ সালের মধ্যে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে গাজা এবং পশ্চিম তীরে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
কিন্তু চুক্তি সইয়ের এক বছরের মধ্যেই ইসরায়েল পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি নির্মাণ শুরু করে।
এরপর উগ্র-ডানপন্থি এক ইসরায়েলি জাতীয়তাবাদীর হাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন হত্যাকাণ্ডর মধ্য দিয়ে পিএ-র কাছে ইসরায়েলের দখল করা অঞ্চলগুলো হস্তান্তরের সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে পড়ে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন না হলেও পিএ মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে কার্যক্রম বহাল রাখে। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট আব্বাসের মেয়াদ ২০০৯ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি এখনও ক্ষমতায়।
আব্বাস কেন এখনও পিএ’র প্রেসিডেন্ট?
২০০৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে পিএর নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল হামাস। কিন্তু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী এই সংগঠন ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়নি। ইসরায়েল স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত হামাসও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে না বলে জানায়।
ওদিকে পশ্চিমা দাতারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে হামাসকে বাধ্য করার জন্য ফিলিস্তিনে অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেয়। তারপরও হামাস নিজ অবস্থানে অটল থাকে।
সে সময় ফিলিস্তিন শাসনের জন্য হামাস ও প্রতিদ্বন্দ্বী দল ফাতাহ-এর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির চেষ্টা চলেছিল। তবে তা সফল হয়নি। বরং দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। একপর্যায়ে হামাস গাজা থেকে ফাতাহ’কে তাড়িয়ে দেয়। ২০০৭ সালে ফাতাহকে পরাজিত করে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস।
তখন থেকেই হামাস গাজা আর ফাতাহ অধিকৃত পশ্চিম তীরে পিএ সরকার পরিচালনা করছে। তবে ফাতাহ সেখানে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ঠেকাতে না পারায় জনপ্রিয়তা হারিয়েছে।
ফিলিস্তিনে আর কোনও পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও হতে দেননি আব্বাস। এর কারণ হিসাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন হলে হামাসের কাছে ফাতাহ পরাজিত হতে পারে এবং আব্বাস নিজের পদও হারাতে পারেন বলে ভয় পেয়েছিলেন।
ফিলিস্তিনের মানুষ ২০২১ সালের মে মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু আব্বাস নির্বাচন স্থগিত করেন। এর জন্য তিনি ইসরায়েলের ওপর দায় চাপিয়েছিলেন। বলেছিলেন, নির্বাচন হলে দখল হওয়া পূর্ব জেরুজালেমে ভোট নিতে দেবে না ইসরায়েল।
আব্বাস অসুস্থ হলে কী হবে?
কয়েক দিন আগেই রাওহি ফাত্তুহকে উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নিয়েছেন আব্বাস। ফাত্তুহ ফিলিস্তিনি আইন পরিষদের সাবেক স্পিকার এবং বর্তমানে ফিলিস্তিনি জাতীয় পরিষদের স্পিকার তিনি। এই জাতীয় পরিষদ পিএলও’র আইন প্রণয়নকারী সংস্থা হিসাবে কাজ করে। ফাতাহর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন ফাত্তুহ।
আব্বাস অসুস্থ হয়ে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে ফাত্তুহ অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ)-এর নেতৃত্ব দেবেন। তিনি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ৯০ দিনের জন্য এই দায়িত্বে থাকবেন। ২০০৪ সালে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পরও একই ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) ফিলিস্তিনি রাজনীতি বিশেষজ্ঞ তাহানি মুস্তাফা বলেন, ফাত্তুহ ক্ষমতালোভী নন। তার কোনও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নেই। নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ফাত্তুহ সহজেই দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।
আব্বাস কেন এখন উত্তরসূরি বেছে নিলেন?
যুক্তরাষ্ট্র এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর চাপের কারণে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
গত সেপ্টেম্বরে সৌদি আরব কয়েকটি আরব ও ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের একটি দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের চেষ্টা চালিয়েছিল।
পরে সৌদি আরব অর্থনৈতিক সংকটে থাকা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে (পিএ) টিকে থাকতে সহায়তার জন্য ৬ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
আইসিজি বিশেষজ্ঞ তাহানি মুস্তাফা বলেন, সৌদি আরব এই অর্থের শেষ কিস্তি এক কোটি ডলার দেওয়ার বিনিময়ে আব্বাসকে একজন উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার শর্ত দিয়েছিল।
ইসরায়েল অসলো চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে পিএ-র হয়ে কর রাজস্ব আদায় করে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত আদায় করা ১৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারের কর রাজস্ব ইসরায়েল আটকে রাখায় অর্থ সংকটে রয়েছে পিএ। সেকারণেই হয়ত মাহমুদ আব্বাস সৌদি আরবের শর্তে রাজি হয়েছেন।
ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে আব্বাস এখনও ক্ষমতাধর?
ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে আব্বাস তার নিজ বলয় এবং ঘনিষ্ঠ মহলের মধ্যে এখনও ক্ষমতাধর। তিনি এখনও ফাতাহ দলের প্রধান। ফাতাহ সবচেয়ে বড় এবং পুরোনো ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক দল।
আরও বড় বিষয় হল: আব্বাস পিএলও’র প্রধান। এই সংগঠন পিএ-র চেয়েও শক্তিশালী। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পিএলও ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে দেনদরবার করা ছাড়াও তাদের পক্ষে নানা সিদ্ধান্ত নেয়।
বিশেষজ্ঞ তাহানি মুস্তাফা জানিয়েছেন, পিএলওর সেক্রেটারি জেনারেল হুসেইন আল-শেখকে সংগঠনের পরবর্তী প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি আব্বাস নিশ্চিত করে জানিয়েছেন।
আর তা করতে, আব্বাস পিএলওর নির্বাহী পরিষদে তার অনুগতদের নিয়োগ করেছেন, যাতে নির্বাচন হলে তার ঘনিষ্ঠজনদেরই কেউ ক্ষমতায় আসতে পারেন।
মুস্তাফা বলেন, “পিএ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, এটি শুধু সেবাদানকারী কর্তৃপক্ষ। ফিলিস্তিনের আসল গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হল পিএলও ও ফাতাহ।”