Published : 04 Oct 2024, 12:40 PM
কলকাতার আকাশে তারা
রাত ন-টা পনেরো কি কুড়ি। বারান্দায় বিড়ি খেতে বেরিয়ে দেখি, পুব আকাশে একটা তারা। জ্বলজ্বল করছে। কোন তারা? নাম জানতে চাওয়ার উপায় নেই। মাথার ওপরটাকে নব্বই ডিগ্রি ধরলে তারাটি রয়েছে মাটি থেকে আন্দাজ তিরিশ ডিগ্রি ঊপরে। সেই কোন ছোটোবেলার শোনা কথাটা মনে পড়ল-- একটা মাত্র তারা দেখা নাকি অমঙ্গলের। এবং সেই অমঙ্গলটি মাতৃজনিত। বহু বছর হল, মা নেই। তবু, এত দিন পর এত বড়ো আকাশে আচমকা একটা মাত্র তারা দেখে মন চায় দ্বিতীয় কোনো জ্বলজ্বলে অগ্নিপিণ্ডকে খুঁজতে। দেখি, বাঁদিকে, বেশ কিছু দূরে আরেকটি। অপেক্ষাকৃত ছোটো। তবু তারা-ই তো! ছেলেবেলার স্বস্তিটুকূ ফিরে আসে।
কিন্তু, এরা কি সত্যিই তারা? উপগ্রহ-টুপগ্রহ নয় তো? এতগুলো উচ্চাভিলাশী দেশের এত এত উপগ্রহ এখন আকাশে ভিড়ে গেছে যে, আসল-নকলে তফাত করা যায় না। কে বলতে পারে, এই সংশয়ই হয়তো-বা পুরোনো সংস্কারটিকে সমূলে ধ্বংস করেছে!
(১৭ ডিসেম্বর ২০১৭)
চাঁদের ওপিঠ
তখন রাত। দশটা ছেচল্লিশ। তমলুক (শিমুলিয়া) থেকে সেলিমের (মল্লিক) ফোন-- মণীন্দ্রবাবু নেই। এই সংক্ষিপ্ত বার্তাটি অশ্রুপ্লাবিত হয়ে এল।
আমার যে এই-এই অসুখ আছে, দীর্ঘক্ষণ ফোনে কথা বলা যে উচিত নয় আমার, কত-কত দিন সে না-জেনে এক-দেড় ঘণ্টা বকবক করে অন্যায় করেছে-- এই ছোট্ট কথাটা শোনাতে যে-সেলিম আমাকে এবং নিজেকে সতর্ক করতে বত্তিরিশ মিনিট কথা বলেছিল একদিন, গত রাতে তার ফোন ছিল মাত্র এক মিনিট ছয় সেকেণ্ডের।
ছ-সাতটি শব্দ। এক মিনিট ছয় সেকেণ্ড লাগার কথা নয়। লেগেছিল নীরবতার জন্যে, আর নীরবতার ভগ্নী কান্নার জন্যে।
আজ তিনটে পাঁচে তারই ফোন। মণীন্দ্রবাবুর দাহ হয়ে গেল। কেওড়াতলা শ্মশান থেকে আবার তার কান্না।
কারা রয়েছেন?
উত্তর এল: এত বড়ো কবি। এত তাঁর প্রিয়জন। অথচ শ্মশানে মাত্র গুটিকয়েক মানুষ, এক-আধজন বাদে প্রায় সবাই অখ্যাত তরুণ।
সব কথাই আসছিল ভেঙে ভেঙে। কান্নার ধাক্কা খেতে খেতে।
এবারের ফোনটা তিন মিনিট পাঁচ সেকেন্ডের। আমারই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে।
এই ভাবে বাংলা ভাষার এক বনবাসী বৃক্ষ, মণীন্দ্র গুপ্ত, আমাদের মণীন্দ্রদা, চলে গেলেন। অনন্ত সময়প্রবাহ থেকে আমার মাত্র চার মিনিট এগারো সেকেণ্ড নিয়ে।
এরপর মণীন্দ্রদার কথা ভাবব কি আমরা? ভয় করে।
(১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)
সম্পর্ক
সম্পর্ক হচ্ছে শীতের ময়শ্চারাইজার ক্রিমের মতো। যতই আন্দাজ করে কেনা হোক, শীত ফুরোবার আগেই মাখতে মাখতে শেষ। পরের কন্টেনারটা কিন্তু কিছুতেই শেষ হতে চায় না!
(২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)
গোলকধাঁধা
কী ভালোবাসি বা কী কী? ভাবতে হবে। তবে গোলোকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে আচমকা কোনো বাঁকে ঘৃণার মুখোমুখি হতেই হয়েছে, যে উঠে এসেছে ভালোবাসারই মাটি ফুঁড়ে।
(২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)
আমরা বাঙালি
রাত একটা পাঁচ। বাঙালি ঘুমিয়ে পড়েছে। মন্বন্তর, যুদ্ধ, মহামারী, ভুমিকম্প, এমনকি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাক-- তার কাঁচা ঘুম ভাঙানো উচিত নয়। অন্তত একটা-দুটো শতাব্দী তাকে ঘুমোনোর সুযোগ দেওয়া উচিত!
(৫ মার্চ ২০১৮)
একলা চলো রে
উনতিরিশ মার্চ শেয়ালদা রাজধানীতে ফিরছি, সহযাত্রী পরিবারটির পুরুষ-সদস্য সাবির আহমেদ আসানসোলের সন্তান, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, পূর্বপুরুষেরা ছিলেন বিহারের বাসিন্দা। মাতৃভাষার মতোই বাংলায় স্বচ্ছন্দ। চাকরি-সূত্রে দীর্ঘদিন দিল্লি-প্রবাসী। চেহারায় স্ত্রী-কন্যা কেমন যেন বিজাতীয় ঠেকল। আলাপ এগোতেই জানা গেল, সাবির শ্রীনগরের জামাতা। সবাই মিলে যখন কথা হচ্ছিল, হচ্ছিল হিন্দি-ইংরেজির খিচুড়িতে। মা-মেয়ে বাংলা একবর্ণও জানেন না। তাঁদের নিজেদের কথা ঘুরছিল অবশ্য কাশ্মীরিতে। হেসে সাবির জানালেন, ওদের মাতৃভাষায়। এবং তিনিও এখন বলতে-বুঝতে পারেন।
আসানসোল তো উত্তপ্ত। এমন দুর্যোগের সময়ে?
পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে আসানসোল আসা। বলার পর হেসে সাবিরের সহজ উত্তর-- গোটা দেশই তো উত্তপ্ত। এটা তো শুধু আসানসোলের নয়, সারা ভারতের সমস্যা। যেন বিষয়টার আঞ্চলিক কোনো গুরুত্ব নেই তাঁর কাছে।
মেয়ে ফারহা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী।
আমাদের সঙ্গে ডাকাবুকো নাতনি সুহা। ফলে সারাটা রাস্তা কথায় আড্ডায় খেলায় হাসিতে খাওয়ায় এমন একটা পারিবারিক আবহ রচিত হয়ে গেল যে আসানসোল যেন কানপুরের পরের স্টেশন। এল বলে!
একসময় নাগাড়ে বাংলায় বকবকম-করা সুহাকে কোলে নিয়ে ফারহা একটা গান গাইতে বলল। যে-কোনো গান। বাংলা হলেও চলবে। সুহা গাইবে কেন! এমনকি যে-রাইমগুলো সুর করে বললে ফারহা বুঝবে, সেসবও না। সে বকবক করেই যাচ্ছে। আসলে তখন তাকে গল্প বলায় পেয়েছে আর প্রতিটি গল্প শুরু হচ্ছে-- একদিন সে জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল আর সেই সময়...।
শেষে নাছোড় ফারহা বলে, ওহি গানা তো গাও, (তারপর পরিষ্কার বাংলায় বলে) যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
আমার সামনে দুরন্ত নাতনি। শান্ত হাসিমুখ এক কাশ্মীরি কলেজ-তরুণীর কোলে।
প্রতিবছর মা-মেয়ের গ্রীষ্মাবাস শ্রীনগর। অন্তত তিন মাস। বিয়ের পর সবকিছু চমৎকার মানিয়ে নিলেও দিল্লির গরম স্ত্রী ফারদিন মেনে নিতে পারেননি। তাই এই ব্যবস্থা। অনিশ্চিত জীবনযাপনের ঝুঁকি নিয়েও পাড়ি দেন মাতৃভূমির দেশে। সঙ্গে মেয়েও।
একটু জোড়াতালি দিয়ে ফাঁক পুরণ করার লোভ সামলানো যায়নি এবং ফারহা আর তার মা ফারদিনকে জিজ্ঞেস করে সংশয় দূর করার মতো উদ্যমীও হতে পারিনি যে, ফারহার মতো কাশ্মীরের শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের কাছে এই গানটি তবে কি লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠল? নাকি অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠ গানটিকে কলেজের কমনরুমের হুল্লোড়ে পৌঁছে দিয়েছে?
আজ হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত 'আ সেন্টেনারি ভল্যুম'টি নাড়াচাড়া করার পর নেহরুর 'ইন্ট্রোডাকশন' পড়ে প্রথম সম্ভাবনাটিই সেদিন থেকে পক্ষপাতিত্ব আশা করছে।
(৬ এপ্রিল ২০১৮)
ভদ্রলোক
তখন তিনি রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। কোনো-এক কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমি ভদ্রলোক নই, আমি কমিউনিস্ট।’ হুবহু এই শব্দগুলো না-বললেও তাঁর বক্তব্য ছিল হয়তো-বা এমনই। এই কথাটা সে-সময় বাঙালি ভদ্রসমাজের বেশ গায়ে লেগেছিল। কোনো উচ্চশিক্ষিত এবং স্বোপার্জিত-দাঁড়ে-বসা চন্দনা পাখি যদি সগর্বে ঘোষণা করে— ‘আমি কাকদের দলে’, তাহলে বাংলার শুচিবায়ুগ্রস্ত কুলীন শালিককুলের মানে লাগবারই কথা!
তবে, সেই মানুষটির সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না। আমি যে-অশোক মিত্রকে জেনেছিলাম, এটুকু বলতেই পারি, বাঙালি ভদ্রলোক বললেই আপোশচর্চিত যে-গোলগাল চেহারাটি ভেসে ওঠে, তেমনটা তিনি ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্পষ্ট কথার মানুষ।
ছিলেন। মানে নেই। আজ মে দিবসের সকালে সেই কবিতা-অনুরাগী অর্থনীতিবিদ, প্রকৃত অর্থে অভিজাত এক বামপন্থী বাঙালি, অসামান্য গদ্যলেখক অশোক মিত্রের প্রয়াণ ঘটল।
কৃষ্ণকায় মানুষটি সৌজন্যবোধে ছিলেন ঝলমলে। তবে তাঁর সৌজন্যবোধের নিজস্ব একটা ধরন ছিল। তাতে লুকোছাপা কিছু ছিল না। যেমন ছিল বেঁচে থাকার এবং ভাবনাচিন্তার নিজস্ব পদ্ধতি। জেনেছি, অশোক মিত্র ছিলেন বেদম কাজপাগল। সদা কর্তব্যপরায়ণও। প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব থেকে বাড়তে বাড়তে দেশ, দেশের মানুষ— সবার প্রতিই ছিলেন কর্তব্যে অটল।
কিন্তু, আর ‘ছিলেন, ছিলেন’ বলতে ইচ্ছে করছে না। কেননা, সেটা উনিশশো আটানব্বই সাল। অক্টোবর মাস। সামনে পুজো। মেয়ের সম্ভাব্য হার্ট অপারেশন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আমি দিশেহারা। ভুমেন্দ্র গুহ আচমকা একদিন বাড়ি বয়ে এসে নিদান দিলেন, দিল্লির এইমস ছাড়া গতি যখন নেই, কম টাকায় সেরা চিকিৎসা একমাত্র ওখানেই হওয়া সম্ভব যখন, অশোক মিত্র মশাইকে একবার বলে দেখতে দোষ কী। এবং সেটা নাকি আমাকেই বলতে হবে।
শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি। কোথায় অশোক মিত্র আর কোথায় আমি! তিনি কি কথাটা আদৌ কানে তুলবেন? ভুমেনদা নিমেষে রাগান্বিত— আপনার মেয়ের অপারেশন তো এমনিতেই হচ্ছে না। মিত্র মশাই সাহায্য না-করলে তো সেই একই জায়গায় থাকবেন। বাড়তি কিছু ক্ষতি হবে কি?
ফলে দু-একদিনের প্রস্তুতি নিয়ে গ্রহান্তরে একটা ফোন। পাড়ার বুথ থেকে। কেননা, তখন আমাদের কোনো ফোন নেই। উনি তখন রাজ্যসভার সদস্য। বেশ কাঁপা গলায় বলি, ‘আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম একরাম আলি...’ উনি তৎক্ষণাৎ থামিয়ে দিয়ে জানতে চান, কবিতা লিখি তো? এবং উত্তরের তেমন অপেক্ষা না-করেই বলেন— চেনেন!
শুনে আমি অনেকটা হতভম্ব এবং কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হই। হতভম্ব এই কারণে যে, এত দূরবর্তীজনের খবরও তিনি রাখেন! আর, আশ্বস্ত হই ধরবার একটা খড়কুটো পেয়ে।
আশ্চর্যের যে, সবটা শুনে পরদিনই মেয়ের যাবতীয় মেডিকেল রিপোর্ট সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাড়ি যাওয়ার নির্দেশ। সেটা কোথায়? এতটা হয়তো আশা করেননি। ঠান্ডা গলায় সংক্ষেপে বাড়ির পথনির্দেশ দিয়ে ফোন রেখে দেন। পরদিন সকালে আলিপুরের সোনালি অ্যাপার্টমেন্টে। একজন দরজা খুললেন এবং সিলিং অব্দি বইয়ে ঠাসা (স্টিলের একটা ল্যাডারও ছিল।) যে-ঘরটায় বসতে বললেন, আমার সেদিনের ধারণা ছিল, সম্ভবত এইরকম ঘরকেই ‘স্টাডি’ বলে। একটু পরেই চা। পিছু-পিছু সাদা ধুতি-পাঞ্জাবির দ্রুত সঞ্চালন। উনি এলেন। হাতে ফাইলটা নিলেন এবং ফোন নাম্বার চাইলেন। নেই, তবে অফিসের নাম্বার আছে। সেখানে ফোন করলে পাওয়া যাবে। কোন অফিস? না, সেখানে তিনি ফোন করতে পারবেন না। তাহলে? জানাই যে, আমিই ফোন করে নেব।
এত সব ঘটনার পর অশোক মিত্র মশাই আমাকে বাস্তবতায় নামিয়ে আনেন। জানান, এসব ব্যাপারে কতটা কী করতে পারবেন, তিনি নিজেই জানেন না। তবে, তাঁদের দলে প্রকাশ নামের একটা ছেলে আছে। এইমসের কোনো কোনো চিকিৎসক তার বন্ধু। সে যদি কিছু করতে পারে।
মাঝে মাত্র দুটো দিন কেটেছে। তৃতীয় দিন সকালে চা খাচ্ছি, ক্রুদ্ধ ভুমেনদা হাজির। শশব্যস্ত আমার দিকে একবার মাত্র ভ্রূক্ষেপ করে যা বকলেন, তার মর্মার্থ হচ্ছে— কাল সারা দিন অশোক মিত্র মশাই সম্ভাব্য নানা জায়গায় ফোন করে আমাকে খুঁজেছেন, আর আমি নাকি এখানে নিশ্চিন্তে বসে-বসে চা খাচ্ছি! ভাগ্যিস, হার্ট-সংক্রান্ত সমস্যা এবং কবিতালেখক যখন, চিনতেও পারেন ভেবে গত রাতে একটা ফোন মিত্র মশাই তাঁকেও করেছিলেন! তাই সাতসকালে এখানে আসতে হল।
এবং তকখনই বেরিয়ে অশোক মিত্রকে ফোন করার নির্দেশ।
এর আগে যেদিন আলিপুরে যাই, জেনেছিলাম, পরের দিন তিনি দিল্লি যাবেন। রাজ্যসভার সদস্য, কত কাজ থাকে এসব মানুষের। ফিরতে নিশ্চয়ই দু-চারদিন লাগবে। তাহলে কি সেই দিনেই ফিরেছেন!
তৎক্ষণাৎ, মানে-- ভুমেনদা যখন সশরীরে হাজির এবং কথার ল্যাজে কথা আসেই-- আন্দাজ ঘণ্টাদেড়েক পর বুথে যাই। মৃদু বকুনির পর অশোক মিত্র মশাই পারলে তখনই আমাকে দেখা করতে বলেন।
যাই। আগের দিনের সেই ঘরটিতেই আমাকে বসানো হয়। আগের দিনের মতোই একজন চা দিয়ে যান। এবং পিছু-পিছু তিনি হাজির। হাতে আমার সেদিনের দেওয়া ফাইল আর একটা সাদা রঙের বড়ো এনভেলাপ।
দরকারি দু-একটা কথা। যিনি দেখবেন, সেই ডাক্তারের নাম কে এস রেড্ডি (সেইসঙ্গে জানান, ইনি আমাদের প্রাক্তন রাজ্যপাল কে রঘুনাথ রেড্ডির ছেলে।)। তিনি অমুক তারিখে জাপানে যাচ্ছেন। ফলে হাতে সময় নেই। এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর কাছে পৌঁছোতেই হবে। খামটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন— এটা নিয়ে এ কে গোপালন ভবনে যাবেন। যাওয়ার আগে একটা ফোন করে নেবেন। নাম্বারটা খামে লেখা আছে। বাকিটা ওখান থেকেই বলে দেবে।
বুঝতে পারি, কাজ শেষ। উঠে পড়ি। প্রথম দিনের মতোই লিফটের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেন। হাত লাগানোর সুযোগ সেদিনও ছিল না, লিফটের দরজা খোলা এবং বন্ধ করার কাজটা তিনিই করেছিলেন। নামতে শুরু করলে খামটার দিকে একপলক তাকাই। প্রথমেই চোখে পড়ে প্রাপকের নাম। পরিষ্কার হস্তাক্ষরে লেখা— প্রকাশ কারাট। তাহলে তাঁদের দলের প্রকাশ নামের ছেলেটা ইনিই!
আমার দেখা অশোক মিত্র হচ্ছেন এমনই। কমিউনিস্ট ছিলেন কিনা, জানি না। সেটা আলোচনাসাপেক্ষ। কিন্তু তাঁর মতো মানুষ যদি ভদ্রলোক না-হন, আমার কি ভদ্রলোক হওয়া উচিত?
(২ মে ২০১৮)
রবীন্দ্রনাথ বনাম গান্ধি
ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ একবার পিয়ার্সন সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মহাত্মা গান্ধি আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-- দুজনেরই খুব ঘনিষ্ঠ আপনি। কে আপনার চোখে বড়ো। পিয়ার্সন এ-প্রশ্নের উত্তর সরাসরি দেননি। তবে জানান যে, তিনি দুজনকে একই প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁদের উত্তরগুলো শুধু জানাতে পারেন।
Mahatmaji, what is the greatest vice in your character?
মহাত্মাজি খানিক চিন্তা করে উত্তর দেন, 'There are so many, I cannot distinguish them.'
What is the greatest virtue?
'Others know it.'
রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম--
Gurudev, what is the greatest vice in your character?
মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করে গুরুদেব বলেন,
'Inconsistency.'
What is the greatest virtue?
"Inconsistency'.
জানা গেল মণীন্দ্রকুমার ঘোষের 'সাময়িকী' নামের জরুরি একটি বই থেকে। উপরের প্রশ্নোত্তরটুকু হুবহু বই থেকে উদ্ধৃত হল।
(৮ জুলাই ২০১৮)
ফেসবুক
আটষট্টি বছর পূর্ণ হল। বুড়ো হয়েছি। টাইমলাইনে আসতে তাই দেরি হল বেশ কয়েকদিন। দেরি না বলে সঙ্কোচ বলাই উচিত। আমার মতো নিষ্কর্মা, আমার মতো ব্যর্থ আর ঘরকুনো, আমার মতো এক আউটসাইডারকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা! ধুর, সে-আবার কেউ জানায় নাকি?
এসে আশ্চর্যই হলাম। দুই বাংলার এত এত বিখ্যাত আর তরুণ এই অকিঞ্চিৎকর মানুষটাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন!
অহংকারী হওয়ার মতো সাহসী হতে পারিনি। তাই আমার সৃষ্টিশীলতা কারো কারো মতে প্রশ্নের সম্মুখে। আমার নিজের সম্মুখে তো বটেই। তবু যে এতজন শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, ধরে নিচ্ছি, তাঁরা আমার ব্যর্থতাকেই ভালোবেসেছেন। সম্মানিত হয়েছে আমার অখ্যাতি।
(৯ জুলাই ২০১৮)
দ্য স্নেক
'দ্য স্নেক' নামে জন স্টেনবেকের সেই গল্পটা। ফ্যাকাসে, স্বল্পভাষী এক মহিলা এক সর্পাগারে এসে সবচেয়ে ভয়ংকর একটা সাপ কিনে সর্পাগারের কর্তাকে বললেন—'আজ থেকে এই সাপটা আমার। নিজস্ব।‘ এবং সাপের খাঁচায় একটা ইঁদুর ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। মহিলা সেই দৃশ্যের এক ক্ষুধার্ত দর্শক। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, সাপটা এখানেই থাকবে। মাঝে মাঝে এসে তিনি খাইয়ে যাবেন।
আসামে 'অবৈধ বসবাসকারী' হওয়ার অভিযোগে চল্লিশ লক্ষাধিক মানুষের নাম কাটা যাওয়ায় যাঁরা উল্লসিত, তাঁদের আমি আমার ফেসবুকের বন্ধু-তালিকায় রেখে দিতে চাই।
আমাদের অনেকের বন্ধু, আসাম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য কুপিত হলেও।
দেখতে চাই, সর্বনাশের শেষ সিঁড়ি পর্যন্ত বাঙালি নামতে পারে কি না।
(৩১ জুলাই ২০১৮)
আফসার
আমাদের ছোটো-বড়ো অবহেলাগুলো অগ্রাহ্য করে আফসার আমেদ চলে গেলেন।
(৪ অগাস্ট ২০১৮)
(ক্রমশ)