Published : 27 Apr 2010, 10:35 AM
"দুইজনায় বাঙালী ছিলাম
দেখো দেখি কাণ্ডখান…"
প্রতুল মুখোপাধ্যায়
[সঙ্গীতের প্রচলিত ফর্মার ভিতরে নিজেকে সঁপে দেননি গণসঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়। সোজা সড়কে না হেঁটে, কানাগলিতে হাঁটতে চেয়েছেন। বাদ্য-বাজনার গেড়োয় নিজের সুর ও গানের কথাকে না বেঁধে তিনি সুর ও কথা দিয়ে বেঁধেছেন বাদ্য-বাজনাকে। তাই তিনি খালি গলায় গান। যে গান জনতার, বৈষ্যমহীন সমাজ ও স্বপ্নের।
দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন এই শিল্পী। গত ১ এপ্রিল সকালে ধানমণ্ডিতে কলামিস্ট ও রম্য লেখক হেলাল ফয়েজির বাসায় তার সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছে। আলাপে শৈশব, কৈশোরের পাশাপাশি উঠে এসেছে গণসংগীত নিয়ে তাঁর দর্শন, কমিউনিজম, বাংলাদেশ, মাওবাদ ইস্যু ইত্যাদি। – আলমগীর স্বপন]
আলমগীর স্বপন: কেমন ছিল আপনার শৈশব ?
প্রতুল মুখোপাধ্যায়: আমরা পাঁচভাই দু বোন যেমন খুশি ঘুরে বেড়াতাম। আমি ক্লাশ ফোরের আগে কোনো স্কুলে ভর্তি হইনি। বাবা স্কুলের কাজে ব্যস্ত থাকতেন, মা সংসারের নানা রকম কাজে থাকতেন। বাবা যে আমাদের খুব বেশি খোঁজ নিতে পারতেন তাও নয়। যা খুশি তাই করতাম।
—————————————————————–
আমার ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন না যে, এটা একটা সঙ্গীতের ঘর। সেখানে আমি নক করলাম। তারপরে আমাকে বলা হলো, কী ব্যাপার আপনি কি সঙ্গীতে ঢুকবেন… আসুন আসুন… সঙ্গীতে আসুন… এরকম করে আমি সঙ্গীতে আসিনি। আমাদের সারা পৃথিবী জুড়ে সঙ্গীত ছিলো, পাখির ডাক থেকে শুরু করে যে ভিখারী সকাল বেলা কীর্তন গাইতো, কেউ শ্যামা সঙ্গীত গাইতো, বাবার সঙ্গে বসে একজন বেহালা বাজাতেন এবং গাইতেন—এরাই আমাকে সংগীতে এনেছেন। এদের গলা, এদের গানগুলো আমি গলায় তুলেছি।
—————————————————————-
আমার তিনবোনের এক বোন দেশভাগের পরে চুচুড়াতে জন্মেছে। আর সবাই এখানে-ওখানে। তখন বাবা বাংলাদেশেই কর্মরত ছিলেন। কিন্তু ছোটবোন যখন জন্মেছে তখন বাবা চুচুড়াতে কর্মরত ছিলেন। শৈশব বলতে পশ্চিমবঙ্গের চুচুড়ো বুঝি। তবে একটা কথা মনে আছে, যখন প্রথম দেশভাগের পর খড়্গপুর এসেছিলাম। খড়্গপুরে আমার এক বড় কাকা ছিলেন। তিনি বেশ কিছু দিন ওখানেই কাজ করতেন। তার বাসাতে উঠেছিলাম প্রথমে। তিনি আমার বড় ভাই জনুকে জিজ্ঞেস করলেন, 'আমি তোমার কে হই।' জনু বললো 'বড় কাকা।' তখন আমি স্বীকৃতিটা নেয়ার চেষ্টা করলাম, 'আমি ওরে শিখাই দিছি।' এই কথাটা বলার পরে তিনি বললেন, 'এরকম করে কথা বলো না। এরকম করে বললে, এখানে সবাই হাসবে।'
এটা আমার মনে একটা বিরাট আঘাত হিসেবে এসেছিলো। আমি আমার মতো করে কথা বললে, লোকে হাসবে। তাহলে আমি এ কোথায় এলাম।
এই কথা আমার মনে হয়েছিলো, সেই শিশু বয়সে। আমি আমার ভাষায় কথা বলছি, সেই শিশু বয়স থেকে যেরকম করে কথা বলছি, তা শুনলে লোকে হাসবে কেন? লোকে বাঙ্গাল বলবে কেন? এই যে একটা অদ্ভুত চিন্তা, মানে দেশবিভাগের আগেকার একটা যে বিভাজন এটা আমাকে প্রথমের দিকে পীড়িত করেছিলো।
আলমগীর: স্কুল ও কলেজ জীবন?
প্রতুল: আমরা খালি পায়ে স্কুলে যেতাম। আমার মনে পড়ছে,পা দুটো ধুলোয় একদম কালো হয়ে থাকতো। পথে খুব করে পায়ের ওপর পা ঘষে পা টাকে পরিষ্কার করেছি মনে আছে। গায়ে পরতাম সে রকম একটা জামা, জামার তলায় গেঞ্জি থাকতো না। ইজের পড়তাম। ইজের মানে বোতাম টোতাম না, দড়ি দিয়ে বাধা, এরকম ক্লাস সিক্স, সেভেন, এইট, নাইনেও গেছি। আর যখন কলেজে পড়েছি তখন ধুতি পরে যেতাম। দিদি আমাকে ধুতি পড়িয়ে দিতেন। এই হচ্ছে তখনকার স্মার্ট কলেজ বয়! আমরা বলতাম দিদি দিদি ধুতি পড়বো [হাসতে থাকেন] এর মানে হচ্ছে, আমরা যে বড় হয়েছি এর সাথে শৈশবের একটা সারল্য ছিলো। এখন হয়তো একটা ভালো পোশাক-টোশাক পরি। কিন্তু শৈশবের সেই আবরণ এখনও আমার মধ্যে রয়েছে। খুব সহজভাবে মানুষের সাথে কথা বলা, নিজের মনটাকে মানুষের সামনে একবারে খুলে দেয়া এই জিনিসগুলো কিন্তু এখনও আছে। সেটা হয়তো আমরা যেভাবে মানুষ হয়েছি, সেই আবহের জন্যে হয়েছে। আরেকটা কথা হলো এখনকার জীবনে বাবা-মা দুজনে মিলে চকআউট করছেন, ক্যারিয়ার কেমন হবে। 'মনে হচ্ছে ওর ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ধাত আছে, ওকে নানা রকম মডেল টয় দেও জিনিসগুলো তার বিকশিত হবে।' আমাদের বাড়িতে এমন কিছু ছাঁচ ছিলো না যে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, ডাক্তার হতে হবে।
আমাদেও গলায় গান ছিলো। বাবার পয়সাও ছিলো না। তাই গান শিখানোর কথা উঠতোই না। কিন্তু আমরা খোলামেলা গান করতাম। যা শুনতাম তাই গাইতাম, যা পড়তাম তাই নিয়ে ভাবতাম, তাই নিয়ে লিখতাম।
আলমগীর: ছোট বেলা থেকেই আপনাদের পরিবারে বই পড়ার একটা আবহ ছিল।
প্রতুল: আমি ছোট বেলায় বড়দের বই পড়েছি আর বড় বেলায় ছোটদের বই পড়েছি। আমাদের বাড়িতে যে খুব একটা বলা হতো না, 'এখন শৈশব এখন এই বইগুলো পড়ো, তারপর এই বইগুলো পড়ো। বাবার বই, যার, যে বই ছিলো তাই পড়তাম। আমার অক্ষর পরিচয় হয়েছে ছোটদার ফেলে দেওয়া একটা বই দিয়ে। যার প্রথম চার পাঁচটা পাতা নেই, সেরকম বই। আমরা কখনও কোনো নতুন বই পাইনি। বড় দাদার বই পেত মেজ দাদা, তারপর সেটা হতো আমার বই। এরকম করতে করতে প্রথম কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে-টিরে যেতো, মানে নতুন বই পড়া-টড়া কিন্তু আমাদের শৈশবে তেমন একটা হয়নি। এরকম করেই আমরা বড় হয়েছি। এই বয়স পর্যন্ত এই নিয়ে পড়বে, তারপরে এই পড়বে এরকম কিছু নির্দেশনা আমাদের পরিবারে ছিলো না। বাবা সব ধ্রুব, প্রহ্লাদের শ্র্রীকৃষ্ণ, বিষ্ণুর ভক্ত এমন সব লোকের বই এনে দিতেন। আর আমিও খুুব ভাব করে মাঝে মাঝে পদ্মাসন করে ধ্যানস্থ হয়ে বসতাম। আরেকটু পরে ভগবানকে পেয়ে যাবো আরকি—এমন একটা ভাব! ভগবানকে পেয়ে গেলে আর কোনো অসুবিধা দুঃখ থাকবে না। কিন্তু শেষের দিকে সত্যিই আমি ভগবানকে পেয়ে গিয়েছিলাম। যে ভগবান কেষ্ট-বিষ্টু নয়, জনগণ।
আলমগীর: আপনার শৈশবের বাংলাদেশ কেমন ছিল?
প্রতুল: শৈশবের ওরকম কীর্তনখোলা নদী দেখেছি। একবার কোন মুুক্তাগাছা বলে একটা জায়গা দেখেছি, সেখানে বিশাল বিশাল হাতি দেখেছি জমিদারবাড়িতে। এরকম কিছু ছায়া ছায়া মনে আছে। মানে এখন যেটা বাংলাদেশ হয়ে গেছে, সেই পূর্ববঙ্গের কথা আমার সেরকম মনে নেই।
আলমগীর: সঙ্গীতের সাথে কীভাবে গাঁটছাড়া বাধলেন?
প্রতুল: বাল্যকাল থেকেই আমি সঙ্গীতের সাথে আছি। আমার ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন না যে, এটা একটা সঙ্গীতের ঘর। সেখানে আমি নক করলাম। তারপরে আমাকে বলা হলো, কী ব্যাপার আপনি কি সঙ্গীতে ঢুকবেন… আসুন আসুন… সঙ্গীতে আসুন… এরকম করে আমি সঙ্গীতে আসিনি। আমাদের সারা পৃথিবী জুড়ে সঙ্গীত ছিলো, পাখির ডাক থেকে শুরু করে যে ভিখারী সকাল বেলা কীর্তন গাইতো, কেউ শ্যামা সঙ্গীত গাইতো, বাবার সঙ্গে বসে একজন বেহালা বাজাতেন এবং গাইতেন—এরাই আমাকে সংগীতে এনেছেন। এদের গলা, এদের গানগুলো আমি গলায় তুলেছি।
সাধারণত যারা সঙ্গীত সাধক তারা বলেন, 'আমি আমার বাবার কাছ থেকে প্রথমে শিখেছি, আমার বাবা আমাকে গুরুর কাছে নিয়ে যান। তিনি আমাকে সঙ্গীত শিক্ষা দেওয়ার পর আরেক গুরুর কাছে নিয়া যান'—এই ভাবে আমি শিখিনি। আমি তো সংগীতে প্রশিক্ষিত নই। আমার কোনো নির্দিষ্ট গুরু ছিলো না। তার ফলে হয়েছেটা কী সবাই আমার গুরু, যাদের কাছে আমি গান শিখেছি। যাদের গান আমি শুনেছি একেবারে ব্লটিং পেপারের মতো শুষেছি। এই শুষবার ক্ষমতা আমার ছিলো। এটা কোথাও একেবারে ঘষে ঘষে, মেজে মেজে একেবারে ধার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সে রকম নয়। আমরা এটাকে একেবারে আনন্দের উপকরণ হিসেবে ভাবতাম। আমরা কখনো মনে করিনি, বিরাট একজন সঙ্গীতজ্ঞ হবো, সবাই আমাকে দেখার জন্য ছুটে আসবে। এর জন্য এই করতে হবে, ওই করতে হবে। এরকম কখনও হয়নি।
আগে স্কুল কলেজে নাটক হতো। এসব নাটকে অনেক গান থাকতো। মাঝে মাঝে কোনো কোনো শিক্ষকও আমাদের নির্দেশনা দিতেন। তারা বলতেন, 'এত গান দিয়ে কী হবে, গানগুলো কেটে বাদ দাও। তো আমি বললাম, কেন গানগুলো বাদ দেব কেন। 'গানগুলো কে গাইবে'। 'কেন আামি গাব।' 'গানগুলোতে কথা আছে, সুর দিয়ে কে গাইবে।' 'কেন আামি সুর দেব।'… সুর দেয়াটা যে এত শক্ত কাজ তার জন্য যে তিনতলা চারতলা সুর পেরুতে হয়—এ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। আমার কাছে গানটা এত স্বাভাবিকভাবে এসেছে। যে কথাগুলো পেয়েছি কথাগুলো কিছুক্ষণ গুন গুন করতে করতে সুর হয়ে গেছে, গান হয়ে গেছে। তো যা বলছিলাম, নাটকে যে ছেলেটি গান গাইবে সেই ছেলেটির ভূমিকাই আমাকে দেয়া হতো, আমি দিব্বি গান গেয়ে দিতাম।
এটা আমার খুব মনে আছে যে আমাদের ক্লাসেরই একটি ছেলে নাটকে বিমলের ভূমিকায় যে অভিনয় করতো সে একদিন একটা সিলভার মেডেল কিনে সবার সামনে আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল। এটা হচ্ছে আমার পাওয়া প্রথম পুরস্কার। আমার সহপাঠির কাছ থেকে সেই একটা মেডেল পেয়েছিলাম, সেটা কিন্তু আমার এখনও মনে আছে। কত সম্মানই তো পাই, কত স্মারক তো পাই কোথায় রাখব ভেবে পাই না। তবে সেই মেডেলের কথা আমার এখনও মনে আছে। তবে সেই মেডেলটা এখন আমার হাতে নেই।
আমি কখনও ভাবিনি গানটা আমার আনন্দ ছাড়া অন্য কোনো কাজে লাগবে। তখন দেখতে পেলাম গানটা আর কারও কারও কাছেও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে।
এ রকম সময়ে দাদা আমাকে একটা বই দিলেন। বইটার নাম হচ্ছে ঘুমতাড়ানী ছড়া। তাতে সুকান্ত ভট্টাচার্য, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে ও জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র—এই চার কবির কবিতা এবং ছড়া থাকতো, সেটা আমার জীবনে একটা মস্ত বড় সোপানের মতো। কারণ শৈশবে নানারকম শিশুপাঠ্যই পড়ে, এগুলো কিন্ত সে রকম নয়। সেখানে একটা সমাজতন্ত্রী ভাবনা ছিলো, তখনকার দিনের গরীব শিশুরা শিক্ষা পাচ্ছে সেদিকে আমার মনে চলে গিয়েছিল। অবশ্য আগে ছিলো সম্পূর্ণ ভগবতগীতার দিকে। বাবাও গীতা পাঠ করতেন। এই ভগবত ভক্তির দিক থেকে একেবারে জনভক্তির দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কিন্তু এই ঘুমতাড়ানী ছড়া বইটিই আমার প্রেরণা। মার্কসবাদের প্রতি আগ্রহ, সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে এই বইটি একটা মস্তবড় ভূমিকা পালন করেছিল। পরে যত মার্কসবাদী সাহিত্য পড়েছি সেটা যে ভূমিকা পালন করেছিল—ওই চার কবির কবিতা আমাকে, আমার মনটাকে অনেক অনেক বেশি রকম করে বদলে দিয়েছিলো। শুধু তাই নয় ওই কবিতাগুলো বিশেষ করে যেগুলো খুব সারবান, সত্যিকারের কবিতা, কবিতার গীতি রূপের ব্যাপারে ওই বইটাই ছিলো আমার সোপান। আমি ১০ বছর বয়সে বইটা পেয়েছি। ১২ বছর বয়সে যখন ১৯৫৪ সেখানে আমি তখন মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের 'ধান কাটার গান গাই, লোহা পেটার গান'—কবিতাকে আমি গান করেছি। সেই কবিতা সে রকম সুরে, মানে ১৯৫৪-এর সেই সুরে ১৯৯৪ সালে রেকর্ড করেছি। এবং ১৯৯৫ কিংবা '৯৬ এর দিকে কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়কে আমি সেই গান শুনিয়েছি। গান শুনে তিনি বলেছেন, 'তুমি খালি এটা করছো কেন, আমার আরও কত কবিতা আছে সেগুলোও করো।' এরকম করে আমাকে উৎসাহিত করেছেন। এই যে এরকম করে এতো মাইল পথ হাঁটা, এটা আমাকে অনেক আশ্চর্য করেছে। মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাকে গান করার সময় আমার কখনও মনে হয়নি আমি সেই কবির দেখা পাবো, গান শুনাবো। এরপরে যে কত প্রথিতযশা মানুষ আমার গান শুনেছেন, আমাকে আদর করেছেন, সাধুবাদ করেছেন। বহুমানুষ, সেই মান্না দে থেকে শুরু করে একেবারে ক্লাসিকাল মিউজিকের যারা তাল বাদ্যের লোক। এগুলো আপনাদের যত বলবো ততই আপনারা হয়তো বলবেন, এই ভদ্রলোক নিজের ঢাক নিজে পেটাতে ব্যস্ত হয়েছেন।
আপনি বিশ্বাস করবেন না যে, আমি তো কোনোভাবে গানে প্রশিক্ষিত নই। কলকাতাতে সঙ্গীতম নামে একটি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠান গানের মানুষ হিসেবে আমাকে সম্মান দিয়েছে। যে সম্মান আগে দেয়া হয়েছিলো ভিজি যোগকে, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এই তালিকাতে একটা জায়গায় ধরা যাক ১৯৯৭ কি ৯৮ সালে প্রতুল মুখোপাধ্যায় নামটা যোগ হয়েছে।
এই তালিকায় আমার নাম যোগ করতে যখন সঙ্গীতম থেকে কয়েকজন এলো তাদের বললাম, আমি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত কখনও শিখিনি আপনারা বোধহয় ভুল করছেন, এটা আমার প্রাপ্য নয়। আমি যাদের নাম তালিকায় দেখছি তাদের সাথে আমার নাম যোগ হতে পারে না। তখন তারা বলেছে, 'দেখুন আপনি গণসংগীত গাইছেন বলে আপনাকে দিচ্ছি না, আপনি গান গাইছেন বলে দিচ্ছি। আপনার তান বিস্তার, আপনার স্বর প্রক্ষেপণ, আপনার তাল লয়ের প্রতি যে মনোযোগ সেগুলো দেখে সাঙ্গীতিক প্রকরণ ও চিন্তার ভিত্তিতে আমরা আপনাকে সম্মাননা দিচ্ছি।'
আর সবচেয়ে বড় কথা দিপালী নাগের মতো শাস্ত্রীয় সংগীতের পুরোধা আমার নামটি নির্বাচন করেছেন।
আলমগীর: সংগীতে বাদ্য বাজনার ব্যবহার না করে প্রচলিত ধারার বাইরে আপনি হেঁটেছেন। আপনার গানে বাদ্য-বাজনার চেয়ে আপনি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন।
প্রতুল: আমি শুনে শুনে, ঠেকে ঠেকে শিখেছি। এ আরেক রকমের শেখা। এতে যে অসুবিধা হয়নি তা নয়, কিন্তু সুবিধে হচ্ছে যেহেতু আমি কোনো ব্যাকরণগত রাস্তায় হাঁটিনি, আমি এমন অনেক জায়গায় হেঁটেছি যেখানে বাংলা গান কখনও হাঁটেনি। কারণ একটা প্রকরণে শিক্ষিত হয়ে গেলেই তখন সেই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করতে হয়। আমি ঢাকার কোনো উদাহরণ দিতে পারবো না। ধরা যাক কলকাতা বিমান বন্দর থেকে মানিকতলা। বাস ধরবো আর মানিকতলায় চলে যাবে। এটাই সহজপথ। কিন্তু আমি তো সেইভাবে যাইনি। আমি একটুখানি গিয়ে কোনো গলির ভিতর ঢুকে পড়েছি, গলির মধ্যে আবার পথ হারিয়ে ফেলেছি। তারপর আবার পিছিয়ে এসেছি। এরকম করতে করতে হয়েছে কী ওই গলিগুলো আমার চেনা হয়ে গেছে। যে গলিতে অন্যরা কখনও যেত না, অন্যরা সব সময় বাঁধা সড়ক দিয়ে যেত। আমি এরকম বাঁধা সড়ক যেহেতু চিনি না,তাই আমি এখানে-ওখানে ঘুরতে ঘুরতে সে জায়গায় যখন পৌঁছেছি তখন আমি দেখেছি ওরা যেসব জায়গায় গেছে তার থেকে বেশি জায়গায় আমি গেছি। কিন্তু ওখানে তো তারা যেতে পারেনি। এই যে অ-প্রশিক্ষণ এবং তার সঙ্গে বিদ্যাটির প্রতি একটা অপরিসীম ভালোবাসা, প্যাশন, উদগ্র একটা ইচ্ছে এবং তার সাথে ন্যূনতম জ্ঞান যদি থাকে সেটাই আসল কথা। তবে গলা যদি সুরে না যায় তাহলে তো সেটা হবে না।
আমাদের সময় এত ভালো মানের সঠিক সুরে গাওয়া লোকের অভাব ছিলো না। সে তালিকা এখন করতে গেলে দেড় ঘণ্টা লেগে যাবে। কত সমৃদ্ধ গান তখন হতো। এসব গান আমার কানে গেছে, তাকে অনুসরণ করেছি, অনুকরণ করেছি, অনুসৃজন করেছি। প্রত্যেকটি স্রষ্টার কিন্তু এই তিনটে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয়। আরেকটা কথা হচ্ছে নতুন সৃষ্টি যখন করতে হয়, সৃষ্টির প্রক্রিয়াটা হচ্ছে, 'যত কিছু অর্জন করুন।' মানে সোজা কথা হচ্ছে থলেতে সব পুরুন। একটা বস্তা নিন। যেমন কাগজ বিক্রির লোকেরা যখন যা পায় অর্থাৎ এখান থেকে নেয় ওখান থেকে নেয়। যখন সেগুলো দিয়ে কিছু তৈরি করবেন তখন দেখবেন সবগুলোকে একসঙ্গে জুড়ে একটা স্ম্যাস তৈরি হলো, কিন্তু সেটা কি সৃষ্টি হয়। তাই অর্জন যেমন প্রচণ্ড রকম দরকার তার সঙ্গে ভীষণভাবে দরকার বর্জন। এই যে বর্জন, এই বর্জনের জ্ঞান যাদের না থাকে, সে যদি বলে আমি এত জিনিস জোগাড় করেছি, আমার কাছে কত কত কিছু আছে আমি সব দেখিয়ে দেবো, এই সব দেখাতে গিয়ে সে যে একটা বিকট বস্তু তৈরি হয়, সেটাকে সৃষ্টি বলা যায় না।
আমি দেখেছি যখন একটা গান লিখতে গেলাম, তিন পাতা হয়ে গেলো। তিন পাতা গান তো মানুষ শুনবে না। তখন এক একটা স্তবক যেটা আমি অনেক ভেবে চিন্তে লিখেছি সেটাকে কাটতে হয়। কেটে কেটে একবারে ইন রিডিউসেবল জায়গায় আনা যায়। তখন সেটা সৃষ্টি হয়, সংহত হয়।
বর্জন ব্যাপারটা দু'ভাবে ভাবতে হয়। যেমন একটা জিনিস অনভিপ্রেত বাজে, একটা রক মিউজিক থেকে একটা সুর শুনলাম, তার মধ্যে একটা বিশ্রী রকম যৌনতার অনুষঙ্গ আছে। কিন্তু তার সুরটা ভীষণ ভালো, তো আমি কী করব, যেই সুরটা ভীষণ ভালো সেটা আমি মাথায় রাখবো। যেটাকে আবর্জনা মনে করছি সেটাকে বর্জন করবো।
আরেক রকম বর্জন আছে। যেমন ধরুন একজন ভাস্কর। তিনি পাথর খোদাই করে একটা মূর্তি তৈরি করছেন। তার মনের মধ্যে একটা শেপ আছে। এখানে তিনি বর্জন করে একটা সৃষ্টি করছেন। তাই অর্জনের সাথে বর্জনের বিষয়টি যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা মাথায় রাখতে হবে।
আলমগীর: আপনার গান জনগণকে নিয়ে… আপনি কীভাবে জনগণের হয়ে গেলেন?
প্রতুল: আমার একটা গান আছে যে, ভগবানে আমাদের কেষ্ট বিষ্টু নয়। জনগণে ভগবান সর্বশক্তিময়। জনশক্তি মহাশক্তি যদি থাকে সাথে/গুড়াইবে পাহাড় আর না থাকিবে পথে/ বাচাঁর পথে দিশা দেখো রে।
এই যে ইশ্বর ভক্ত থেকে জনগণ ভক্ত হওয়া এটা কিন্তু আমার কাছে ধারাবাহিকভাবে এসেছে। আমরা জনগনের ভক্ত, তাদের দয়া করি না। আমাদের ভিতর এমন একটা অ্যাপ্রোচ হচ্ছে যে, এই দরিদ্র জনসাধারণ আছে তাদের তুমি করুণা করো। এরকম করুণা করার কথা কিন্তু আমি কখনও ভাবিনি। আমি দেখেছি আমাদের বাড়িতে কারা গান করতে আসতেন বেহালা নিয়ে। বাবা তাদের আপন করে নিতেন, কথা বলতেন, বসতে দিতেন। বাবা যাদের গান শুনতেন, তাদের একটা সম্মানী দিতেন। আমাদের বাড়িতে যাকে আমরা মেথরানী বলি, বাবা তাদের মা বলে সম্বোধন করতেন এবং অত্যন্ত সম্মান করে কথা বলতেন। এটা অন্য কিছু না, দরিদ্র মানুষদের সমাদর করা, তাদের করুণা না করা এই জিনিসটা আমি বাবার কাছে শিখেছিলাম। আমি যে গণসংগীতে এসেছি এর পেছনের প্রেরণা বা স্পৃহা হিসেবে কাজ করেছে এগুলো। বীজ হিসেবে কাজ করেছিল।
এর ফলে আমি স্বচ্ছন্দে দরিদ্র্য মানুষের বাড়িতে যেতে পারি। তারা দেখি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আমি তো তাদের মতো করে মানুষই হইনি। সত্যি কথা বলতে কী আমাকে উচ্চমধ্যবিত্ত বলা যেতে পারে। তারপরও কিন্তু আমি তাদের সাথে কথা বলতে গেলে আমি কতগুলো ধাপ নিচে নেমে কথা বলছি এরকম আমার কখনও মনে হয় না।
আমরা করুণা করতে পারছি তা কিন্তু নয়। এই দারিদ্র্য একটা অভিশাপ। একে দূর করতে হবে। এবং এর জন্য যারা দায়ী তাদের সঙ্গে প্রয়োজনে সংগ্রাম করতে হবে।
আলমগীর: গনসঙ্গীত ও প্রতুল কি এক সত্তা, কীভাবে মাপবেন?
প্রতুল: সঙ্গীত একটা মস্ত বড় ইউনিভার্স। তার মধ্যে নানা ধরনের শ্রেণিবিভাজন হতে পারে। গণসঙ্গীত অনেকটা গণতন্ত্রের মতো, 'অব দ্যা ম্যাস, ফর দ্যা মাস, বাই দ্যা মাস'—বলেও একে বলা যায়। মানুষের জন্যে, মানুষের গান, মানুষের পক্ষের গান। এখন বাই দ্যা পিপল বা গণসঙ্গীত দুই প্রকার। একটা হচ্ছে ব্যপ্ত মানুষের সৃষ্ট গান। আরেকটা হচ্ছে ব্যপ্ত মানুষের জন্য সৃষ্ট গান। আমরা কিন্তু সেদিক থেকে যারা ব্যপ্ত মানুষ যারা বঞ্চিত-শোষিত মানব, তাদের ঠিক অংশ নই। কিন্তু আমরা যখন গান করি তাদের জন্যে গান করি।
আরেকটা ব্যাপার যেটা হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছিলেন, দেশপ্রেমের গান, দেশের জন্য ভালোবাসার গান বা দেশের জন্য ভালোবাসার নদী যখন আন্তর্জাতিকতার সাগরে গিয়ে উপনীত হয় তখনই দেশভক্তির গান গণসঙ্গীতে পরিণত হয়। এ রকমের সংজ্ঞা তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার সংজ্ঞা, গণসঙ্গীত হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যগত ভক্তিসঙ্গীতের একটি শাখা নদী। আমাদের দেশে যে ইশ্বরের প্রতি ভক্তিচিন্তা ঘুরতে থাকে, তাদের জন্য যে গান, এর একটি ধারা হচ্ছে গণসঙ্গীত। তবে এখানে যে ইশ্বর, সে ইশ্বরের চোখ, মুখ, হাত, পা সব আছে। সেই ইশ্বর জীবন্ত। সেই ইশ্বর সারা পৃথিবীতে পরিব্যপ্ত। এবং সেই ইশ্বর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বঞ্চিত, শোষিত, অত্যাচারিত। তার প্রতি ভক্তি সঞ্চারিত হয় যে গানে, যাকে নিয়ে সারা পৃথিবী।
যারা আমাদের ভাত দেয়, যে চেয়ারে বসে আছি সেই চেয়ারটা দেয়, যে বইটা পড়ি তার কাগজ দেয়। আমাদের প্রত্যেকটি জীবনের প্রত্যেক মুহূর্তের যে কণা সমস্ত কিছুর জন্য যারা দায়ী, যারা সেই সৃষ্টিটা করছে, তার প্রতি ভক্ত না হবো তো কার প্রতি হবো। তার মানে আমাদের জনভক্ত হতে হবে। তার মানে এই আমরা যে নিচ্ছি এটা একটা বিরাট ঋণ। ১০ হাজার টাকা দিলেই ভাত পাওয়া যাবে না, ভাতটা তো তৈরি করতে হবে। তার মানে তারা স্রষ্টা। তারা জমিতে ফসল ফলায়। না ফলালে তো হবে না। তারাই আমার ইশ্বর। ওরা যদি একদিন উৎপাদন বন্ধ করে দেয় আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। এই চিন্তাটা যদি আমাদের মধ্যে থাকে তাহলে যারা একেবারে শুধু কমিউনিজমে বিশ্বাসী তারাই শুধু গণসঙ্গীত গায় এরকম কথা বললে হবে না। আপনার মনে রাখবেন কার্ল মার্কস, গান্ধী, হো চী মিন এরা যদি না জন্মাত তাহলেও এ সমস্ত গরীবেরা তারা কিন্তু সংগ্রাম করতো। তারা একটা প্রকরণ করে দিয়েছেন মাত্র, এভাবে করলে ঠিক ঠিক করে এমন একটা বিশ্ব তৈরি হবে। যেখানে অসাম্য বা বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু ঐ মতাদর্শী বা শাস্ত্রজ্ঞ নয় বলে আমরা জনগণকে ভালোবাসতে পারবো না, এরকম যে মৌলবাদী চিন্তা সেই মৌলবাদী চিন্তার বিরুদ্ধেও কিন্তু লড়তে হবে। কমিউনিজম মানে এই না যে তুমি কমিউনিজমের এ, বি, সি, ডি এসব সূত্র মানো না, এজন্য তুমি জনগণকে ভালোবাসতে পারো না। সত্যিকারের কমিউনিস্টরা এরকম কথা কখনও বলে না।
—————————————————————–
'উই শ্যাল ওভার কাম' এটা চার্চের গান। নিগ্রোদের বা অশ্বেত বর্ণ তাদের যে সমস্ত গান, প্রতিবাদের গান সেগুলো সব স্পিরিচুয়াল। আমরা অনিরিশ্বরবাদী সংস্কৃতির ধারক-বাহক হতে পারি। কিন্তু এর বিপরীতে যে ধারণা বা সংস্কৃতি আছে তা থেকে যে সমস্ত সুন্দর সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোকে আমরা যদি আগাছা বলে বাদ দিয়ে দেই তা হবে না। আমরা যদি রামায়ণ, মহাভারত না পড়ি, আমরা যদি কবি কঙ্কণের চণ্ডি না পড়ি তাহলে আমরা কিসের কমিউনিস্ট হবো।
—————————————————————-
'উই শ্যাল ওভার কাম' এটা চার্চের গান। নিগ্রোদের বা অশ্বেত বর্ণ তাদের যে সমস্ত গান, প্রতিবাদের গান সেগুলো সব স্পিরিচুয়াল। আমরা অনিরিশ্বরবাদী সংস্কৃতির ধারক-বাহক হতে পারি। কিন্তু এর বিপরীতে যে ধারণা বা সংস্কৃতি আছে তা থেকে যে সমস্ত সুন্দর সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোকে আমরা যদি আগাছা বলে বাদ দিয়ে দেই তা হবে না। আমরা যদি রামায়ণ, মহাভারত না পড়ি, আমরা যদি কবি কঙ্কণের চণ্ডি না পড়ি তাহলে আমরা কিসের কমিউনিস্ট হবো। সত্যিকারের কমিউনিস্টরা বৌদ্ধদের সঙ্গে লড়ে, খ্রীস্টানদের সঙ্গে লড়ে, তারা শত্রুকে চিহ্নিত করে। এবং সমস্ত ব্যাপক মানুষকে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে। সুতরাং এটা একটা ভক্তির কাজ। ভক্তি মানে কী? নিজেকে ভক্ত করো, বিভক্ত করো এবং এর একটা বড় অংশ,একটা কনসেপ্ট, একটা ধারণার প্রতি নিবদ্ধ করো।
নিজেকে বাঁচিয়ে যা তোমার বাঁচে তা জনের প্রতি বা গণের প্রতি অর্পণ করো, নিবেদন করো। এই যে নিবেদন এটা ভক্তিগীতিরই একরকম অংশ। এই নিবেদন কিন্তু গণসঙ্গীতেরই অংশ। এটা একটা ধারাবাহিকতা, বিবর্তন। আগে যেটা ছিল সেটাকে বাদ দিয়ে তো পরেরটা হয় না। দেখা গেলো আমি যাই করি না কেন শেষ পর্যন্ত আমাকে মানুষ গণসঙ্গীত শিল্পী বলেই মনে করে। কারণ একটা সময়ে একটা বিক্ষোভের সময়ে আমি তাদের জন্য গান লিখলাম। আমি যেটুকু লেখাপড়া করেছি যেটুকু সুর আয়ত্ত করেছি সমস্ত কিছু নিয়োজিত করেছি তাদের জন্য গান লিখে সুর দিয়ে। তাদের সামনে গান গেয়ে। আমি তখন সরকারী অফিসার ছিলাম, এ সমস্ত বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে আমার ব্যাপক অংশগ্রহণ সম্ভব ছিল না। সে জন্য যেটা হতো, আমি গান তৈরি করতাম। আর একঝাক যুবক-যুবতী আমাকে ঘিরে থাকতো, তারা আমার গান শুনতো শিখতো তারপরে তারা ছড়িয়ে দিতো। কেউ জানতো না যে ওগুলো আমার গান। এই ব্যাপারটা কিন্তু খুব কম লোকের হয়, গানগুলো চলে যাচ্ছে, কিন্তু আমি রাস্তা দিয়ে গেলে কেউ জানে না যে, এই গানগুলো এই লোকের লেখা।
আলমগীর: একুশে ফেব্রুয়ারি বা আমাদের ভাষা আন্দোলন আপনাকে কতটা প্রভাবিত করেছে। যখন আপনি বলছেন, আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই…?
প্রতুল: দেখুন, একদম সত্যি কথা বলবো। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তখন সেইভাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রচারিত হয় নি। ১৯৫২ সালে আমি যতদূর জানি পশ্চিমবঙ্গ তাদের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে, এত বড় একটা ঘটনা তখন পূর্ববঙ্গে ঘটে গেছে, তার কিছু কিছু খবর নিশ্চয়ই পৌঁছেছে। কিন্তু সেটা জনমানুষকে উদ্বেল করতে পারেনি। লজ্জার কথা। কিন্তু পারেনি আমার মনে হয়। ভাষা আন্দোলন নিয়ে নানারকম সভাসমিতি পরে হয়েছে, ভাষিক অধিকারের কথা, এইসব চিন্তাগুলো বেশি করে হয়েছে ষাটের দশকের সময় থেকে। কিছু কিছু পান্নালাল দাশগুপ্ত, এমন কিছু মানুষ যাদের বাংলাদেশের সাথে ভালো যোগাযোগ ছিলো, তারা ছোট ছোট সভা করে বলতেন যে, 'এরা এরকম করে নিজের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রাণ দান করেছে।' আসলে আমাদের ভেতর এরকম একটা বিষয় ছিল যে 'আমাদের বাংলার আর কী হবে, আমাদের এখানে তো আর উর্দু-টর্দু হচ্ছে না।' কিন্তু পরে দেখা গেল আমাদের বাংলাকে পশ্চিমবঙ্গে উৎখাত করার একটা চমৎকার চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে ১৯৬১-তে শীলচড়ে যখন ভাষা আন্দোলন হলো মানে অহমিয়াকে জোর করে চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে যখন ওখানকার বাংলাভাষীরা প্রতিবাদ করলো তখন আমরা বাহান্ন নিয়ে আরো বেশি চিন্তা করতে লাগলাম। ভাষিক অধিকারের জন্যে, ভাষার মর্যাদার জন্যে পর পর কুড়ি-পচিশ জন তাদের জীবন দিল। কেননা ভাষা দিয়েই তো আমাদের চেনা যায়, ভাষার মর্যাদাই তো আত্মমর্যাদা। এই চিন্তাগুলো আমাদের মধ্যে হলো এবং 'একুশে' নাম দিয়ে আমাদের ওখানে কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি হলো। কিন্তু ১৯৫২ সালে, আমার তখন ১০ বছর বয়স, তখন আমাদের বাড়িতে ভালো করে খবরের কাগজ আসতো না। আমার সন্দেহ আছে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার কোন পাতায় কতটুকু দখল করেছিলো।
আলমগীর: তবে আপনার গানে কিন্তু '৫২-র ভাষা আন্দোলনের সেই প্রাণের কথাগুলোই এসেছে…।
প্রতুল: গানটা তো আমি লিখেছি ১৪০০ সালে। ইংরেজী ১৯৯৩।
আলমগীর: স্লোগান দিতে গিয়ে, আমি চিনতে শিখেছি নতুন মানুষ জন… এই গানে যেমন আপনি মানুষ চেনার কথা বলেছেন তেমনি আপনার গণসংগীত শিল্পী হয়ে ওঠার কথাও বলেছেন।
প্রতুল: ১৯৬৯-এ আমার বিপ্লবী গানগুলো, মানুষের মুখে মুখে ছড়াতো। তখন আমার তো অজ্ঞাতবাসের মতো হয়ে গিয়েছিল। নাটকের গান করতাম, কেউ আমাকে চিনতো না। আমাকে সবাই চিনতে আরম্ভ করলো যে এই লোকটাই সেই লোকটা, যার গান আমরা সন্ধেবেলা জেলে গাইতাম। এইসব ভাবে যখন আমাকে চিনতে পারলো তখন বিভিন্ন জায়গায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। ১৯৮২ সালে যখন আমার পুনরাবিষ্কার হলো এরকম একটি জায়গায় পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় পোস্টার অথবা কবিতা নামে একটি কাব্যগ্রন্থ আমাকে দিয়েছিলেন। শারদ সংখ্যায় তার একটা কবিতা বেরিয়েছিলো, 'স্লোগান দিতে গিয়ে আমি চিনতে শিখি নতুন মানুষ জন।' এই গানটা আমি সেদিনই করি, যেদিন আমি বইটা পেয়েছিলাম। পার্থ পরে বলেছিলো আমার কবিতাকে গানে পরিণত করার মতো লোক আমি পেয়ে গেছি। তার এই কবিতা নিয়ে আমি এমন চার্জড হয়েছিলাম, সাধারণত এরকম কথা তো হয় স্লোগানধর্মী। তখন স্লোগানকে একটু যেন তিরস্কারই করা হতো। এর সাথে আরেকটি কথা বলতে চাই। এটা শুনলে ইশ্বরবাদীরা একটু খেপে যেতে পারেন। সেটা হচ্ছে ভক্তিতন্ত্রে, মন্ত্র বা জপ যে কাজ করতো তারই বিবর্তিত রূপ স্লোগান।
আমাদের চিন্তার সারাৎসারকে একটা ছোট বাক্যে পরিণত করে ঠিক যেমন যারা ইশ্বরভক্ত তারা মন্ত্র পড়েন বার বার মন্ত্র জপ করেন, একইভাবে আমরা ওই স্লোগানটা যখন করি তখন আমাদের চিন্তার সারাৎসার ওই কতগুলো বাক্যে সংহত হয় এবং যখন আমরা বলি 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' তখন আমরা বলি বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, এটা হচ্ছে আমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডের সারাৎসার। সেটা হচ্ছে মন্ত্র। বৌদ্ধরা মন্ত্র পড়ে। কেউ জপমালা দিয়ে মন্ত্র পড়ে। সেটা কী। আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে নানা রকমের চিন্তা তো সব সময় আক্রমণ করছে, এই মন্ত্র কী করে সেই সমস্ত বৈষম্যমূলক চিন্তাগুলোকে, বিরোধী চিন্তাগুলোকে আশার পথে দারোয়ানের মতো বাধা দেয়। এই জন্যে স্লোগানটা দেওয়া দরকার হয়।
আলমগীর: আলু বেচো, ছোলা বেচো… লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচো না… আপনার গানে লাল স্বপ্ন না বেচার কথা বলেছেন। কিন্তু উপমহাদেশের প্রলেয়তারিয়েত বিপ্লবের স্বপ্ন কি আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারছি?
প্রতুল: দেখুন লাল টুকটুকে স্বপ্ন বা লাল রংটা এইটা যে একেবারে সমাজতন্ত্রীরা পুঁজিপতিদের মতো কুক্ষিগত করেছে তা তো নয়। লাল টুকটুকে স্বপ্ন মানে সূর্যোদয়ের স্বপ্ন। এই অন্ধকার কেটে যাবে এবং সারা আকাশ লাল হয়ে উঠবে। এটা তো প্রথমেই একেবারে ব্যাপক সমাজতন্ত্র হবে তা না। শোষণ, বঞ্চনা থাকবে না এটা যে কোনো মানুষের কাছেই তো ইপ্সিত। এটার জন্য যে কোনো একটা পার্টির সদস্য হতে হবে এবং এখানে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, এইভাবে মনে হয় মানে… বই করার মতো মানে করাটার কোনো মানে হয় না। বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচো না-এর মানে হচ্ছে এখনকার আমাদের নিজেদের মনে, নিজেদের দেশে নানা জায়গায় অন্ধকারাচ্ছন হয়ে আছে। আরো একটা কথা মনে রাখবেন, অন্ধকার কথাটার মানে কিন্তু কোথাও আলো নেই তা নয়। এখন আমরা যেটা দেখছি সেটা হচ্ছে, তীব্রতম আলোর অন্ধকার। যা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। অন্ধকার কথাটার মানে হচ্ছে, যা অন্ধ করে। আলোর অভাব যেমন মানুষকে অন্ধ করে, অতিরিক্ত আলোয় মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, তখনও মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। এখন চলছে দু'রকমের অন্ধকার। এক রকমের অন্ধকার হচ্ছে যেখানে আলোর অভাব, যেখানে গ্রামে দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, পানিয় জলের অভাব, সমস্ত কিছুর অভাব। আরেকটা হচ্ছে একটা কৃত্রিম আলো যা আপনার পক্ষে সহনীয় নয়, সেই আলোটা আপনার ওপর এমন করে ফেলা যাতে করে আপনি অন্ধ হয়ে যান, সত্যিকারের জিনিস দেখতে না পান। এই যে অন্ধকার, আলোর ধাঁধার অন্ধকার–এই দুটো অন্ধকার কেটে গিয়ে সত্যিকারের সূর্যোদয়ের আলো, সেই আলোর কথা বলা হচ্ছে। সেই আলো সমাজতন্ত্রের মধ্যে দিয়েও হতে পারে অথবা প্রত্যেকের প্রতি সহনশীল একটা ভালো গণতন্ত্রের মধ্য দিয়েও হতে পারে।
আলমগীর: আপনি মাও সে তুং-এর কবিতা অনুবাদ করে গেয়েছেন, 'কীসের ভয় সাহসী মন, লালফৌজের লাফিয়ে হই পার… ভারতের লালফৌজ—মাওবাদীদের অবস্থা কী?
প্রতুল: মাওবাদীরা গরীবদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে এটা সত্যি। তারা ভালো করছে কি খারাপ করছে এটা আমি বলতে পারবো না। আসলে এই জায়গাগুলো ওরা (সরকার) দখল করতে চায়। তারপরও জায়গাগুলো তো দখল করতে পারবে না ওরা। নানা রকম আইন আছে। সরকার মাওবাদের নাম করে সাধারণ মানুষকে পেটাতে পারে। তোমরা ওদের সাহায্য করছো এই বলে। এটা করলে অপারেশন পুশব্যাক হয়। মানুষগুলো সেখান থেকে সরে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে ওই জায়গাটা দখল হয়ে যাবে। পরে ওটা বহুজাতিকের হাতে তুলে দেয়া হবে। একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ব্যাপার থাকলে এদের সুবিধে হয়। এরকম করে দেশের স্বার্থের কথা বলে তারা জঙ্গল দখল করে নেবে। পরে এই সব টাটা, বিড়লা কি বলে বেদান্ত নাকি যারা আদিবাসীদের পাহাড় উজার করে পাহাড়ের তলায় বক্সাইটের দখল চায়।
আলমগীর: মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সরকার নাশকতা, মানুষ হত্যার অভিযোগ তুলে বিভিন্ন অপারেশনে নেমেছে?
প্রতুল: হত্যাকাণ্ড আমি সমর্থন করি না। তবে যে জন্য ওরা টেরোরিজম করছে অর্থাৎ ভাত, কাপড়, রুটি, চিকিৎসা এগুলোর যদি নিশ্চয়তা থাকতো তাহলে কিন্তু ওরা টেরোরিজমে আসতো না। কিন্তু সেটা তো সরকারের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য হলো জঙ্গল হাসিল করে সেটা বহুজাতিকদের হাতে দিয়ে দেয়া।
আলমগীর: স্বদেশ এখন ছালছোলা এক ছাগল… এই গানের মাধ্যমে আপনি বিশ্বায়নের আগ্রাসন, আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের কথা বলেছেন। পরিস্থিতি কি বদলেছে?
প্রতুল: এই গান আপনি শুনেছেন। আমার মনে হয় কোনো দেশই ছালছোলা ছাগল হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। এটা শুধু আমাদের দেশ না। সেটা একটা বিকাশশীল দেশ যেখানে তথাকথিত নতুন মডেলে যাদের উন্নয়ন হয়নি। তাদের উন্নয়নের নামে এই ছালছোলা হচ্ছে। এটা বিশ্বব্যাপী একটা ষড়যন্ত্র। আমি বলবো না এটা এখানে হচ্ছে, ওখানে হচ্ছে। নেম ওয়ান কান্ট্রি সেখানে হচ্ছে। তারা একুশ শতকটাকে নিজেদের করে নিতে চায়। তারা যেখানে সস্তা শ্র্রম পাবে, যেখানে পরিবেশকে রক্ষা করার মতো আইন থাকলেও সেই আইনকে গুড়িয়ে দেয়া যেতে পারে শধু টাকার জোরে, সেই সমস্ত জায়গায় তারা যাবে। এবং স্বদেশকে পেটি ছাগল হিসেবেই ভাববে। এবং ছালটি ছুলে সমস্ত মাংস ভাগ করে নেবে। এই সমস্ত রাষ্ট্র যারা বিশ্বের ছালটা ছুলে মাংস ভাগ করতে চায় তারা কখনও নিজেদের বলে টপ সেভেন, কখনও বলে জি-৭। এইটা কিন্তু একটা খুব খাটি সত্য কথা।
আলমগীর: বাংলাদেশ আপনার মনস্তত্ত্বে কীভাবে বাস করে?
প্রতুল: আমার মনস্তত্ত্বে তো বাংলাদেশ নেই। আমার মনস্তত্ত্বে বাংলা আছে। কতগুলো মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই দেশভাগটা করেছিলো। এতে তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি হয়েছে। আবার এখন যখন বাংলাদেশ হয়েছে তখন কিছু কিছু মানুষ আছে তারা রি-ইউনাইট ও রি-ইউনিফিকেশনের কথা বলছে। আমার মনে হয় যেটা হয়ে গেছে, সেটা হয়ে গেছে।
তবে অন্তত সংস্কৃতির দিক থেকে, অন্তরের দিক থেকে আমরা একজন আরেক জনকে তো আপন ভাবতেই পারি। কিছু দেয়া নেয়ার মধ্য দিয়ে, আমাদের মধ্যে যে সৌহার্দ্য থাকার কথা ছিলো সেটা টিকিয়ে রাখতেই পারি। শুধু পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ কেন আমরা যে কোনো দেশের মানুষের সঙ্গে আমাদের ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতেই পারি। তার জন্য যেটা করা উচিত সেটা হচ্ছে, নিজের সংস্কৃতিটাকে একেবারে শ্রেষ্ঠ মনে না করে সমস্ত সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
'আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়, মিশে তেরো নদী সাত সাগরের জল গঙ্গায় পদ্মায়'—এই কথা দিয়ে আমি বলতে চেয়েছি যে কোনো জায়গায়, যে কোনো বড় সংস্কৃতি তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, মনোযোগী হওয়া। এভাবে আমরা যদি কিছু গস্খহণ করতে পারি এবং তার মধ্যে বর্জনীয় অংশগুলো বাদ দিতে পারি, তাহলে সমস্ত মানুষ একদিন একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে এক হতে পারে। এবং দেখাও তো যাচ্ছে, সমস্ত দানবের বিরদ্ধে বিশ্বের সমস্ত দেশ একসাথে হচ্ছে, সমস্ত অত্যাচারের হেডকোয়ার্টারকে তারা তো 'না' বলছে। এতগুলো লোক যে 'না' বলছে এবং তারা দেশ কাল সীমানার কথা ভাবছে না। এটা তো অন্ধকারের মধ্যে একটা বিশাল আশার আলো।
আলমগীর: আমরা যে স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা বলি… বাইরে থেকে আপনি যতটা বাংলাদেশকে বোঝেন সেই বোঝার জায়গা থেকে কেমন বাংলাদেশ আপনি চিন্তা করবেন?
প্রতুল: সেটা বলা আমার জন্য অন্যায় হবে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে প্রায় মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করতে হয় সেটা হলো, 'আমি জানি না।' এটা আপনারাই ঠিক করবেন, আপনারা বাংলাদেশের জনগণ। আপনারা তো চালিকাশক্তি। সরকার যদি ভাবতে জানে জনগণই হচ্ছে চালিকাশক্তি, তাদের ইচ্ছাকে রূপায়ণই আমাদের কাজ, তাদের ব্যাপক রূপায়ণই আমাদের (সরকার) কাজ, তাহলেই হবে।
এখন আমি শুনতে পাই 'ইনক্লুসিভ ইকোনমি'র কথা। এর মানে হচ্ছে ওপরের তলায় যারা আছে, যারা সমস্ত ভোগ করছে, যাদের ছেলে ৫'শ টাকায় ব্রেকফাস্ট খায় তারা তো এই ইকোনমির মধ্যে থাকবেই। এর সাথে গরীবদেরও ইনক্লুড করতে হবে। এটা কী রকম কথা। সমাজের উঁচু তলার ১৫ জন তো থাকবে আর ৮৫ জনকে ভাই একটু ইনক্লুড করা হবে এর সাথে। কিন্তু যা হওয়া উচিত ৮৫ জন থাকবে ১৫ জনকে তাতে ইনক্লুড করতে হবে। তবে ১৫ জনকেও তাড়িয়ে দিও না, তাদের থাকতে দেও। দেশটা হচ্ছে এই ব্যাপক ৮৫ শতাংশের। তারা পানীয় জল পায় না। খাদ্য পায় না। শিক্ষা পায় না। বস্ত্র পায় না, আচ্ছাদন পায় না, তাদের সংস্কৃতির বিকাশ পায় না। তাদের সংস্কৃতি মুক্ত করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে, তাদের সংস্কৃতিকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে, তাদের যে শিক্ষা সেটাকে অপ্রয়োজনীয় করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এরাই তো ইতিহাসের চালিকাশক্তি। এই ইতিহাসের চালিকাশক্তিকে অবজ্ঞা করে যদি কেউ মনে করে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো, তাহলে কিন্তু তারা ঠিক জায়গায় যাচ্ছে না।
আলমগীর: এবার আপনার ব্যক্তিজীবনে উঁকি দিতে পারি কি?
প্রতুল: ব্যক্তিগত জীবন, যতখানি সমষ্টিগত জীবনে মিলিয়ে দিতে পারি ততই ভালো। এমন একটা সময় আসবে যখন আমরা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নিশ্চয়ই ভাববো, কিন্তু সেটা সবাইকে বলার মতো কিছু হবে না। আমরা সমষ্টির প্রতি অনুরক্ত থাকবো। আমরা থাকবো 'উই শ্যাল বি লোনলি অ্যামং দ্যা ক্রাউড।' একজন মানুষ যখন সৃষ্টি করে তখন তাকে কিছুক্ষণ একা হয়ে থাকতে হয়। কিন্তু সেই একা হয়ে থাকার ফলে সেই সৃষ্টিটা যখন সমস্ত মানুষের সম্পত্তি হয়ে যায় তখন মনে হয় এই কিছুক্ষণ একা থাকাটা সার্থক হয়েছে।
আলমগীর: অনেকদিন পর বাংলাদেশে এলেন, কেমন লেগেছে?
প্রতুল: বিষয়টা যেন আমার নতুন গানের মতোই, 'দুইজনায় বাঙালী ছিলাম/ দেখো দেখি কাণ্ডখান/ তুমি এখন বাংলাদেশী/ আমারে কও ইন্ডিয়ান… চল মন মা বাবার ভূমি/ দেখি নিজের ভাই বোনে/ শুনছি নাকি তারা আজো/ এই পাগলের গান শোনে।' আমি আসলে আমার বাড়িতে এসেছি। এটাই মনে হয়েছে। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে এসে এখানকার মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। কিন্তু এর চেয়েও আমার ভালো লেগেছে যে গান গাইতে গিয়ে দেখেছি, এমন এমন গানের জন্য অনুরোধ এসেছে, আমার সাথে গলা মিলাচ্ছে যা শুনে আমি অবাক হয়েছি। প্রতুলের গান এখানে শোনা হয়। যাওয়ার সময় তাই খুবই খারাপ লাগছে।
আলমগীর: ধন্যবাদ।
প্রতুল: আপনাকেও ধন্যবাদ।