Published : 31 Jan 2025, 01:19 PM
রাস্তা বন্ধ করে দাবি আদায়ের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে কয়েক মাস ধরে, সেই আন্দোলনকারীদের সড়ক থেকে উঠিয়ে দিতে বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা কোনো ধরনের বল প্রযোগ বা লাঠিচার্জ করবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাত আলী।
সেক্ষেত্রে আন্দোলনকারীরা যেন রাস্তা না আটকায় সে বিষয়ে তিনি 'বিনীত অনুরোধ' করেছেন বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার সাজ্জাত আলী।
শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে বইমেলার নিরাপত্তা নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেছেন তিনি।
সরকার পতনের পর থেকে দাবি আদায়ে যখন তখন পূর্বঘোষণা অনুয়ায়ী বা ঘোষণা ছাড়াই রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট শাহবাগের মোড় বা মহাখালীর রাস্তা আটকে বিভিন্ন পক্ষের অবস্থান কর্মসূচির ফলে তীব্র যানজট তৈরি হচ্ছে প্রায় নিয়মিতই। এতে করে শহরের মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকছে না।
এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, "এটা খুবই দুঃখজনক। আমি অনেকবার অনুরোধ করেছি কেউ যেন রাস্তা না আটকায়। কিন্তু প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটছে। তবে আমরা ব্রিটিশ পুলিশ না। আমরা এদেশের পুলিশ হয়ে এ দেশের মানুষের উপর লাঠিচার্জ করতে পারি না। আমি আমার সকল কলিগকে বলে দিয়েছি কেউ যেন লাঠিচার্জ না করে।”
একদিন আগেও সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার ক্যাম্পাসের সামনের সড়ক আটকে কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি অনশন কর্মসূচিও চলতে থাকে।
অবরোধের কারণে মহাখালী থেকে গুলশান পর্যন্ত সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাতভর অবস্থানের পর শিক্ষার্থীরা ভোরে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়ায় ওই পথে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।
এক সাংবাদিক জানতে চান, রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলনকেন্দ্রিক জনভোগান্তি দূর করতে পুলিশ নির্বিকার থাকছে কেন?
ডিএমপি কমিশনার বলেন, “আমি আপনার পয়েন্টটা বুঝতে পারছি। আপনাদের মাধ্যমে এর আগেও আমি রিকোয়েস্ট করছি যে ঢাকা শহরে ট্রাফিকের অবস্থা বড় ভঙ্গুর-নাজুক। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। আমি নিজেও কষ্ট পাই। যে আমার মানুষগুলো এই শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তার মধ্যে আটকে থাকে। ২০টা লোক একটা ছোট দাবি নিয়ে রাস্তায় গিয়ে ব্লক করতেছে। আমি অনেকবার বাই দিজ টাইম আমার আড়াইমাসে অনেকবার কয়েকবার রিকোয়েস্ট করছি। প্লিজ ছোটখাট দাবি-দাওয়া নিয়ে আমরা মানুষের চলাচলের রাস্তাটা দয়া করে বন্ধ করবেন না। আপনারা ফুটপাথে থেকে দাবি-দাওয়া আদায় করেন, মানববন্ধন করেন। কালকে রাতে ১০টা-১১টার সময় গার্মেন্টস কর্মীরা বেতন পায় না রাস্তা বন্ধ করে দিছে।"
ডিএমপি কমিশনার কথায়, এটা খুবই দুঃখজন ঘটনা যে সব ধরনের দাবি-দাওয়া জানানোর জন্য মোক্ষমস্থল হয়ে গেছে রাস্তা বন্ধ করা।
মানুষের দুর্ভোগের কয়েকটি চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, “একটা লোক অ্যাম্বুলেন্সে অসুস্থ হয়ে আসতে পারছে না। একজন বৃদ্ধ মানুষ বা একজন নারী তিনি যেতে পারছেন না। উত্তরা থেকে রওনা করে মতিঝিল পৌঁছাতে সাত ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে- হরিবল কন্ডিশন। সো আমি রিকোয়েস্ট করতেছি সবাইকে।”
জুলাই-অগাস্টে সরকার পতনের আন্দোলন দমাতে ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ উঠে। অন্তর্বর্তী সরাকার ক্ষমতায় আসার পর ঢেলে সাজানো পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনাও করা হয়।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, “আমি বিনীতভাবে অনুরোধ করতেছি। পট পরিবর্তনের পরে আমাদের পেশাগত দায়িত্ব এবং কর্মধারা পরিবর্তন করছি। আমি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি, আমার আইজিপি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন যে আমার পুলিশ আপনাদেরকে মারতে চায় না, আমরাও মরতে চাই না। আমাদের বাণী এখন একটাই। আমরা এদেশের লোক, আমরা কাউকে মারতে চাই না। আমি কোন ব্রিটিশ পুলিশ কমিশনার না।
“আমার ডাইনে-বায় আমার সহকর্মীরা কেউ ব্রিটিশ না। আমি ব্রিটেন থেকে আসি নাই। আমি কোন কলোনিয়াল পুলিশ কমিশনার না। আমি কলোনিয়াল পুলিশ কমিশনারের মত আচরণ করতে পারবো না। রাস্তার মধ্যে আমার লোককে লাঠি দিয়ে পেটাতে আমি চাই না।”
তাহলে কমিশনারের নির্দেশ অমান্য করে কী করে এবতেদায়ী শিক্ষকদের উপর পুলিশ লাঠি চালালো জানতে চাইলে কমিশনার বলেন, "সেখানে কোনো লাঠিচার্জ করা হয়নি। শুধু জলকামান ব্যবহার করা হয়েছে। কোথাও লাঠিচার্জ হবে না- আই অ্যাম টেলিং মাই পিপল। আমি প্রতিদিন অফিসারদের ট্রেনিং দিচ্ছি, আমার ট্রেইনার আছে, আমি লাঠিচার্জ করেবো না। আমি এদেশের লোক, এদেশের মানুষের ওপর আমি লাঠিচার্জ করব না।"
গত ২৬ জানুয়ারি জাতীয়করণের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে বের হওয়া এবতেদায়ী শিক্ষকদের পদযাত্রাটি শাহবাগ এলাকায় পৌঁছালে তাতে বাধা দেয় পুলিশ। শিক্ষকরা ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে লাঠিচার্জের পাশাপাশি কাঁদুনে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়।
এ ঘটনায় এক নারীসহ মাদ্রাসার ৫ জন শিক্ষক আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. ফারুক।
কদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘাতের সময়ও লাঠিচার্জ করা হয়নি জানিয়ে কেবলমাত্র রক্তক্ষয়ী সংঘাত এড়াতে কিছু কাঁদুনে গ্যাস এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার।
“আপনারা দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজের ঘটনা হোল নাইট চলেছে। আমি সারারাত কিছুক্ষণ পরপর বলছি কোনোভাবেই কোনো লাঠি ইউজ হবে না। আমি কোনো লাঠি ইউজ করি নাই। যখন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে তখন এটা করেছি। আমি তো ছেলেদের নীলক্ষেত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দিতে পারি না। দিলেই তো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হত।”
শহরের যানজট নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীকেও কিছুটা দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে সাজ্জাত আলী।
“সো আপনাদের মাধ্যমে আমার রিকোয়েস্ট। আমি ঢাকাবাসীর পুলিশ কমিশনার, আমার পবিত্র দায়িত্ব সবার নিরাপদে রাখা। ট্রাফিকও আমার নিয়ন্ত্রণে। সেখানে এই নাজুক ট্রাফিক অবস্থার মধ্যে প্রতিদিন দিনে-রাতে ইভেন আজকে শুক্রবার আজকেও দেখেন কতোগুলো প্রোগ্রাম। কেউ পুলিশ হেডকোয়ার্টার ঘেরাও করবে, আরও আছে প্রোগ্রাম। রাস্তায় যদি সবাই প্রোগ্রাম করে তাহলে কীভাবে সম্ভব আমাকে বুঝায় বলেন। আপনি এখানে দাঁড়ান আপনি আমার দায়িত্বটা নেন।
এবারের বইমেলায় রাতেও পুলিশ ‘সমানতালে পাহারা দিবে’ জানিয়ে কমিশনার বলেন, "রাতেও আমাদের অফিসাররা এই কন্ট্রোল রুমে থাকবেন। পুরো বিষয়টা তদারকি করবেন।"
এর আগের বছরগুলোতে বইমেলা চলার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত সড়কটি যান চলাচলের জন্য একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়। মেলার প্রবেশে বা ওই রাস্তা দিয়ে দোয়েল চত্বরের দিকে যাতায়াতের জন্য ওইটুকু রাস্তা পায়ে হেঁটেই যেতে হয়।
এবার সেই কাজের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, “এ বছর শহরের ট্রাফিকের অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে, এই সড়কটি প্রয়োজন অনুযায়ী বন্ধ করে দেওয়া হবে, অন্য সময় খোলা রাখা হবে।"
ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের স্মৃতিতে শনিবার শুরু হতে হচ্ছে বইমেল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস শনিবার বিকাল ৩টায় বইমেলার উদ্বোধন করবেন।
২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন বইমেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলা শুরু হবে সকাল ৮টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।