Published : 14 May 2024, 10:07 AM
“ভাঙাচোরা সড়কের এই দুর্ভোগ অসহ্য লাগে। ছয় মাসের বেশি সময় ধরে বাড়ির সামনে থেকে ভিতরে পুরোটা রাস্তাই খোঁড়াখুঁড়ির পর আধভাঙা পড়ে আছে। বৃষ্টির দিনে তো এই রাস্তায় চলাচলই করা যাবে না”- মোহাম্মদপুরের কাঁটাসুর এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলামের কথায় স্পষ্ট ক্ষোভ।
মোহাম্মদপুরের টিক্কাপাড়া এলাকায় কোনো গলি তিন মাস আগে, আবার কয়েকটিতে নতুন করে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে।
এ এলাকায় কথা হলো রিকশাচালক ফারুক মোল্লার সঙ্গে। রাস্তা অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিরক্ত হয়েই বলেন, “এইহানের কোনো গল্লিই মনে হয় বাদ যাইব না।”
মঙ্গলবার বেলা ১২টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোড, নূরজাহান রোড, বিজলী মহল্লা, আজিজ মহল্লা, টিক্কাপাড়া, নবদয় হাউজিং, মোহাম্মদী হাউজিং সোসাইটি, কাঁটাসুর থেকে জাফরাবাদ হয়ে রায়ের বাজারের গদিগর পর্যন্ত দেখা গেছে, বেশিরভাগ সড়কই খোঁড়াখুঁড়ি শেষে পড়ে আছে এবড়ো-থেবড়ো অবস্থায়।
রিং রোডের টিক্কাপাড়া ও কাদেরাবাদ এলাকার বেশ কয়েকটি সড়কে নতুন করে শুরু হয়েছে কাটাকাটির কাজ। কিছু সড়কে ফেলা হচ্ছে ইট, বালু, সুড়কি।
মোহাম্মদপুরের প্রায় প্রতিটি এলাকায় দেখা গেছে রাস্তাগুলো মাঝ বরাবর সরু করে কাটা হয়েছে। সড়কে একটু পরপর তৈরি হয়েছে গর্ত। চলছে পুরো রাস্তা বন্ধ করে বড় বড় পানির পাইপ বসানো হচ্ছে, রাস্তার এক পাশ কেটে বৈদ্যুতিক লাইন ও ফুটপাতের নিচের নালা সংস্কারের কাজ চলছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫ এর পাঁচটি ওয়ার্ডের (২৯, ৩০, ৩১, ৩৩ ও ৩৪) বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রতিদিনই চলাচল করতে হচ্ছে এসব রাস্তা দিয়ে।
কিন্তু বেহাল রাস্তাগুলো বর্ষার আগে সংস্কার করা না হলে বড় ধরনের দুর্ভোগে পড়ার আশঙ্কা করছেন বাসিন্দারা।
নূরজাহান রোডে পয়ঃনালা নির্মাণের কাজ শুরু প্রায় চার মাস আগে। মঙ্গলবার পর্যন্ত দেখা গেছে এই সড়কের সব কাজ শেষ হয়নি। সড়কের কিছুটা অংশে প্রাথমিক কার্পেটিং করা হলেও বাকি অংশ ভাঙাচোরা। এই সড়কের আশপাশের বিভিন্ন অলিগলিও কাটা হয়েছে।
তাজমহল রোডের একপাশের ফুটপাতের কাজ শেষে শুরু করা হয়েছে অন্যপাশের নালা সংস্কার। নূরজাহান রোডের শুরুর অংশ থেকে শিয়া মসজিদ পর্যন্ত নালার ওপর ঢালাইয়ের কাজ চলছে।
রিং রোডের টিক্কাপাড়ার ‘এফ’ ব্লকে বন্ধ ভাঙা একটি সড়কে পড়ে ছিল বিশাল একটি রোলার। এই সড়কের অন্য অংশে পুরোটা জুড়ে রাখা হয়েছে ইট, বালু, সিমেন্টের বড় বড় পাইপ।
সেখানে ফুটপাতে টাইলস বসানোর কাজ করছিলেন হামিদ মিয়া। তিনি বলেন, “রাস্তা বন্ধ আছে চার মাসের মতো হইব। বেশি কথা কওন যাইব না।”
এই এলাকার বাসিন্দা তুহিন ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বড় বড় পানির পাইপ, বৈদ্যুতিক লাইন, ড্রেন, ফুটপাতের কাজ এক সঙ্গে হয়েছে। এখন সুড়কি ফেলেছে। কিছুদিন আগে তো বাসা থেকে বের হওয়ার অবস্থাও ছিল না।”
টিক্কাপাড়ার আরো দুইটি সড়কে নতুন করে কাটাকাটি করতে দেখা গেছে। অন্য একটি সড়ক এক সপ্তাহ আগে পুরোটা কেটে রাখা হয়েছে বলে জানান কয়েকজন বাসিন্দা। বাসা-বাড়ি ও দোকান থেকে বের হতে কাঠের তক্তা ব্যবহার করছেন মানুষ।
আজিজ মহল্লার একটি গলির এক পাশ লম্বা করে কেটে রাখা হয়েছে প্রায় দুই মাস। ফলে সরু রাস্তাটি হয়েছে আরও সরু। এই গলিটি অনেকেই আদাবর, শেখেরটেক, রিং রোডে যাওয়ার রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করেন। ফলে ভাঙা সরু রাস্তায় যানজট লেগেই থাকে।
বিজলী মহল্লার দুইটি সড়কে কাজ চলতে দেখা গেছে। একটি সড়কে সুড়কি ফেলছিলেন শ্রমিক বাতেন শেখ।
কাজ করতে করতে বললেন, “কাজ মাঝে বন্ধ আছিল। আবার চালু হইছে। এহন এই ভাঙ্গা রাস্তা দিয়াই অনেকে গাড়ি লইয়া যায়।”
সড়কটিতে মটরসাইকেল ওয়াশে আসা বাপ্পি আহমেদ বলেন, “ভাঙা রাস্তা দিয়ে বাইক চালালে পিঠ, কাঁধ, মাথা ব্যথা হয়। এছাড়া বাইকের সাসপেনশন বা শক এবজরবারও দ্রুত নষ্ট হয়। বারবার বাইক সার্ভিসিং করাতে হয়।”
নবদয় হাউজিংয়ের ‘বি’ ব্লকের চারটি গলিতে খোঁড়াখুঁড়ি ও কাটাকাটি শেষে সুড়কি ফেলে রাখা হয়েছে। একটি রাস্তার ফুটপাতে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। রাস্তার মাঝ বরাবর বড় বড় স্লাবের উঁচু অংশে আটকে যাচ্ছে রিকশা, গাড়ির চাকা।
মোহাম্মদী হাউজিং সোসাইটির ৫, ৭ ও ১১ নম্বর সড়ক পড়ে আছে ভাঙাচোরা। ৭ নম্বর সড়কে সুড়কি ফেলা হলেও ১১ নম্বর সড়কে এবড়োথেবড়ো করে মাটি কেটে রাখা হয়েছে।
প্রায় আট মাস ভাঙা পড়ে আছে ব্যস্ততম কাঁটাসুরের দীর্ঘ সড়কটি। কাটাকাটির পর সুড়কি দিয়ে প্রাথমিক কার্পেটিং করা হলেও পুরো রাস্তা বিভিন্ন স্থানে আবার আড়াআড়িভাবে কাটা হয়েছে। ফুটপাতের পাশে কয়েক ফুট রাস্তাও কাটা। ফলে পাশাপাশি দুইটি গাড়ি চলার জায়গা নেই।
কাঁটাসুরের শুরু থেকে রায়েরবাজার পর্যন্ত পুরো রাস্তার একই অবস্থা। এর মধ্যে কাদেরাবাদের ৩-৪টি গলি কাটার পর বন্ধ আছে প্রায় ৬ মাস। কয়েকটি গলিতে চলছে মাঝ বরাবর ম্যানহোল ও স্ল্যাব ঢালাইয়ের কাজ। নতুন করে কাটা হয়েছে একটি গলি।
কী হবে বর্ষায়
পঞ্জিকা ধরে বর্ষা আসতে এখনো দেরি থাকলেও বৈশাখের এ সময়ে কয়েকদিন ধরেই হুটহাট বৃষ্টি হচ্ছে। মধ্য জুন থেকে মধ্য অগাস্ট পর্যন্ত পুরোদমে থাকবে বৃষ্টি। ফলে সড়কের ভাঙাচোরা ও খানাখন্দ স্বাভাবিকভাবেই বাড়াবে ভোগান্তি।
নবদয় হাউজিংয়ের ‘বি’ ব্লকের বাসিন্দা হোসনে আরা বাচ্চাকে নিয়ে ভাঙা সড়ক দিয়েই রিকশায় প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসা করেন।
তিনি বলেন, “বৃষ্টির আগে সড়ক ঠিক না হলে কোনোভাবেই চলাচল করা যাবে না। একটু বৃষ্টি হলেই ইটের সুড়কি আর বালু ধুয়ে যাবে। তখন গর্ত আর ভাঙার মধ্যে কীভাবে চলব?”
২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ সলিমউল্লাহ বাসিন্দাদের ভোগান্তির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, “আমার এলাকায় ওয়াসার কাজ, বিদ্যুতের কাজ হচ্ছে। এখনো কাজ শেষ না হওয়ায় বাসিন্দাদের ভোগান্তি বেড়েছে। তাই অনেকবার তাগিদও দিয়েছি।
“কিন্তু বড় ধরনের খোঁড়াখুঁড়ির কাজ তো আমার এলাকায় তেমন নেই। তবে রাস্তার মাঝে আড়াআড়িভাবে অনেক জায়গায়তেই কাটা হয়েছে। এই ভাঙা এখন গর্তে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের ভাঙা অনেক বেশি, যা সব বয়সী মানুষের যাতায়াতেই কষ্ট তৈরি করছে।”
বড় ধরনের খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে না বলা হলেও ওয়ার্ডের টিক্কাপাড়া এলাকায় গত মঙ্গলবার তিনটি সড়কে নতুন করে খোঁড়াখুঁড়ি করতে দেখা গেছে।
বিষয়টি জানানো হলে কাউন্সিলর সলিমউল্লাহ বলেন, “না না বড় বা নতুন কোনো খোঁড়াখুঁড়ি আমার এলাকায় হচ্ছে না।”
বর্ষা শুরুর আগে সব কাজ শেষ হওয়ায় সুযোগ আছে কিনা এবং না হলে ভোগান্তি কমাতে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বড় তেমন কাজও বাকি নেই আমার এলাকায়। আশা করি বর্ষার আগেই কাজ শেষ হবে। আমি সিটি করপোরেশনের সঙ্গেও কথা বলেছি এ বিষয়ে।”
সড়কের বেহাল অবস্থা নিয়ে ৩০, ৩১, ৩৩ ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের একাধিকবার ফোন করা হলেও তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি।
কেন দীর্ঘসূত্রতা?
খোঁড়াখুঁড়ি ও রাস্তার উন্নয়নকাজের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে কথা হয় ডিএনসিসি অঞ্চল-৫ এর নির্বাহী প্রকৌশলী নূরুল আলমের সঙ্গে।
তিনি বলেন, “আমাদের কাজের সেশন মূলত জুন থেকে জুলাই। এই এক বছরের মধ্যেই আমরা সড়ক মেরামত ও অন্য সব ধরনের কাজ শেষ করি। তবে বৃষ্টি-বাদলের সমস্যা ও ঠিকাদাররা দেরি করলে অনেক সময়ে কাজ শেষ হয় না।
“তবে আমাদের মোটামুটি সব ধরনের কাজই শেষ। সামনের জুনের মধ্যে টপ ফিনিশিং বা প্রথম লেয়ারের কাজ শেষ হবে। তাজমহল রোড, জাকির হোসেন রোড, নূরজাহান রোডে প্রথম লেয়ার দেওয়া হয়েছে।”
যেসব সড়কে নতুন করে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে তা নিয়ে এই প্রকৌশলী বলেন, “টিক্কাপাড়াসহ যেসব এলাকায় নতুন করে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে তা বেশিরভাগ ওয়াসা ও ডিপিডিসির কাজ। তাদের কাজে পুলিশের অবজারভেশন থাকে, হাউজ কানেকশন, প্রেসার টেস্ট ইত্যাদি কারণে সময় বেড়ে যায়।
“সড়ক মেরামতের দায়িত্ব আমাদের হলেও কাজ শেষ না হওয়ায় লেয়ারিং দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনেক সড়কে আবার প্রথম লেয়ারিং দেওয়ার পর নতুনভাবে সরু করে কাটা হয়েছে। ফলে সড়ক ভাঙাই থেকে যাচ্ছে।”