Published : 29 Jun 2025, 09:13 PM
রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যেসব প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো একমত হতে পারেনি সে সব বিষয় তারা পুনর্বিবেচনা করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ।
রবিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “যে সব দল এখনো বিভিন্ন প্রস্তাবে সম্মত হয়নি, আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে তাদেরকে অনুরোধ করেছি, তাদের পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ আছে কিনা।
“আশা করছি, যে সব দল এখন পর্যন্ত যে বিষয়গুলোতে একমত হতে পারছে না, তারা এগুলো পুনর্বিবেচনা করবে।”
এদিনের আলোচনার বিষয় ছিল সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি, দ্বিকক্ষ সংসদ, উচ্চকক্ষের নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন আবার আলোচনায় বসবে বুধবার।
আলী রীয়াজ দাবি করেছেন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট করার জন্য অধিকাংশ দল মতামত দিয়েছে।
তিনি বলেন, “কিছু কিছু দল এই বিষয়ে সুস্পষ্ট আপত্তি জানিয়েছে। দ্বিকক্ষ সংসদ গঠনে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নীতিগতভাবে একমত। কিছু কিছু দল সামান্য কারণে আপত্তি জানিয়েছে। সব রাজনৈতিক দল যেহেতু দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট গঠনে নীতিগতভাবে আগ্রহী, সেক্ষেত্রে ভোটগ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একমত হতে পারবো।
“যেসব দলের এই বিষয়ে আপত্তি আছে তার জানিয়েছে, আবারও এসব বিষয় নিয়ে তারা আলোচনা করবে।”
ঐকমত্য কমিটির সহসভাপতি বলেন, “জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল-এনসিসি গঠন করার জন্য। প্রস্তাবের পর অনেক রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবটি সমর্থন করছে না। তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ‘সংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি’ নামে নতুন কমিটির করার প্রস্তাব করেছিলাম। সেখানে এনসিসির যে সব দায়দায়িত্ব ছিল, তা সীমিত করে কাঠামোগত দিক পরিবর্তন করা হয়।”
বৈঠকে কমিটির নতুন কাঠামোগত দিক নিয়ে আলোচনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “নিয়োগ কমিটি সুনির্দিষ্টভাবে ছয় কমিশনের প্রধান ও সদস্য নিয়োগ, আইনের দ্বারা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান কাজ করবে।”
এ কমিশনগুলো হল- নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি কর্ম-কমিশন, মহা হিসাব নিরক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন।
এনসিসির নাম বদলে যে কমিটির প্রস্তাব করা হয়েছে, সংসদ বহাল থাকলে তা কীভাবে কাজ করবে ও তার গঠন কী হবে-এ বিষয়টিও তুলে ধরেন আলী রীয়াজ।
যখন সংসদ বহাল থাকবে না, তার মানে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে তখন কী হবে, এই বিষয়টি স্পষ্ট করার প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের দিক থেকে প্রস্তাব ছিল কমিটি বহাল রাখার। এই কমিটির সদস্য পরিবর্তন করে বিরোধী দলের যেসব সদস্য ছিল, তাদের পরিবর্তে উপদেষ্টা পরিষদের একজন করে প্রতিনিধি দেওয়া। আলোচনা যেটি স্পষ্ট হয়েছে, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যারা এই কমিটিকে সমর্থন করে, তারা মনে করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে এই কমিটি বহাল রাখার প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, বৈঠকে প্রশ্ন ওঠে, ওই সময় নির্বাচন কমিশনে কীভাবে নিয়োগ হবে- আলোচনা করে অনেকে প্রস্তাব করেছেন এ দায়িত্ব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে সীমিতভাবে দেওয়া যায়। অন্য কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়কের হাতে ক্ষমতা থাকবে না।
এনসিসির প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের স্পিকার, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার এবং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে উভয়কক্ষের কোনো একজন সংসদ সদস্য এনসিসিতে থাকবেন।
বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বিরোধিতায় ঐকমত্য কমিশন একটি নতুন প্রস্তাব দিয়েছে। সেখানে এনসিসির নাম বদলে 'সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি' করার কথা বলা হয়েছে।
আর কমিটির কাঠামো থেকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। সংশোধিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী, নিম্ন ও উচ্চকক্ষের স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা, প্রধান বিরোধী দল ব্যতীত অন্যান্য দলসমূহের একজন প্রতিনিধি, রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি (আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত যোগ্যতাসম্পন্ন), প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত আপিল বিভাগের একজন কর্মকর্তা এ কমিটিতে থাকবেন। কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করবেন নিম্নকক্ষের স্পিকার।
আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা বলেছি সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি ও প্রজাতন্ত্রের কর্মে লিপ্ত, এমন ব্যক্তি নয়, মনোনয়নের আগে ১০ বছর কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না বা কোনো সংগঠনের সদস্য নয়, এমন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন।”
তিনি বলেন, “প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধির ক্ষেত্রে আমরা বলেছি তার মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিকে রাখতে। কমিটির সভাপতিত্ব করবেন নিম্নকক্ষের স্পিকার।
“এই কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে বোঝা যায়, এই ধরনের একটি কাঠামোর ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমর্থন আছে। কাঠামোগত ক্ষেত্রে আরেকটু আলোচনা ও সুস্পষ্ট হওয়া দরকার।”
কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় দফার সপ্তম দিনের বৈঠক শুরুর আগে তিনি জুলাই সনদ প্রণয়নে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা চেয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ।
তিনি বলেছেন, “আর একদিন পর জুলাই মাস। কমিশন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি- আমরা আন্তরিক থাকতে চাই, জুলাই মাসের মধ্যেই যেন আমরা একটি জাতীয় সনদে উপনীত হতে পারি। সেই প্রচেষ্টায় আমাদের একটা স্বপ্ন ছিল।
“আমরা আশা করেছিলাম- আবু সাঈদের শাহাদাত বার্ষিকীতেই সকলে মিলে সনদে স্বাক্ষর করতে পারব। সেটা কতটা সম্ভব হবে তা আপনাদের ওপর নির্ভর করছে। আমরা খানিকটা শঙ্কিত যে, সে জায়গায় যাব না। তবে এটা আমরা বলতে পারি জুলাই মাসের মধ্যে এই প্রক্রিয়াকে একটা পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে হবে।”
আলী রীয়াজ বলেন, “গত সাতদিন ধরে আমরা আলোচনা করেছি। বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রগতি হলেও সত্যি কথা হচ্ছে, আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির ক্ষেত্রে আমরা খানিকটা পিছিয়ে আছি।”
তিনি বলেন, “এই অগ্রগতির জায়গাটা অর্জন করা দরকার এই কারণে- আমরা কেউই চাই না আগের জায়গাটায় ফিরে যেতে। এটা আগামীকাল, আগামী দিনের বিষয় না। এটা দীর্ঘদিনের বিষয়।
“আমাদের লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত হব। যে ব্যবস্থা ফ্যাসিবাদী শাসনকে তৈরি করেছে, তার কাঠামোগত পরিবর্তনগুলো আমাদের করতে হবে। এই সংকল্প থেকে সমস্ত কিছু পাশে রেখে আমরা সমবেত হয়েছিলাম। আপনাদের কর্মীরা প্রাণ দিয়েছেন, নিপীড়ন সহ্য করেছেন। সেই রক্তের ওপর পা রেখে আমরা এখানে এসেছি।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, “কমিশন আপনাদের প্রতিপক্ষ না। কমিশন আপনাদেরই অংশ, আমরা একটা দায়িত্ব পালন করছি মাত্র। আপনাদের অবস্থানের কারণে কমিশনের নমনীয়তা প্রকাশিত হয়েছে। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই- আপনারাই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। আপনাদের মধ্য দিয়েই একসময় দেশ শাসিত হবে।
“৭০ অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে কমিশনের যে প্রস্তাব ছিল সেখান থেকে কমিশন আলোচনার মধ্য দিয়ে সরে এসেছে। স্থায়ী কমিটিগুলোর বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাব ছিল এক রকম, কিন্তু আমরা আলোচনার মধ্য দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত এক জায়গায় এসেছি, সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।”
আলী রীয়াজ বলেন, “উচ্চকক্ষের বিষয়ে দুটি প্রস্তাব ছিল। এর মধ্যে একটি, ১০৫ জন সদস্যের মধ্যে পাঁচজনকে রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন দেবেন। আপনারা এই বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন। সঙ্গতভাবে কমিশন এই জায়গা থেকে সরে এসে ১০০ জন সদস্যের উচ্চকক্ষ তৈরির বিষয়ে একমত হতে পেরেছি।
“মূলনীতির ক্ষেত্রে কমিশনের কিছু প্রস্তাব ছিল সংবিধান সংস্কার কমিশনে। সেখানে আমরা আলোচনা করেছি, অনেকটা অগ্রসর হয়েছি। আরও আলোচনা করব।”
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত অক্টোবরে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিনের প্রতিবেদন জমা পড়ে ফেব্রুয়ারি মাসে। এসব প্রতিবেদনের সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
তারা সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত জানতে চায়- যাদের মধ্যে ৩৩টি মতামত জানায়।
এরপর ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত তাদের সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশনের মাধ্যমে প্রথম পর্বের সংলাপ সম্পন্ন করে ঐকমত্য কমিশন।
আলোচনার সুবিধার্থে কয়েকটি দলের সঙ্গে একাধিক দিনও বৈঠক চলে। আলোচনার মধ্য দিয়ে বেশ কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য ও আংশিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে কমিশনের তরফে জানানো হয়।
কোরবানির ঈদের আগে প্রথম ধাপের আলোচনা শেষে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনার জন্য ২ জুন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসেছিল ঐকমত্য কমিশন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ঈদের পর শুরু হওয়া আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
আরও পড়ুন: