Published : 10 Jul 2025, 08:15 PM
উত্তরপত্র মূল্যায়নে ‘বিশেষ নির্দেশনা’ না দেওয়া, প্রশ্ন ফাঁস রোধে পদক্ষেপসহ কয়েকটি কারণে মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার আগের বছরগুলোর তুলনায় কমে এসেছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির প্রধান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির।
বৃহস্পতিবার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সম্মেলন কক্ষে মাধ্যমিকের ফলাফল নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে এসব কারণের কথা বলেন তিনি।
সামগ্রিক ফলে ধস নামার বিষয়ে এক প্রশ্নে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের এই চেয়ারম্যান বলেন, “এটাতো আসলে আমরা তুলনা করে বলছি, গতবারের তুলনায়, বা বিগত বছরগুলোর তুলনায়, কিন্তু ওই রকম কোনো লক্ষ্য আমাদের ছিল না যে, আমরা পার্সেন্টেজ এত করব, এটা বাড়াব বা কমাব- এই টার্গেট নিয়ে এই মিশনে আমরা যাত্রা করি নাই। আমাদের মিশন ছিল যে, পরীক্ষা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করব।”
তিনি বলেন, “পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে যেভাবে পরীক্ষা হওয়ার কথা, আমরা সেভাবে পরীক্ষাগুলো নেওয়ার চেষ্টা করেছি, আপনারা তার সাক্ষী।
“আমরা চেষ্টা করেছি, প্রশ্ন আউট হবে না এবং এমনভাবে মানুষ বিশ্বাস করবে যে, গুজবেও কান দেবে না। সেই রকম একটা পরিবেশ আমরা তৈরি করেছি, আপনারাও হয়ত লক্ষ্য করেছেন।”
উত্তরপত্র মূল্যায়নে বিশেষ কোনো নির্দেশনা না দিয়ে ‘যা প্রাপ্য’ তা দিতে বলার কথা তুলে খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, “যখন শিক্ষকরা যখন উত্তরপত্র নিতে আসেন, তখন উনাদের প্রশ্ন ছিল আমাদের কোনো নির্দেশনা আছে কি-না? আমরা বলেছি যে, আমাদের নির্দেশনা বিশেষ কোনো নাই। নির্দেশনা, আপনারা শিক্ষক, সঠিকভাবে যা প্রাপ্য তা-ই দেবেন।
“যা প্রাপ্য হয়, তা দেবেন। এভাবে অর্থাৎ মূল্যায়ন পদ্ধতি যা হওয়ার, তা যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়ে আমাদের কাছে এই ফলাফলটি এসেছে।”
কোনো বিষয়ের প্রশ্ন ‘কঠিন হওয়ার’ কারণে কোনো কোনো বোর্ডে ফলাফল খারাপ হল কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কঠিন হয়েছে, সহজ হয়েছে- এগুলো আপেক্ষিক ব্যাপার। একই বোর্ডে একই প্রশ্নে কোথাও ভালো এবং কোথাও খারাপ হয়েছে।
বিগত সময়ে প্রশ্নপত্র মূল্যায়নে কারচুপি হয়েছিল কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি আগেই বলেছি, বিগত দিনের তুলনামূলক কোনো টার্গেট নিয়ে আমাদের মিশন ছিল না।”
‘প্রভাবশালীদের চাপে’ ভেন্যু কেন্দ্রের নামে ‘ছদ্মবেশে’ নিজেদের শিক্ষার্থীদের পরিদর্শক হিসাবে নিজেরা থাকার প্রথাও দূর করার কথা বলেন এহসানুল কবির।
তিনি বলেন, “ভেন্যু কেন্দ্র হল, নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের পাশের একটি স্কুলে নিয়ে গিয়ে নিজেরা ডিউটি দেওয়া… তার মানে, নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের নিজ স্কুলের শিক্ষকরা পরিদর্শন দেবেন না- এটার যে মূল স্পিরিট, সেখান থেকে তারা ছদ্মবেশে ধারণ পরিদর্শনে থাকত।
“সেখানে স্বাভাবিকভাবে ইনটেনশনটা বোঝা যায়। আমরা সেই ব্যাপারটা চেষ্টা করেছি, অল্প কয়েক জায়গায় পারিনি।”
ঢাকা বোর্ডে এমন ৮১টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭৩টি পরিবর্তন করে দেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ভেন্যু কেন্দ্র রাখি নাই। আগে ওই অঞ্চলে প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ ভেন্যু কেন্দ্র নিয়েছেন।”
তিনি বলেন, “এ বছর আমরা ক্যাডেট কলেজের পরীক্ষাও তাদের ভেতরে রাখিনি। পাবলিকের মধ্যে নিয়ে আসছি, প্রত্যেকটি জায়গায়, সারা বাংলাদেশে। ক্যাডেট কলেজগুলোর পরীক্ষাও আমরা বাইরে সাধারণ স্কুলে নিয়ে আসছি।”
প্রথমবারের মত এই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ক্যাডেট কলেজগুলো, তাদের ভালো শিক্ষার্থী, ভালো ব্যবস্থাপনা আছে। এটা এমনি বললাম, কিছু কিছু জায়গায় নিজ কেন্দ্রে ভেন্যু কেন্দ্র বানিয়ে নিজেদের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া, এটা ঠিক নয়।”
নকল রোধে নেওয়া পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা নকল রোধ করার ব্যাপারে, আপনাদেরও একটা ওয়াচ ছিল, স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী মাঠে আছি এখনও, তারাও ছিলেন। বোর্ডের টিম ছিল এবং আমাদের কিছু কেন্দ্র লাল-চিহ্নিত করা ছিল, আমাদের ধারণায়, সেই সব জায়গায় আমাদের টিমকে পুরো সময় আমরা অবস্থান করিয়েছি।
“এগুলোর প্রভাব যদি পড়ে… এগুলো আগের বছরও ছিল, কিন্তু কার্যকর হয়ত ছিল না, হয়ত শিথিল ছিল- আমরাতো অতীত জানি না, আমরা আমাদেরটা বলতে পারি।”
গত প্রায় ১৫ বছরের তুলনায় পাসের হার কম হলেও এটাকে করোনাভাইরাস মহামারীর আগের সময়ের ফলাফলের কাছাকাছি হওয়ার কথাই বলেছেন ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান।
পরীক্ষা পরিদর্শনে কঠোরতা আনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের জানা মতে, আমাদের পরিসংখ্যানে কোনো অত্যুক্তি নেই বা কোনো কঠোরতা, কঠিন কিছু নেই। আমরা সেই রকম কোনো নির্দেশনা শিক্ষকদের দিই নাই।
“আমরা পরীক্ষার আগে পরিদর্শকদের নির্দেশনা দিয়েছি, এমন কিছু বলা যাবে না, করা যাবে না, যাতে শিক্ষার্থীদের বিরক্তি তৈরি হয়।”
তিনি বলেন, “উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ ছিল যে, আপনারা শিক্ষক, আপনাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে, কোনটি সঠিক উত্তর, কোনটি ভুল উত্তর, কোনটি পূর্ণ মার্ক পায়, কোনটি শূন্য পায়, কোনটি আংশিক মার্ক পায়- এর সবকিছু আপনারা বিবেচনা করবেন।
“আপনারা বিষয়ে আপনি বিশেষজ্ঞ, আপনি সেভাবে মূল্যায়ন করবেন। ওভার মার্কিং, আন্ডার মার্কিং- এই ধরনের কোনো নির্দেশনা আমরা দিইনি। এই ছিল আমাদের মূল বার্তা।”
এক সাংবাদিক জানতে চান, বিগত সময়ে ৫৮ পেলে ৬০ বানিয়ে দেওয়া হত, ৭৮ পেলে ৮০ বানিয়ে দেওয়া হত- এবার কি সেখান থেকে সরে আসা হল কিনা।
উত্তরে ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, “এই বছর আমাদের এই রকম কোনো ব্রিফ করা হয় নাই।”
‘উপর মহল থেকে’ কোনো নির্দেশনা না থাকার কথা তুলে ধরে এহসানুল কবির বলেন, “এটাই মেসেজ। আমরা এই মেসেজটাই পরীক্ষকদেরকে দিয়েছি।
“‘আমাদের তরফ থেকে আপনাদের প্রতি বিশেষ নির্দেশনা নাই, অনুরোধ এইটুকু যে, আপনারা একটু সময় নিয়ে খাতাটা মূল্যায়ন করবেন। যথাযথভাবে মূল্যায়ন করবেন।’ এই ছেলেমেয়েদেরকে বেশি নম্বর দেওয়াও ক্ষতিকর, কম মূল্যায়ন করাও তার জন্য ক্ষতিকর। এখানে বৈষম্য হয়। যার যা পাওয়ার কথা নয়, যার যা পাওয়ার কথা- এই দুজন এক জায়গায় চলে আসে।”
বরিশাল বোর্ডে এত খারাপ কেন?
অতীতের ধারাবাহিকতা থেকে ছিটকে বরিশাল বোর্ডে পাসের হার সবার পেছনে চলে আসার বিষয়ে এক প্রশ্নে ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, “বরিশাল বোর্ডের বিষয়টি নিয়ে আরও নিবিড়ভাবে চর্চা করতে হবে আমাদের।
“প্রাথমিকভাবে আমরা যতটুকু বুঝতে পারছি, জানতে পারছি যে, ওখানে বোর্ডের অন্যান্য যে জেলাগুলো, জেলা সদরে খুব ভালো ভালো, প্রতিষ্ঠিত পুরোনো বিদ্যালয় আছে।”
সব বোর্ডেই শহরের বাইরে প্রতিষ্ঠানে ফল খারাপ হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ঢাকা মহানগরীতে পাসের হার ৮০ শতাংশের উপরে। যত দূরে যাব, কমতে থাকে। সর্বনিন্ম আছে ৬৮ শতাংশ।
“ঢাকা ছেড়ে যখন উপজেলায় যাচ্ছি তখন ৬৩ শতাংশ, যদি আরও অন্যান্য জায়গায় যাই, আরও কম। টাঙ্গাইল ৫৭ শতাংশ। এগুলো কিছু বিষয় থাকে।”
তিনি বলেন, “ঢাকায় বেশি হওয়ার কারণ হল, এখানে কিছু প্রতিষ্ঠিত, পুরোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এদের শতকরা হার সার্বিক হারটা ধরে রাখে, পাসের হার, জিপিএ-৫ এখানে বেশি, এখানে স্বাভাবিকভাবে পড়ালেখার মান ভালো।”
বরিশালে শহর এলাকার বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফল খারাপ হওয়ার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক এহসানুল কবির বলেন, “আমরা লক্ষ্য করলে বুঝতে পারব, বরিশাল অঞ্চল একটু নদী, খালবিল, রিমোট এরিয়া বেশি আছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিক না, খুব দুর্গম অঞ্চল- সেটা একটা দিক। ফলে এমন এমন জায়গা আছে, যেখানে শিক্ষকও যেতে চান না বা থাকতে চান না। আমরা মনে করি এই বাস্তবতাটা উঠে আসছে।
“এই বাস্তবতাটা মাথায় রেখে শিক্ষা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে পারবেন বলে আমাদের আশা।”