Published : 07 Apr 2025, 06:48 PM
লেগ স্টাম্পের বাইরের ডেলিভারি পুল করে ফাইন লেগে ধরা পড়লেন নাসির হোসেন। মাথা নিচু করে হাঁটা ধরলেন ড্রেসিং রুমের পথে। মুখটা একটু আঁধার হলো স্রেফ ওই সময়টুকুই। এছাড়া দিনজুড়েই তার চেহারায় খুশির ঝিলিক। নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তির দিন বলে কথা!
নিষেধাজ্ঞার দেড় বছরেও ক্রিকেট থেকে দূরে পরিবার নিয়ে আনন্দে ছিলেন বলেই জানালেন তিনি। ক্রিকেটে ফেরার দিনে সোমবার তাকে দেখা গেল চেনা রূপেই। মিরপুর শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামে ম্যাচ জেতার পর জার্সি বদল করে সতীর্থদের সঙ্গে মাঠে আড্ডায় মেতে উঠলেন। কিছুক্ষণ পর সংবাদমাধ্যমে মুখোমুখি হওয়ার জন্য আবার জার্সি পরে নিলেন।
ড্রেসিং রুম থেকে আসার পথে তার সঙ্গী সতীর্থ ক্রিকেটার মহব্বত হোসেন ও দলের আরেক সদস্য। দুজনের হাতে একটি করে মোবাইল দিয়ে তাদেরকে বললেন ভিডিও করতে। পুরোটা সময়ই ঝলমল করছিলেন হাসিতে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় দুর্নীতি বিরোধী আইনের তিনটি ধারা ভঙ্গের। গত বছরের জানুয়ারিতে আসে শাস্তির ঘোষণা। ছয় মাসের স্থগিতসহ দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় নাসিরকে। পরে দুর্নীতি বিরোধী প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা পূরণ করাসহ অন্য সব শর্ত পূরণ করায় স্থগিত নিষেধাজ্ঞা আর কার্যকর হয়নি তার। মাঠে ফেরার অনুমতি পান সোমবার থেকে।
মুক্তির দিনই রূপগঞ্জ টাইগার্স ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পেয়ে যান একসময় জাতীয় দলের নিয়মিত এই ক্রিকেটার। ফেরা দিনই নদুন বল হাতে নিয়ে ম্যাচের সূচনা করেন তিনি। বেশ কার্যকর বোলিংও করেন ৩৩ বছর বয়সী অলরাউন্ডার।
১০ ওভারে ৩১ রান খরচায় একটি উইকেট শিকার করেন। ব্যাটিংয়ে যখন নামেন, তার সামনে সুযোগ ছিল অপরাজিত থেকে ম্যাচ শেষ করার। জয় ছিল নাগালেই। তবে আউট হয়ে যান ১১ বলে ৯ রান করে।
নিষিদ্ধ হওয়ার আগে স্বীকৃত ক্রিকেটে সবশেষ ম্যাচটি প্রিমিয়ার লিগেই খেলেছিলেন নাসির। ফতুল্লায় ২০২৩ সালের ১৩ মে গাজী গ্রুপের বিপক্ষেই তিনি খেলেছিলেন প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে।
প্রায় দুই বছর পর স্বীকৃত ক্রিকেটে ফেরার আসরে তাকে দলে নিয়েছে অবনমন অঞ্চলে ঘুরপাক খেতে থাকা রূপগঞ্জ টাইগার্স। ম্যাচ জেতার পর সংবাদমধ্যমে নাসির বলেন, নিষেধাজ্ঞার সময়ে পরিবারের সংস্পর্শে বেশ ভালো ছিলেন তিনি।
“অবশ্যই (ক্রিকেটে ফিরে) ভালো লাগছে। একটা জিনিস মিস করছিলাম, ক্রিকেট খেলা। অনেক দিন পর ক্রিকেট খেলে তাই খুব ভালো লাগছে।”
“দেড় বছর (খেলার) বাইরে ছিলাম। বিন্দাস ছিলাম। আর কী বলব…(হাসি)। পরিবারের সঙ্গে ছিলাম। ভালো ছিলাম, আলহামদুলিল্লাহ। খেলা মিস করেছি ঠিক আছে। তবে পরিবারের সঙ্গে ছিলাম। ভালো ছিলাম।”
এতদিন পর ফিরে একটা নতুন শুরুর মতোই মনে হয়েছে তার কাছে।
“অভিষেক ম্যাচের মতো মনে হয়নি। অনেক কিছু নতুন নতুন লাগছিল। খেলার আগে যে প্রস্তুতি, প্রায় দেড় বছর পর আবার সেই প্রস্তুতি নিলাম। লাগেজ গোছানো, ব্যাগ গোছানো- একটু নতুন লাগছিল। ভালো লাগছিল যে এত দিন পর খেলব। যদি ভালো পারফর্ম করতে পারতাম, আরেকটু ভালো লাগত।”
ফেরার অভিযানে তেমন কোনো পরীক্ষায় পড়তে হয়নি নাসিরকে। মুক্তি পাওয়ার দিন থেকেই স্বীকৃত ক্রিকেটে খেলছেন তিনি। রূপগঞ্জ টাইগার্স ছাড়াও বর্তমান চ্যাম্পিয়ন আবাহনী লিমিটেড থেকেও প্রস্তাবও পান অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার। দুই পক্ষের চুক্তিতে বনিবনা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেখানে নাম লেখানো হয়নি তার।
নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তির দিনই মাঠে নামতে পারা বড় ব্যাপারই বটে। নাসির অবশ্য তার পরও নিজেকে দুর্ভাগা মনে করেন।
“মানুষ চাইলে সব কিছুই পারে। ফিরে আসা বলতে... দেড় বছর তো। আমি একটু দুর্ভাগা এই কারণে যে, আমার দেড় বছর (নিষেধাজ্ঞা) যেখান থেকে শুরু হয়েছে দুইটা মৌসুম মিস করে ফেলেছি। দুইটা বিপিএল আর এটাসহ দুইটা প্রিমিয়ার লিগ। তাই এদিক থেকে আমি দুর্ভাগা। যদি একটা মৌসুম মিস হতো, তাহলে ঠিক ছিল।”
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নাসিরের পদচারণা বন্ধ হয়ে আছে অবশ্য নিষেধাজ্ঞার অনেক আগে থেকেই। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের পর আর জাতীয় দলে খেলা হয়নি স্পিন অলরাউন্ডারের। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করে আবার আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফেরার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
“আমার মনে হয় যারা ক্রিকেট খেলে, জাতীয় দলে খেলার জন্যই খেলে। আমিও স্বপ্ন দেখি। এটা বিশ্বাস করি, এখনও সুযোগ আছে। যদি পারফর্ম করতে পারি অবশ্যই জাতীয় দলে খেলতে পারব। আপনি পারফর্ম করলে সেটার মূল্যায়ন যদি ক্রিকেট বোর্ড করে, তাহলে পারফর্ম করতে পারবেন।”
যে কারণে তিনি শাস্তি পেয়েছিলেন, সেটা নিয়ে অনুশোচনা আদৌ আছে কি না, তার কথায় তা বোঝা কঠিন। তার শৃঙ্খলার ঘাটতি, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, এসব নিয়ে নানা সময়ই অনেক অভিযোগ উঠেছে। অমিত সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হওয়ার ক্যারিয়ার যে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল, সেটির পেছনেও এসবের দায় দেন অনেকে।
তবে তার নিজের ভাবনা পুরোপুরিই অন্যরকম। তারকাদের যে একটু বেশি দায়িত্ব নিয়ে চলতে হয়, সে ধারণার সঙ্গেও তিনি একমত নন।
“কেয়ারফুল… আমি যেমন ছিলাম, ভালোই ছিলাম। খেলাধুলা নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না। ইনডিসিপ্লিনড ছিলাম না। খেলাধুলায় ফাঁকি মেরেছি- তাও নয়। আর আমার জীবন আমি কীভাবে লিড করব, সেটা আমার ব্যাপার। আমার জীবন তো আপনারা বলে দেবেন না। আপনি শুধু দেখবেন, আমি মাঠে কেমন আছি। আমি যদি মাঠের ক্রিকেটে কোনো কিছু খারাপ করে থাকি, তখন আপনারা বলতে পারেন।"
"(তারকাদের দায়িত্ব) এগুলো হচ্ছে ভুয়া কথা। তারকা-মারকা বলতে কিছু নেই। না খেয়ে থাকলে কেউ আপনারা এসে বলবেন না, ‘ভাই খান।’ এগুলো তাই কোনো কিছু নয়। আমি যেমন আছি, ভালো আছি। আমি আপনাদের মতোই মানুষ। আমারও জীবন আছে, পরিবার আছে।"