Published : 24 Jul 2010, 06:59 PM
আমি প্রথম কলকাতা যাই ১৯৮১ সালে। ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে আমরা পাঁচজন বাংলাদেশী ছাত্র আই. আই. টি. খড়গপুরে যাবার পথে মহানগরী কলকাতায় কয়েক দিনের জন্য থেমেছিলাম। মনে আছে আমাদের প্রথম রাতটি কেটেছিল কলকাতার প্রাণকেন্দ্রের অভিজাত এলাকা পার্ক স্ট্রিটে। ভোরবেলা ঐ বিখ্যাত সড়কের দোকানপাট দেখে আমরা বেশ মুগ্ধ হয়েছিলাম।
আর ঐ প্রথমবার বহুতল বিশিষ্ট এ্যাপার্টমেন্ট হাউজ দেখলাম – একটি নয়, অনেকগুলো। তখন ঢাকায় এর তুলনীয় একমাত্র ভবনটি ছিল আজিমপুরের চায়না বিল্ডিং, যে দালান দেখে আমরা হতবাক হয়ে ভাবতাম একটি দালানে এতগুলো পরিবার থাকে কী করে? ঐ বাড়িগুলোকে মনে হত মুরগীর খোঁয়ার বা কবুতরের খোঁপ। ত্রিশ বছর পরে বাস্তবতা হল ঢাকার বেশীরভাগ মানুষই ঐ মুরগীর খোঁয়ার বা কবুতরের খোঁপে বসবাস করছে। আর এ হল ঢাকার ত্রিশ শতাংশ লোকের কাহিনী, বাকী সত্তরভাগেরই কোন ভাল বাসস্থান নেই।
ষাটের দশকের গোড়া থেকে মানুষেরা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বসবাস করতে শুরু করে, শহরকে তারা মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারে নি, কর্মসূত্রে শহরে এলেও তাদের মন পড়ে থাকত ছায়াসুনিবিড় গ্রামে, সুযোগ পেলেই তারা গ্রামে চলে যেত। পরে তারা যখন ঢাকায় স্থায়ী বাড়িঘর বানানোর পরিকল্পনা করল, তাদের মস্তক জুড়ে রইল গ্রামের বাড়ির ছবি- সামনে বাগান, পেছনে পুকুর – ইত্যাদি। প্রথমদিকে ঢাকার বাড়িগুলোর দিকে তাকালে এমন চিত্রই দেখতে পাওয়া যেত। পরবর্তীতে একদিকে জনসংখ্যার বিপুল চাপ, অন্যদিকে জমির স্বল্প যোগানে তারা তাদের স্বপ্নকে সীমায়িত করে ফেলতে বাধ্য হয়।
প্রথমেই বাদ পরে বাড়ির পেছনের পুকুরটি, কিছুকাল পরে সমুখের বাগানটিও বিসর্জন দিতে হয়। আরো কিছুকাল পরে উচ্চবিত্তের স্নানাগারে বাথটাব ক্ষুদ্র পুকুরের তৃষ্ণা মেটালেও মধ্যবিত্তের জীবন থেকে পুকুর বা জলাশয় চিরতরে হারিয়ে যায়। আর বাগান উঠে আসে একচিলতে বারান্দা বা ছাদে, দুটি একটি গাছ লাগাবার সামান্য পরিসরও মেলেনা বাড়ির সমুখে। আবাসিক এলাকাগুলো হয়ে ওঠে সবুজশূন্য concrete jungle। যে বাঙালী ষাটের দশকে একক বাড়ি ছাড়া কিছুই ভাবতে পারত না, নব্বইয়ের দশকে, জনসংখ্যার বিপুল চাপ ও জমির মূল্যের রকেটগামীতা একক বাড়ি তৈরীর আকাশকুসুম ভাবনা থেকে তাকে সরে আসতে বাধ্য করে। জমি কেনার স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যায়, বা হয়ে ওঠে দুঃস্বপ্ন। এখন তাদের সর্ব্বোচ্চ আকাঙ্খা একটি মাঝারী বা ক্ষুদ্র মাপের এ্যাপার্টমেন্ট; তাও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। পুরোনো দোতালা বাড়িগুলো ভেঙ্গে ছয়তলা হচ্ছে, কোথাও বা দশতলা, একদিন হয়ত ছয়তলা ভেঙ্গে ত্রিশতলা ভবন নির্মিত হবে, আরো দূর ভবিষ্যতে ত্রিশ ভেঙ্গে ষাটতলা। আনুভুমিক বিস্তৃতি যেহেতু সম্ভব নয়, এখন ঘটছে আলম্বিক বিস্তৃতি। এই নির্মাণযজ্ঞ চলছে রাজধানীর সর্বত্র, প্রায় বিদ্যুৎগতিতে। আর ঐ একই গতিতে বাড়ছে নির্মাণসামগ্রীর দাম।
পুরো বাংলাদেশে মানুষ বাড়ছে জ্যামিতিক হারে আর ঢাকার দিকে মানুষ আইতাছে নাফ নদীর বানের লাহান। বাংলাদেশের জনসংখ্যা পনের কোটির বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে আর ঢাকার জনসংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে এক কোটি। এ শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ (৪.৫%)। ঢাকার একটি এলাকায়, যেমন মিরপুরে, যত সংখ্যক মানুষের বাস পৃথিবীর অনেক ক্ষুদ্রাকৃতির দেশ, যেমন ফারো আইল্যান্ড বা মরিশাশে এত লোক বাস করে না। অন্তত একটি দেশেই এত মানুষ নেই। কয়েক বছর আগে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে আমেরিকা থেকে এক প্রফেসর এসেছিলেন সামার কোর্স পড়াতে। তিনি এসেছিলেন মধ্য আমেরিকার এক জনবিরল, মূলত একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে গড়ে ওঠা নিরিবিলি শহর থেকে। ঢাকা শহরে মানুষের ভীড় দেখে তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে, সেমিস্টারটি শেষ না করেই তড়িঘড়ি তিনি আমেরিকা ফিরে যান। পরিসংখ্যান বড় চমকপ্রদ বিষয়। পরিসংখ্যান বলে বর্তমান বিশ্বের সাড়ে ছয়শ কোটি মানুষ যদি আমেরিকায় গিয়ে ঠাঁই নেয় তবু জনসংখ্যার ঘনত্ব বাংলাদেশের সমান হবে না। শিউরে ওঠার মত তথ্য, নয় কি?
জমি যেহেতু বাড়ানো সম্ভব নয়, তাই রাজধানীর আশে-পাশের খাল-বিল, নদী-নালা, জলাভূমি, নিচু জায়গা সব ভরাট করে সরকার ও ভূমিদস্যুরা একযোগে সব আবাসিক এলাকা গড়ে তুলছে। শহরের রাক্ষুসী থাবায় আশেপাশের গ্রামাঞ্চলগুলো উজার, ভয়ে তারা থরথর করে কাঁপছে। এই ভীতুদলে সম্প্রতি যোগ হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বনাঞ্চলগুলো। রেহাই মেলেনি ঢাকার আশেপাশের নদীগুলোরও। নদী দখল করে স্থাপনা – এ শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। লুটপাটের এমন স্বর্গ, দুর্বলের উপর সবলের এমন নির্লজ্জ আক্রমন বোধকরি পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। অবশ্য ঢাকাকে বাঁচানোর লক্ষ্যে বর্তমান সরকার আন্তরিকভাবেই ড্যাপ নিয়ে এগুচ্ছেন, যার বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুরা প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে, বিভিন্নপ্রকার উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে।
আমরা যতই বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলি না কেন, সত্যিকার অর্থে কোন প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ হয় নি। সকল কিছুই গড়ে উঠেছে রাজধানীকে ঘিরে আর নাগরিক সুবিধা, স্বাস্থ্য-শিক্ষার সুযোগ, বিনোদন বলতে যা কিছু এদেশে আছে, তা আছে কেবল ঢাকায়। কিছুটা ব্যতিক্রম বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। এর বাইরে পুর্ণ নগর বলতে কিছু নেই, প্রায় পুরোটাই মফস্বল। ফলে সকল জেলার বাসিন্দাগণ তাদের শেষ ঠাঁইটিও গড়ে তোলেন রাজধানীর বুকে। অথচ অবসর পরবর্তী জীবনটি তারা যদি নিজ নিজ জেলা সদরে কাটাতেন, ঢাকার উপর জনসংখ্যার এই অতিরিক্ত চাপ পড়ত না।
মাত্র কিছু বছরের ব্যবধানে ঢাকায় জমি ও ফ্লাটের দাম যে হারে বেড়েছে তা সকল অনুমান, যুক্তি ও হিসাব-নিকাশকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে। আমার ধারণা পৃথিবীর কোথাও আবাসনের দাম এত উচ্চ হারে বাড়ে নি। আমি উত্তরা এলাকায় আসি বছর সাতেক আগে; তখনও দেখেছি ৩ নম্বর সেক্টরে ফ্লাট বিক্রি হচ্ছে প্রতি বর্গফুট ১৫০০ – ১৮০০ টাকায়। মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে এখন প্রতি বর্গফুট বিক্রি হচ্ছে ৬০০০ – ৮০০০ টাকায়। অর্থাৎ দাম বেড়েছে চারগুন। অথচ এমন নয় যে মানুষের আয় ঐ হারে বা তার ধারে কাছে বেড়েছে। তবে হাঁ, কিছু কিছু মানুষের আয় ঐ হারের চেয়েও অধিক হারে বেড়েছে, আর তাদের কালো টাকা বিনিয়োগ হয়েছে অনুৎপাদনশীল খাত আবাসনে। যখন শুনি অমুক চল্লিশটি ফ্লাটের মালিক, তমুক দশটি বাড়ির জমিদার – তখন আশ্চর্য হই না। এই কালো টাকার মালিকদের কারণে ফ্লাট বা এ্যাপার্টমেন্টের দাম কমেনি বরং রকেটগতিতে বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশ থেকে পাঠানো অর্থ, কেন না ডলার, পাউন্ড বা রিয়ালের সাথে পাল্লা দেয়ার সামর্থ্য দুর্বল টাকার কখনোই ছিল না, হবেও না। আর ওসব দামী মুদ্রা টাকায় ভাঙ্গালেই ম্যাজিক হয়ে যায়।
একজন মধ্যবিত্তের যে আয় তা দিয়ে সারা জীবন সঞ্চয় করলেও ঢাকায় একটি ফ্লাট বা এ্যাপার্টমেন্ট কেনা সম্ভব নয়। একজন প্রথম শ্রেনীর সরকারী চাকুরে যে বেতন পান, সম্ভব নয় তা দিয়েও কোন বাড়ি কেনা। অর্থাৎ আয়ের সাথে এ্যাপার্টমেন্টের মূল্যের কোনপ্রকার সম্পর্ক নেই। আবাসন যেহেতু মানুষের মৌলিক চাহিদার অর্ন্তগত, আর একটি বাড়ি যে নিরাপত্তা দেয়, তার যে মনঃস্তাত্ত্বিক মূল্য – তাতে ফ্লাট বা এ্যাপার্টমেন্টের দাম কমবে বলে মনে হয় না, যদিও থাইল্যান্ড বা আমেরিকার মত রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় ধস্ নামাও অসম্ভব নয়। একটি বাড়ি নির্মাণ বা কেনা ফিনান্সিয়াল বিচারে দুর্বল বা বাজে বিনিয়োগ ছাড়া কিছুই নয়। উত্তরায় আমি যে এ্যাপার্টমেন্টে থাকি কিছু বছরের ব্যবধানে তার ভাড়া বেড়ে বর্তমানে আঠার হাজার টাকায় পৌঁছেছে। বাইশশত বর্গফুটের এই সেমি-ফার্নিশড বাড়িটি বর্তমান বাজার মূল্য এক কোটি টাকার উপরে, যে টাকা ব্যাঙ্কে রাখলে আমার বাড়িওয়ালা প্রতিমাসে কমপক্ষে নব্বই হাজার টাকা সুদ হিসেবেই পেতেন। অর্থাৎ তিনি আমাকে প্রতিমাসে বাহাত্তর হাজার টাকা ভর্তুকি দেন। এরপরেও মানুষ যে জীবনের সমস্ত সঞ্চয়, গ্রামে জমি বিক্রয় আর গহনা বন্ধকের টাকা নিয়ে রিহাব ফেয়ারে ছুটছেন – তা ঐ মনঃস্তাত্ত্বিক মূল্যের জন্যই।
এখন এই অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ঢাকার সকল নাগরিক ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়ছে। বিদ্যুতের ঘনঘন লোডশেডিং, পানি ও গ্যাসের সংকট, সুয়েরেজ উপচে পড়া, যত্রতত্র ময়লা আবর্জনার স্তুপ, সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা, অসহনীয় যানজট – এসবই ঐ অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ঘটছে। আমার এক কাজিন প্রায় কুড়ি বছর পরে ঢাকায় ফিরে প্রথমটায় বেশ অবাক, কেননা কুড়ি বছর আগে ঢাকায় হাতেগোনা ফ্লাট বাড়ি ছিল আর এখন তো এসব বাড়িই ঢাকার ল্যান্ডস্কেপ তৈরী করেছে। আমাকে একান্তে ডেকে একথাও বললো যে, গোটা শহরটিই তো দেখছি একটি বড়সড় ডাস্টবিন। আশ্চর্য হল এসব অসুবিধা সত্ত্বেও মানুষ বসবাসের জন্য ঢাকাকেই বেছে নিচ্ছে, আর এর পুরো ফায়দা লুটছে আবাসনবণিক ও ভূমিদস্যুরা – যারা কৈয়ের তেলে কৈ ভাজা বা পরের তেলে চরকা ঘোরাতে ওস্তাদ।
মাঝে মাঝে ভাবি পুরো দেশটাই না ঢাকা হয়ে যায়। পুরো দেশকে ঢাকা ঘোষনা করে দিলেও মানুষের স্রোত কেন্দ্রের দিকে বহমান থাকবেই। Megatrends বইতে লেখক John Naisbitt যে দশটি বৃহৎ বৈশ্বিক প্রবণতার কথা বলেন তার অন্যতম হল গ্রাম থেকে বৃহৎ শহরগুলোর দিকে মানুষের ছুটে আসা, আর পরিণতিতে ঐ শহরগুলোর মেগাসিটিতে পরিণত হওয়া। ঢাকা ভবিষ্যত বিশ্বের এক মেগাসিটিতে পরিণত হবে ইতোমধ্যেই তা অনুমিত, তবে তা বড় অস্বস্তিকর তথ্য। ঢাকায় 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ভরা সে তরী' অবস্থা বহুদিনের। এখন এই তরী শুধু ভরা নয়, ডুবে যাবার উপক্রম। এখনই স্ট্রাটেজিক প্ল্যান না নিলে অবস্থা হবে ভয়ঙ্কর। সরকারের ডিটেলড এরিয়া প্ল্যান (DAP) এ ব্যাপারে একটি শুভ উদ্যোগ ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। ঢাকা ইতোমধ্যে অচল নগরীতে পরিণত হয়েছে, আরো কিছুকাল পরে হয়ত আমাদেরকে এ শহর পরিত্যাগ করতে হবে। অত যে দামী আর সাধের সৌধসকল তখন তাদের কী পরিণতি হবে?