Published : 17 Jul 2021, 12:08 AM
গেল বছর থেকেই মুসলিম সমাজের ঈদের আনন্দ আয়োজন ফিকে হয়ে যাচ্ছে করোনাভাইরাস সৃষ্ট অতিমারীর হানায়। কোথায় মানুষ উৎসবে মাতবে, জান বাঁচাতেই গলদঘর্ম। এ অতিমারীর সবচেয়ে বাজে দিক হল, এটি মানুষের সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। তাকে বাধ্য করেছে স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় অনেকটা গৃহবন্দি জীবন যাপন করতে।
মানুষ যখন তার আধুনিকতম কলাকৌশল প্রয়োগে স্বল্পতম সময়ে টিকা আবিষ্কারের মাধ্যমে এ মারণঅণুজীবের ভয়ানক আক্রমণের রাশ টানতে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল, এটি তখন বারে বারে রূপ পাল্টে নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। রোজার ঈদে বিটা ভ্যারিয়েন্টের ধাক্কাটা তাও দেশ কোন রকমে সামলে নিয়েছিল। কিন্তু, এবারে কুরবানীর ঈদের প্রাক্কালে শুরু হওয়া ডেল্টার এ ভয়াবহ ছোবল কোথায় গিয়ে ঠেকে তা একমাত্র ভবিতব্যই বলতে পারে।
করোনাভাইরাস অতিমারীর সূচনার পর থেকে করোনাভাইরাসের আদি রূপ পরিবর্তিত হয়ে এযাবৎ অনেকগুলো মারাত্মক রূপ দেখা দিয়েছে, যেগুলো দেশে দেশে অতিমারী মোকাবেলায় বিজ্ঞানীদের আপাত সাফল্যকে বার বার ম্লান করে দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। এ ভ্যারিয়েন্টগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আলফা বা ইউকে ভ্যারিয়েন্ট, বিটা বা সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট, গামা বা ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট এবং সর্বশেষ ডেল্টা বা ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট। ধারণা করা হচ্ছে, ডেল্টা বা ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট এ ভাইরাসের সবচেয়ে ভয়ংকর সংস্করণ, কেননা এটি সবচেয়ে বেশি ছোঁয়াচে। এটি যে কতটা ধ্বংস–লীলা চালাতে পারে তার সাক্ষাৎ উদাহরণ পাশের দেশ ভারত। ডেল্টার ছোবলে ওদেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারে যে ক্ষিপ্র উর্ধ্বগতি দেখা দেয় তা এক অর্থে নজিরবিহীন।
বাংলাদেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এক রকম আগাম জানান দিয়েই এসেছে। পাশের দেশ ভারতে যখন এর ভয়াবহ তাণ্ডব চলছিল, তখন স্পষ্টতই অনুমিত হচ্ছিল বাংলাদেশে এর বিস্তার সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেখা গেল, শনাক্ত হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই প্রথমে খুলনা ও রাজশাহী অঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় এবং পরে খুব দ্রুত সারা দেশে এ ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অল্প সময়ের মধ্যেই অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করে। প্রথমবারের মতো দেশ টানা দুই শরও বেশি মৃত্যু দেখতে পায়। সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার হল, বিশেষজ্ঞদের মতে, সংক্রমিত রোগীদের অর্ধেকের বেশি গ্রামাঞ্চলের। যার মানে দাঁড়ায়, ভাইরাস এখন শহর ছাড়িয়ে গ্রাম–গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিতে কী ঘাটতি ছিল? উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা কী সঠিক পথে হাঁটছি? দেখা গেছে, এই ভাইরাসের দ্রুত বিস্তারের প্রধান কারণ এর অত্যধিক সংক্রম্যতা, যা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ রোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করে। এতে করে দ্রুত হাসপাতালসমূহে কোভিড রোগীদের জন্য বরাদ্দ সাধারণ ও আইসিউ শয্যা সংখ্যা নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকে এবং ফলে আগত রুগীদের হাসপাতালে যথাযথ পরিচর্যার আওতায় আনতে না পারায় বাড়তে শুরু করে মৃত্যুর সংখ্যা। দেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার পেছনে বিশেষজ্ঞরা গ্রাম–গঞ্জ থেকে অনেক দেরিতে মুমূর্ষু অবস্থায় রোগীদের হাসপাতালে আনাকেও দায়ী করেছেন। দেশের স্বাস্থ্য–ব্যবস্থার সীমিত সক্ষমতার কারণে তাই প্রথম থেকেই আমাদের ফোকাস থাকা দরকার ছিল, সংক্রমণের বিস্তার রোধের উপর। এ বিবেচনায় প্রথমে আঞ্চলিক পর্যায়ে এবং পরবর্তীতে দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন দিয়ে সরকার সঠিক পথেই এগিয়েছে।
আমরা যেখানে মোটা দাগে পিছিয়ে আছি, তা হল আমরা জনসাধারণের একটি বিপুল অংশকে মাস্ক পরার মতো একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ অথচ নিতান্তই সহজ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণে যথাযথভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারিনি। আমাদের মতো দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় লক-ডাউনের মতো কর্মসূচী প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন সহজ নয়। এক্ষেত্রে ব্যাপক পরিসরে মাস্কের যথোচিত ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে লক-ডাউনের প্রয়োজনীয়তা কমে আসত। মাস্কের সার্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিতকরণে আমরা কেন আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারছি না, তা নিয়ে আরও গুরুত্ব সহকারে ভাবা দরকার। অনেকে মনে করেন, এটি করতে হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক–রাজনৈতিক কর্মী সহ ব্যাপক জনগণকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন, দৃশ্যত যা আমরা এখনও পর্যন্ত হালকাভাবে নিচ্ছি। একই কথা খাটে, বার বার লকডাউন অকার্যকর হয়ে পড়ার ক্ষেত্রেও। দেখা যাচ্ছে, লকডাউন শুরুর কয়েকদিন পরেই এটি বহুলাংশে স্রেফ গণপরিবহন বন্ধ থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রধান সড়ক বাদে অলি–গলিতে লক–ডাউনের আলামত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি লকডাউন সফলভাবে কার্যকরে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা হল স্বল্প ও নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ– যাদের অনেকেই দৈনন্দিন আয়ের উপর নির্ভরশীল তাদের– সহযোগিতায় পাশে দাঁড়ানোর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অনুপস্থিতি।
ডেল্টা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমাদের আরেকটি ঘাটতির দিক হলো, জেলা ও মফস্বল পর্যায়ে করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসার জন্য সাধারণ শয্যা ও আইসিউ বেড সম্বলিত স্বাস্থ্য অবকাঠামো পর্যাপ্ত মাত্রায় কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে একেবারেই না থাকা। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ব্যাপক হারে গ্রামে–গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ায় এটা এখন অন্যতম প্রাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরও একটি বিষয় সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। টিকা সংগ্রহ ও প্রয়োগে আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব ঠেকাতে দ্রুত ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা অপরিহার্য। দুঃখের বিষয়, অনেক আগে এদেশেই টিকা তৈরির প্রস্তাব আমাদের দেওয়া হয়েছিল, যা আমরা হেলায় হারিয়েছি। দেশেও বেসরকারিভাবে টিকা তৈরির চেষ্টা চলছে। সেখানেও আমরা যথোচিত গুরুত্ব আরোপ করতে ব্যর্থ হয়েছি।
দুই সপ্তাহের 'কঠোর' লকডাউনের পর সরকার ঈদ আয়োজন ও কোরবানির পশু কেনা–বেচার মতো অর্থনৈতিক প্রয়োজনকে সামনে রেখে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন প্রত্যাহার করেছে। যদিও জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে সরকারের সামনে শ্রেয়তর কোন বিকল্প ছিল না, কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি মোটেই এর অনুকূল নয়। ঈদ জামাত, কোরবানির হাট এবং ঈদ উপলক্ষে শহর ও গ্রামের মধ্যে দ্বিমুখী জনস্রোত শেষ পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতির উপর কী রকম প্রভাব ফেলে বলা মুশকিল। তবে, ফের লকডাউন শুরুর যে আগাম পরিকল্পনা রয়েছে, তার প্রেক্ষিতে নীতি–নির্ধারকদের নিম্ন আয়ের মানুষকে আর্থিক সাহায্য কিংবা সুদমুক্ত ঋণ দেয়ার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এখনই হাতে নেওয়া জরুরী। এ লোকগুলো যে জীবিকা হারিয়ে পথে বসার জোগাড় হয়েছে, তা হয়তো অনেকের চোখে পড়ছে না।