Published : 25 Jun 2025, 10:16 PM
সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের নতুন প্রস্তাব এবং সাংবিধানিক কাউন্সিলের নাম পরিবর্তন করে নতুন কাঠামোতেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়নি।
বুধবার বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল মাল্টিপারপাস হলে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত এই সংলাপ চলে।
কমিশনের দ্বিতীয় দফা সংলাপের ষষ্ঠ দিনের আলোচনায় বিষয় ছিল তিনটি। সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন, সাংবিধানিক কাউন্সিল এবং প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ। কিন্তু এদিনও কোনো সমাধান আসেনি।
কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ অবশ্য আশা করছেন, আরও আলোচনার মাধ্যমে এসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হতে পারে।
আলোচনা শেষে তিনি বলেন, “বিএনপির পক্ষ থেকে সর্বশেষ বলা হয়েছে, সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য যদি কোনো ধরনের কমিশন বা কমিটি তৈরি করা হয়, তাহলে তারা প্রধানমন্ত্রী থাকার সর্বোচ্চ সময় ১০ বছর করার প্রস্তাব আবার বিবেচনা করবে।
“এই আলোচনায় আমরা কোনোরকম ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি। সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটির বিষয়ে যতক্ষণ না চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকার সীমা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “সবশেষ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকার সীমা নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে সেখানে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল স্বাগত জানিয়েছে। আমরা আশাবাদী আলোচনায় আমরা সবাই একমত হতে পারব।”
প্রস্তাবে পরিবর্তন
বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন এর পরিবর্তে নতুন মূলনীতি হিসেবে 'সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র'র কথা সুপারিশ করেছিল।
এতদিনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো মূলনীতির বিষয়ে একমত হতে না পারায় একটি সংশোধিত প্রস্তাব দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। সেখানে মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’র কথা বলা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে নয় সদস্যের একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনের সুপারিশ করেছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন।
সে সময় বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের স্পিকার, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার এবং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে উভয়কক্ষের কোনো একজন সংসদ সদস্য এনসিসিতে থাকবেন।
প্রস্তাবে বরা হয়েছিল, সব সাংবিধানিক সংস্থার কমিশনারদের নিয়োগ করা হবে এনসিসির কাজ।
বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বিরোধিতায় ঐকমত্য কমিশন একটি নতুন প্রস্তাব দিয়েছে। সেখানে এনসিসির নাম বদলে 'সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি' করার কথা বলা হয়েছে।
আর কমিটির কাঠামো থেকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। সংশোধিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী, নিম্ন ও উচ্চকক্ষের স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা, প্রধান বিরোধী দল ব্যতীত অন্যান্য দলসমূহের একজন প্রতিনিধি, রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি (আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত যোগ্যতাসম্পন্ন), প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত আপিল বিভাগের একজন কর্মকর্তা এ কমিটিতে থাকবেন। কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করবেন নিম্নকক্ষের স্পিকার।
আগের প্রস্তাবে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং তিন বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগের এখতিয়ারও এনসিসিকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। নতুন প্রস্তাবে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রস্তাবিত নিয়োগ কমিটি কেবল সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের নিয়োগ দেবে।
বর্তমান সংবিধানে একজন ব্যক্তি কত মেয়াদ বা কত বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন, তার কোনো সীমা নেই। সংবিধান সংস্কার কমিশন সেখানে প্রস্তাব করেন, একজন প্রধানমন্ত্রী পদে দুই বারের বেশি থাকতে পারবেন না।
এ বিষয়েওেএকমত হতে পারছিল না দলগুলো। সেখানে দুই ‘পূর্ণ মেয়াদ’ হবে, নাকি দুই ‘বার’ হবে, তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক হয়। পরে অধিকাংশ দল ১০ বছরের সীমা বেঁধে দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়।
আলোচনায় কী ফল হল?
আলী রীয়াজ বলেন, বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনার পরপ্রেক্ষিতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলে (এনসিসি) নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। কমিশনের প্রস্তাবিত নতুন নাম হল ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি’। সেই সঙ্গে তিনটি পরিবর্তন আনা হয়েছে।
“এই প্রস্তাবের ক্ষেত্রে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়েছে। আলোচনা শেষে যেটা লক্ষ্য করা গেছে, কিছু দল থেকে এটাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। কিছু কিছু দল আপত্তি জানিয়েছে।”
মূলনীতি পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, “বিদ্যমান সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি অটুট রাখার বিষয়ে কয়েকটি দল মতামত দিয়েছে, আবার কয়েকটি দল ভিন্ন মত দিয়েছে। ফলে এখন পর্যন্ত কোনো ঐকমত্য তৈরি হয়নি।
“তবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র, সামাজিক সুবিচার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি এবং পক্ষপাতহীনতা এই পাঁচটি বিষয় উল্লেখ করার পক্ষে অধিকাংশ দলের সম্মতি রয়েছে।ঐকমত্য কমিশন এ বিষয়ে আরো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আগামী সপ্তাহে পেশ করবে।”
দলগুলো কী বলছে?
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করে ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া প্রস্তাব ও সাংবিধানিক কাউন্সিলের পরিবর্তন করে নতুন কাঠামেরও বিরোধিতা করেছেন।
তিনি বলেন, “এনসিসির মত কোনো বডি যদি নির্বাহী ক্ষমতার কর্মকাণ্ডে ইন্টারফেয়ার করে, আমরা সে প্রস্তাবটা গ্রহণ করব না। এনসিসির মত ব্যবস্থা থাকলে আমরা আগের অবস্থায় থাকব (প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার ১০ বছরের সীমা মানব না) । বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের ক্ষেত্রে বিষয়টা এখনো আমরা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারিনি, পেন্ডিং রয়ে গেল।
সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “এটি তারা করবে, যারা জনগণের ম্যান্ডেট পাবে। আমরা বলেছি, রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সাথে পঞ্চম সংশোধনীতে যে আর্টিকেলগুলো ছিল, সেগুলো সংযোজন করব। এবং কমিশনের উপরোক্ত বাক্যগুলো আমরা সংযোজন করব। তবে এটায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটা পেন্ডিং রয়ে গেল।”
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, “রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে 'আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' যুক্ত করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। মূলনীতিতে পরিবর্তন আনার প্রস্তাবনা এসেছে। যেখানে 'সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি' থাকবে। এই কথার সাথে পঞ্চম সংশোধনীর 'আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' যুক্ত করার ব্যাপারে আমাদের সাথে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ঐকমত্য পোষণ করেছে।”
সংবিধানে বিদ্যমান মূলনীতি পরিবর্তন করে নতুন মূলনীতি চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপিও।
দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “জাতীয় নাগরিক পার্টি মনে করে ৭২ এর সংবিধান এবং পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যে মূলনীতিগুলো এসেছে, সেগুলো দলীয় মূলনীতি, ৭২ এর মূলনীতি একটা মুজিববাদী মূলনীতি। এই মূলনীতিগুলোর ভিত্তিতে অভ্যুত্থানের পরে যে নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছে, তাদের চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে পূর্বেকার মূলনীতিগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
“এ কারণে জাতীয় নাগরিক পার্টি মনে করে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার এবং গণতন্ত্র এই বিষয়গুলোকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।”
আখতার বলেন, “আজকের আলোচনায় এখানে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা প্রস্তাব রেখেছি, পূর্বেকার ৭২ এর যে সংবিধান আছে, বর্তমান যে মূলনীতি আছে সেগুলোকে বাদ দিয়ে নতুন করে মূলনীতি গঠন করতে হবে।”
এনসিসির নাম পাল্টে 'সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি' করা হলে এনসিপির আপত্তি নেই বলে জানান আখতার।
তিনি বলেন, “সাংবিধানিক কাউন্সিলের ধারণা যেটা ছিল, সাংবিধানিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেগুলোর নিয়োগের ক্ষেত্রে যেন নিরপেক্ষতা থাকে, যেন একটি নিরপেক্ষ বডি নিয়োগগুলো করতে পারে। আগে যেমনটা হয়েছে, শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর একক হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ হত।“
এ বিষয়েও কোনো ঐকমত্য হয়নি জানিয়ে আখতার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “বাংলাদেশে যে কারণে একটা অভ্যুত্থান হল, সে অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে আমরা নতুন কাঠামোর মধ্য দিয়ে নতুন একটা গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে পরিচালনা করব। অথচ এই মনস্তত্ত্বের সঙ্গে জনগণের সঙ্গে কয়েকটি দলের একাত্মতা নেই। তারা পুরনো ধারণার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছে।
“অনেকে 'সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি'র সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কতবার থাকবেন বা কত বছর থাকবেন এই বিষয়গুলোকে একীভূত করেছেন। এটা নিয়ে তিনটি দল ছাড়া বাকি সব দল ঐকমত্য পোষণ করেছে।”
এনসিপি নেতা বলেন, “আলোচনাকে আজকে আবার দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষেরা যে প্রেক্ষাপটে জীবন দেওয়ার জন্য এসেছিলেন, এই সংস্কারকে যদি বাস্তবায়ন করা সম্ভপর না হয়, নতুন কাঠামো নতুন গণতান্ত্রিক কাঠামো যদি আমরা জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে না পারি, তাহলে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ হবে এবং আজকে যে আমরা ঐকমত্য কমিশনে এসেছি, এর সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।”
ঐকমত্যের সংলাপের শুরু থেকেই সংবিধানের চার মূলনীতি পরিবর্তনের বিরোধিতা করে আসছে সিপিবি, গণফোরামসহ বাম দলগুলোর নেতারা।
গণফোরামের গণফোরাম নির্বাহী সভাপতি এ কে এম জগলুল হায়দার আফ্রিক বলেন, "সংবিধানের মূলনীতি ঠিক রেখে নতুন কোনো বিষয় থাকলে সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সংবিধানের মূলনীতিতে হাত দেওয়া যাবে না, সেটা আমরা বলেছি।
"আর এনসিসির নতুন নাম প্রস্তাব করে গঠন প্রক্রিয়া কিছুটা পরিবর্তন করে তারা প্রস্তাব করেছে। এখন নতুন নাম নিয়ে কারও দ্বিমত নেই, তবে প্রস্তাবিত বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে বলা যাবে।"
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহীন হোসেন প্রিন্স বলেন, “সংবিধানে বিদ্যমান চার মূলনীতির কোনো একটা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমরা ছাড়া দেব না। বিদ্যমান মূলনীতি অক্ষুণ্ন রেখে অন্য প্রস্তাব সংযুক্ত হতে পারে, ওখানে হাত দেওয়া যাবে না।”